ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

স্মৃতিতে নিষ্ঠুর নবেম্বর

প্রকাশিত: ২১:০৫, ২৯ নভেম্বর ২০২১

স্মৃতিতে নিষ্ঠুর নবেম্বর

এ লেখাটি ২০২১ সালের ৭ নবেম্বর প্রকাশিত হবে- এমনই ইচ্ছে ছিল আমার। অনেক বিষয়ে ব্যস্ত থাকার কারণে লিখতে পারিনি। তবে ইতিহাস তো ইতিহাসই, তা যখনই প্রকাশিত হোক না কেন? তখন আমি এফ-২৭ এরোপ্লেনের ক্যাপ্টেন। ফ্লাইংয়ের সময়টুকু ছাড়া বাদবাকি সময় তেজগাঁও বিমানবন্দরের ক্রু-রুমে বসে আড্ডা দিতাম, তাস খেলতাম, তাসের জুয়া খেলতাম। পাশেই ছিল বিমানবন্দরের রেস্তোরাঁ। ওখান থেকে খাবার আনিয়ে খেয়ে নিতাম। এ লেখা লিখছি ৪৬-৪৭ বছর পর। তাই সার্বিক দিনক্ষণের ব্যাপারে একটু-আধটু ভুলভ্রান্তি থাকতে পারে। কিন্তু ঘটনাসমূহের স্মৃতি একদম জাজ্বল্যমান। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর খুনীরা বঙ্গভবনে অবস্থান করে খন্দকার মোশতাকের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করছিল। খন্দকার মোশতাকের মাধ্যমে সেনাপ্রধান সফিউল্লাকে অপসারণ করে জিয়াউর রহমান সেনাপ্রধান হন। বাহ্যিক দৃষ্টিতে জিয়ার সঙ্গে মোশতাকের সম্পর্ক ছিল ভাল। মোশতাক নিজে মনে করতেন যে, তিনি খুব বুদ্ধিমান এবং ধূর্ত ব্যক্তি। আসলে তিনি ছিলেন যথেষ্ট নির্বোধ। বঙ্গবন্ধুর ক্যাবিনেটে তিনি যথেষ্ট মর্যাদাপূর্ণ পদে ছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডে জড়িত হয়ে তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে ঘৃণিত ব্যক্তি হিসেবে পরিণত হন। মোশতাককে দিয়ে সব অপ্রিয় কাজগুলো করিয়ে জিয়াউর রহমান তাকে গলাধাক্কা দিয়ে ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত করেন। তখন তার মর্যাদা হয় রাস্তার কুকুরের সমান। ১৯৭৫ সালের অক্টোবর মাসের শেষের দিকে সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক আছে- এমন দু’একজন বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম, সেনাবাহিনীর কিছু উর্ধতন কর্মকর্তা, প্রতিরক্ষা বাহিনীতে শৃঙ্খলা এবং চেন অব কমান্ড ফিরিয়ে আনতে মুশতাক এবং ফারুক-রশীদ গংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করবেন। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি দেখলাম, বাংলাদেশ বিমানের প্রতিটি ফ্লাইটে সশস্ত্র দু’জন স্কাই মার্শাল বিমানের সামনের আসনে বসে যাতায়াত করতে শুরু করেছে। তখন আমরা বুঝিনি স্কাই মার্শাল বহন করার কারণ। আসলে এটা কর্নেল তাহের এবং তার সঙ্গে সহমত পোষণকারীদের গ্রেফতার করার সতর্কতামূলক পূর্বপ্রস্তুতি। কেউ যেন কর্নেল তাহের এবং সহমত পোষণকারীদের পরবর্তী সময় গ্রেফতার এবং ফাঁসি দেয়ার আগে জাপানী বিমান হাইজ্যাককারীদের মুক্তি দাবি না করতে পারে। ৩ নবেম্বর রাত তিনটায় খুনী মোসলেহ উদ্দিনের নেতৃত্বে চার-পাঁচজন সৈনিক গিয়ে জেলখানায় আটক চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করে। এত রাতে জেলখানার গেট খোলার কথা নয়। কিন্তু খোদ খন্দকার মোশতাক প্রধান জেল কর্মকর্তাকে গেট খোলার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ৩ নবেম্বর সকালে খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল জামিল চৌধুরী যখন বঙ্গভবনের দিকে অভিযান শুরু করেন তখন পর্যন্ত জেলখানার হত্যাকান্ডের বিষয় তাদের জানা ছিল না। বঙ্গভবনে ফারুক-রশীদ যখন অবস্থান করছিল, তখন কয়েকটি ট্যাংক তাঁদের অধীনে ছিল। খালেদ মোশাররফের বাহিনীর অগ্রযাত্রায় বাধা দেয়ার জন্য এগিয়ে আসে ট্যাংকগুলো। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে বিমানবাহিনীর কয়েকজন পাইলটও যোগ দিয়েছিলেন। এই দলের নেতৃত্বে ছিলেন তখনকার স্কোয়াড্রন লিডার লিয়াকত বীর উত্তম। ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার বদরুল আলম বীর উত্তম, স্কোয়াড্রন লিডার সালাউদ্দিন, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট জামাল উদ্দিন, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট ইকবাল রশীদ প্রমুখ। অগ্রসরমান ট্যাংকগুলোকে বাধা দেয়ার জন্য জামাল উদ্দিন মিগ-২১ জঙ্গী এরোপ্লেন নিয়ে আকাশে উড্ডীন হলেন। মিগ-২১ জঙ্গী এরোপ্লেনকে উড্ডীয়মান দেখে ট্যাংকগুলো পিছু হটে গিয়ে আবার বঙ্গভবনের সন্নিকটে আশ্রয় গ্রহণ করল। ওই সময় বাংলাদেশ বিমানের পাইলট ক্যাপ্টেন কামাল মাহমুদের একটি উল্লেখযোগ্য ভ‚মিকা ছিল। তিনি যুদ্ধে বিবদমান দুই দলের মধ্যে মধ্যস্থতার ভ‚মিকা পালন করেছিলেন। খুনী ফারুক-রশীদরা যখন দেখল, তাদের পরাজয় নিশ্চিত, তখন তারা আত্মসমর্পণ করতে রাজি হয়। তবে শর্তারোপ করে যে, তাদের দেশ ত্যাগ করে নিরাপদে ব্যাঙ্কক যেতে দিতে হবে। একখানা ফকার ফ্রেন্ডশিপ প্লেনে তাদের দেশ ত্যাগ করার অনুমতি দেয়া হলো। ওই ফকার ফ্রেন্ডশিপ এরোপ্লেনের পরিচালক অর্থাৎ, পাইলট ছিলেন ফারুক-রশীদেরই ঘনিষ্ঠ বাংলাদেশ বিমানের দুই ক্যাপ্টেন। খালেদ মোশাররফের ভুল ছিল যে, তিনি শাফায়েত জামিল বা তার সমর্থক সামরিক নেতাদের সঙ্গে অভিযান পরিকল্পনা নিয়ে যতটা সময় শলাপরামর্শ করেছিলেন, তার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করেছিলেন এনায়েত উল্লাহ খান, সাদেক খানদের মতো ধুরন্ধর ব্যক্তিদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে। তিনি বিজয় সম্পন্ন হয়েছে মনে করে নিজেকে সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ ঘোষণা করেন, নিজেকে ব্রিগেডিয়ার থেকে মেজর জেনারেল পদমর্যাদার ব্যাজ পরান। নবেম্বর মাসের চার অথবা পাঁচ তারিখ বিকেল বেলা তেজগাঁও বিমানবন্দরের ক্রু রুমে আমি অন্যদের সঙ্গে বসে তাস খেলছিলাম। এমন সময় খুব হৈ চৈ শুনতে পেলাম। জানতে পারলাম, বিদ্রোহী সৈনিকরা বিমানবন্দরের টারম্যাক এলাকায় তিন-চারজন প্রতিরক্ষা বাহিনীর অফিসারকে গুলি করে হত্যা করেছে। আমরা বুঝতে পারলাম, খুনী সৈনিকরা এবার নিশ্চয়ই বিমান ভবনে প্রবেশ করে খুঁজে দেখবে কোন অফিসার লুকিয়ে আছে কি-না? তাই আমরা ওই মুহূর্তে বিমানবন্দর ত্যাগ করলাম। তখন আমার বাসা ছিল ধানমন্ডিতে। ভাগ্যক্রমে একখানা বাংলাদেশ বিমানের মাইক্রোবাস পেয়ে গেলাম। মাইক্রোবাসের ড্রাইভারকে অনুরোধ করলাম, আমাকে বাসায় পৌঁছে দিতে। যখন মানিক মিয়া এভিনিউ দিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন কয়েকজন সশস্ত্র সৈনিক গাড়ির গতিরোধ করে আমার পরিচয় জানতে চায়। সাধারণত পরিচয় দিতে গিয়ে বলি, ‘আমি ক্যাপ্টেন সাত্তার’। কিন্তু ওই দিন বললাম, ‘আমি বাংলাদেশ বিমানের পাইলট’। যদি ‘ক্যাপ্টেন সাত্তার’ বলতাম তবে হয়ত ওইখানেই আমাকে গুলি করা হতো। ক্যাপ্টেন রফির কাহিনী আরও চমকপ্রদ। তার বাসা ছিল মোহাম্মদপুর। আমার চেয়ে খানিকটা সময় পরে সেও শেরেবাংলা নগর দিয়ে বাসায় যাচ্ছিল। সশস্ত্র সৈনিকরা তারও পরিচয় জানতে চায়। উত্তরে সে বলল, আমি ক্যাপ্টেন রফি। অমনি একজন সৈনিক তার দিকে অস্ত্র উঁচিয়ে ধরে গুলি করতে উদ্যত হয়। মুহূর্তেই রফি বুঝতে পারল, ক্যাপ্টেন বলে নিজের পরিচয় দিয়ে মস্ত বড় ভুল করেছে। সঙ্গে সঙ্গে বলল, আমি সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন নই, বাংলাদেশ বিমানের ক্যাপ্টেন। এই বলে সঙ্গে থাকা তার আইডি কার্ড বের করে সৈনিককে দেখাল। আইডি কার্ড দেখে সৈনিকরা তাকে ছেড়ে দিল। আইডি কার্ড সঙ্গে ছিল বলে প্রাণে বেঁচে গেল রফি। কর্নেল শাফায়েত জামিল জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী করে রেখেছিলেন। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে অনেক সৈনিকের সমর্থন নিয়ে ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’ নামের একটি সংগঠন তৈরি করা হয়েছিল। ৭ নবেম্বর সকাল বেলায় দেখলাম, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং জাসদ দলের সমর্থক অনেকে বিভিন্ন যানবাহনে ঢাকা সেনানিবাসের দিকে যাচ্ছে। ৭ নবেম্বর কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমানকে গৃহবন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করলেন। তারপর তাহের, তার বড় ভাই ইউসুফ খান এবং তাদের সমর্থক কয়েকজনকে নিয়ে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বসলেন। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ১২ দফা দাবি ছিল। এর মধ্যে ছিল সৈনিকদের বেতন বৃদ্ধি এবং কমিশনড্ ও ননকমিশনড্ অফিসারদের মধ্যে পদমর্যাদার বৈষম্য কমানোসহ অন্যান্য দাবি। ১২ দফা দাবির মধ্যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের দাবিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। জিয়াউর রহমান পবিত্র কোরান শরীফের ওপর হাত রেখে প্রতিজ্ঞা করলেন, তিনি ওই ১২ দফার সব দাবি বাস্তবায়ন করবেন। কিন্তু তিনি তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেননি। প্রতিরক্ষা বাহিনীতে সৈনিকদের মধ্যে কর্নেল তাহের ছিলেন সর্বাধিক জনপ্রিয়। কিন্তু জিয়াউর রহমানের সমর্থনও ছিল যথেষ্ট। পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত সব সৈনিকসহ বেশ একটি বড় অংশ জিয়াউর রহমানের সমর্থকদের সঙ্গে হাত মেলানোর ফলে জিয়াউর রহমানই হয়ে গেলেন সেনাবাহিনীর মধ্যে এককভাবে সবচেয়ে শক্তিশালী ও ক্ষমতাধর ব্যক্তি। সেনাবাহিনী তখন তিনটি ধারায় বিভক্ত। খালেদ মোশাররফের সঙ্গে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ভক্তরা। দ্বিতীয় ধারাটি ছিল-কর্নেল তাহেরের সমর্থক ‘বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা’। তৃতীয় ধারায় ছিল-জিয়াউর রহমান সমর্থকরা। তখন প্রতিরক্ষাবাহিনীর কত সৈনিককে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল অথবা খুন করে নিখোঁজ করে দিয়েছিল, সেটার সঠিক সংখ্যা বলা সত্যিই কঠিন। তবে সংখ্যানুপাতে বোধ হয় বড় ধাক্কাটা গিয়েছিল বিমানবাহিনীর ওপর দিয়ে। যেসব সৈনিকের ফাঁসি হয়েছিল বা যারা নিখোঁজ হয়েছিলেন তাদের সবাই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা অথবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। কর্নেল হায়দার, কর্নেল হুদা, ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ, কর্নেল তাহের, কর্নেল মাহফুজুর রহমান, ব্রিগেডিয়ার মহসিন উদ্দিন-সবাই বীর উত্তম, বীর বিক্রম। কতজনের নাম বলব। দেড় থেকে দু’হাজার মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসি দেয়া হয়েছিল। তারা সবাই ছিলেন নির্দোষ। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ সালের মধ্যে যাদের ফাঁসি দেয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে একজনও রাজাকার ছিল না। শেষ পর্যন্ত জিয়াউর রহমানকেও হত্যা করা হয়েছিল। তিনিও ছিলেন বীর উত্তম। কেমন যেন কাকতালীয় ব্যাপার! ভুল করেও একজন রাজাকারকে ফাঁসি তো দূরের কথা, কাউকে কারাগারেও যেতে হয়নি! আমার এক বন্ধু আছেন, তার নাম আনোয়ারুল কবির। বহু বছরের প্রচেষ্টায় তিনি প্রায় দশ ঘণ্টার একটি ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। ডকুমেন্টারি ফিল্মের সব তথ্য গ্রন্থিত করে একখানা বই প্রকাশ করেছেন। নামকরণ করেছেন, ‘সশস্ত্র বাহিনীতে গণহত্যা’। বইখানা পড়তে গিয়ে আবেগ-তাড়িত হয়ে চোখের পানি আটকে রাখা যায় না। পাঠকদের বলব বইখানা সংগ্রহ করে পড়ুন এবং সংরক্ষণ করুন। আমার আর এক বন্ধু আছেন জুলফিকার সাহেব। তিনি বঙ্গবন্ধুর ভক্ত ও অনুরাগী। তিনি ঢাকা কারাগারের অনেক নির্দোষ মুক্তিযোদ্ধা সৈনিকের ফাঁসি দেয়ার সময় ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে বাধ্য হয়েছিলেন। তিনি বলেছেন, প্রতি রাতে দশ-বারোজনকে ফাঁসি দেয়া হতো। ফাঁসির প্রক্রিয়ার বীভৎস দৃশ্য দেখতে গিয়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। কর্নেল তাহের ফাঁসির মঞ্চে ওঠার পর তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, আপনার শেষ ইচ্ছা কি? তিনি বললেন, আমার নিজেরই লেখা একটি কবিতা পাঠ করে সবাইকে শোনাতে চাই। কবিতাটি তুলে ধরছি- ‘জন্মেছি সারা দেশটাকে কাঁপিয়ে তুলতে,/কাঁপিয়ে দিলাম।/জন্মেছি, তোদের শোষণের হাত দুটো ভাঙব বলে,/ভেঙ্গে দিলাম।/জন্ম আর মৃত্যুর দুটি পাথর/রেখে গেলাম।/পৃথিবী-অবশেষে এবারের মতো বিদায় নিলাম।’ লেখক : বীর প্রতীক, সাবেক বৈমানিক, কিলো ফ্লাইট
×