ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ

বিজয়ের গৌরবগাথা ॥ প্রথম প্রহরের গণহত্যা

প্রকাশিত: ২১:১৫, ৩ ডিসেম্বর ২০২১

বিজয়ের গৌরবগাথা ॥ প্রথম প্রহরের গণহত্যা

পাকিস্তানের সামরিক শাসক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করেন। এই ঘোষণার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১ মার্চ থেকে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় একটি নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তরের পাশাপাশি একটি জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। ২৫ মার্চ রাতে অনেকেই বঙ্গবন্ধুকে অনুরোধ করে বলেছেন, ‘তিনি যেন ৩২ নম্বরের বাসভবন ত্যাগ করেন।’ বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘ওরা যদি আমাকে না পায়, ঢাকা শহরকে ওরা তছনছ করবে। লাখ লাখ লোককে ওরা হত্যা করবে। আমি তো জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি। আমি এভাবে অন্য জায়গায় গিয়ে আশ্রয় নিতে পারি না। আমি আমার বাড়িতেই থাকব। কারণ, আমি আমার জীবন বাংলার মানুষের জন্য উৎসর্গ করেছি।’ আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করে রাত পৌনে ৮টায় ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে পূর্ব বাংলায় নিরপরাধ বাঙালীদের ওপর কাপুরুষোচিত সামরিক অভিযান চালানোর নির্দেশ দিয়ে বলেছিল ‘আমি শুধু বাংলার মাটি চাই, মানুষ নয়।’ তাদের আলোচনার লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে সামরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য কালক্ষেপণ ও গণহত্যা পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ। বাঙালীর স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী রাতের অন্ধকারে শুরু করে নিষ্ঠুর গণহত্যা। পাকহানাদার বাহিনী জেনারেল ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে জল্লাদের মতো বাংলাদেশের নিরস্ত্র নিরপরাধ জনগণের ওপর মেশিনগান, মর্টার আর ট্যাঙ্ক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং শহরে ৫০ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করে। মধ্যরাত থেকে ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে শুরু হয় ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা। পাকহানাদার বাহিনী পূর্বপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পূর্ণ সামরিক সম্ভার নিয়ে রাত ১টা অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে শুরু করে দেশব্যাপী পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংসলীলা। সামরিক ভাষায় ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পরিচিত ছিল এই হত্যা-অভিযান। রাতে ঢাকা নগরীর নিরীহ-নিরস্ত্র মানুষের ওপর বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী ট্যাঙ্ক ও ভারি অস্ত্রসহ ঝাঁপিয়ে পড়ে। কামানের গোলা, মর্টারের শেল আর মেশিনগানের ভয়াল গর্জনে মধ্য রাতের পর পুরো নগরীই জাহান্নামে পরিণত হয়। ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নীলনক্সায় ঢাকার চারটি স্থান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্য ছিল। এর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর বাসভবন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস, রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স এবং তৎকালীন ইপিআরের পিলখানা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকবৃন্দসহ ইকবাল হলের ছাত্রলীগ নেতা চিশতি হেলালুর রহমান ও জাফর আহমদকে হত্যা করে। এ ছাড়া জগন্নাথ হলের অনেক ছাত্রকে হত্যা করা হয়। ঢাকার চারটি স্থান ছাড়াও রাজশাহী, যশোর, খুলনা, রংপুর, সৈয়দপুর, কুমিল্লা, সিলেট ও চট্টগ্রাম ছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর আওতাভুক্ত এলাকা। ‘বেইজ ফর অল স্টেশন্স, ভেরি ইমপর্ট্যান্ট মেসেজ। প্লিজ কিপ নোট। ...উই আর অলরেডি এ্যাটাক্টড বাই পাক আর্মি। ট্রাই টু সেভ ইয়োরসেলফ। ওভার অ্যান্ড আউট।’ ২৫ মার্চ মধ্যরাতের আগে পুলিশ স্টেশনের ওয়্যারলেসে এই বার্তা প্রচার করেছিলেন পুলিশ সদস্য শাহজাহান মিয়া। শাহজাহান মিয়ার এই বার্তা ছাড়া আরও কয়েকটি সূত্রে রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সের সদস্যরা জেনে গিয়েছিলেন, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সেখানে আক্রমণ চালাতে যাচ্ছে। ফলে ‘১১টার দিকে পাকিস্তানী সেনারা পুলিশ লাইন্স ঘিরে ফেললে রাত ১২টা থেকে থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে দেন পুলিশ সদস্যরা। ট্যাঙ্ক, মর্টার আর মেশিনগানের সঙ্গে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারেননি তারা। একপর্যায়ে পুলিশ সদস্যদের গুলি শেষ হয়ে গেলে জীবিত পুলিশ সদস্যরা যে যেভাবে পারেন পালিয়ে যান। শতাধিক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে সকাল হওয়ার আগেই সেনাবাহিনীর আট-দশটা ট্রাকে করে লাশ সরিয়ে ফেলা হয়। যারা রাজারবাগ থেকে পালাতে পারেনি, তাদের দেড়শ’ জনকে বন্দী করা হয়,’ বলছিলেন মুক্তিযোদ্ধা পুলিশ সদস্য শাহজাহান মিয়া। অভিযান শেষে পরদিন ভোরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণকক্ষ যখন ওয়্যারলেস বার্তায় রাজারবাগে পুলিশের মৃতের সংখ্যা জানতে চাইছিল, তখন বলা হয়, এখনও গোনা শেষ হয়নি। তবে সংখ্যা অনেক। লাশ সেনাবাহিনীর ট্রাকে করে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দেয়া হয়। রাত ১টায় ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা পিলখানা ইপিআর হেডকোয়ার্টারে আক্রমণ চালায়। কেন্দ্রীয় কোয়ার্টার গার্ডে ১৮ জন বাঙালী গার্ড থাকলেও তারা পাল্টা আক্রমণের সুযোগ পায়নি। পিলখানার সঙ্গে সঙ্গে রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শাঁখারীবাজারসহ সমগ্র ঢাকাতেই শুরু হয় প্রচ- আক্রমণ। বিভিন্ন এলাকাতে যথেচ্ছ হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ এবং অগ্নিসংযোগ করে চলে বর্বর পাক হানাদার বাহিনী। ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে মুক্তি সংগ্রামের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। গোপন ওয়্যারলেস বার্তা পাঠানো হয়। পিলখানায় ইপিআর ব্যারাক ও অন্যান্য স্থান থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার লিখিত বাণী টেলিগ্রাম, টেলিপ্রিন্টার, ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারাদেশে মেসেজ আকারে পাঠানো হয়। এই ওয়্যারলেস বার্তা চট্টগ্রাম ইপিআর সদর দফতরে পৌঁছায়। চট্টগ্রাম উপকূলে নোঙর করা একটি বিদেশী জাহাজও এই মেসেজ গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা চট্টগ্রামে পৌঁছায়। চট্টগ্রামে অবস্থানকারী আওয়ামী লীগের শ্রম সম্পাদক জহুর আহমেদ চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী সাইক্লোস্টাইল করে রাতেই শহরবাসীর মধ্যে বিলির ব্যবস্থা করেন। চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে সারা শহরে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা মাইকে প্রচার করা হয়। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে, মুক্তি সংগ্রামীদের সর্বাত্মক সহযোগিতা করার জন্য এলাকাবাসীর কাছে আবেদন জানানো হয়। জহুর আহমেদ চৌধুরী কর্তৃক সাইক্লোস্টাইল করা বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী বিভিন্ন এলাকায় বিতরণের ব্যবস্থা করেন। প্রথম পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ সূচিত হয় চট্টগ্রাম থেকেই। মেজর রফিকের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম থেকে ইপিআর বাহিনী পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ ঘোষণা করে চট্টগ্রাম শহর দখল করেন এবং ইপিআরের ৪০০ জন অবাঙালী সৈন্যকে বন্দী করা হয়। ছাত্রনেতা এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর নেতৃত্বে ছাত্র-জনতা রাইফেলস ক্লাব ও পুলিশের অস্ত্রাগার থেকে গোলাবারুদ হস্তগত করেন। রাতে চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে পাকসেনারা বেরিয়ে এলে হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়। মধ্য রাতে যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ঢাকা শহরে অপারেশন সার্চলাইট শুরু করে, প্রায় একই সময়ে চট্টগ্রাম শহরে অবস্থিত অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসার ও বাঙালী সৈনিকরা পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের অফিসার ও সৈনিকরা বিদ্রোহ শুরু করেন। আনুমানিক রাত ১২টা ১৫ মিনিট হতে বাঙালী অফিসার ও সৈনিকরা অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানী সেনাদের বন্দী করতে শুরু করেন। এই পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে মধ্যরাতের নিকটবর্তী সময়ে আনুষ্ঠানিকভাবে চট্টগ্রামে সেনা বিদ্রোহের সূচনা হয়। ঢাকায় রাত ১টায় পাকবাহিনীর একটি দল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের অদূরে শুক্রাবাদে ব্যারিকেডের মুখোমুখি হয়। এখানে প্রতিরোধব্যূহ ভেঙ্গে হানাদাররা রাত দেড়টায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে আসে। হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। বঙ্গবন্ধুকে রাত দেড়টায় তাঁর বাসভবন থেকে বন্দী করে শেরেবাংলা নগরের সামরিক বাহিনীর সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে বঙ্গবন্ধুকে সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। সকাল পর্যন্ত আদমজী কলেজের একটি কক্ষে বঙ্গবন্ধুকে আটক রাখা হয়। বিদেশী গণমাধ্যমকর্মীরা সংবাদ সংগ্রহের জন্য অবস্থান করছিল শাহবাগের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে। তাদের মধ্যে ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ অস্ট্রেলিয়া, ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স, জাপান ও রাশিয়ার প্রায় ৩৭ সাংবাদিক। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী সকল বিদেশী সাংবাদিককে জোরপূর্বক হোটেলে আটকে রাখে। কেউ ভাবতেও পারেনি কী ঘটতে যাচ্ছে সেই রাতে। অস্ট্রেলিয়ার ‘সিডনি মর্নিং হেরাল্ড’ পত্রিকায় প্রকাশিত একটি লেখা থেকে জানা যায়, শুধু ২৫ মার্চ রাতেই বাংলাদেশে প্রায় এক লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যা গণহত্যার ইতিহাসে এক জঘন্যতম ভয়াবহ ঘটনা। মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন ২৫ মার্চ রাত সম্পর্কে লিখেছেন, সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্যরা হত্যার পাশাপাশি জ্বালাতে শুরু করল ঘরবাড়ি, দোকানপাট, লুট আর ধ্বংস তাদের নেশায় পরিণত হলো যেন। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা মৃতদেহগুলো কাক-শিয়ালের খাবারে পরিণত হলো। সমস্ত বাংলাদেশ হয়ে উঠল শকুনতাড়িত শ্মশানভূমি। লেখক : গবেষক [email protected]
×