ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঘোর আঁধারে পথ দেখাবে আগুনের নিশান

প্রকাশিত: ২১:৪৫, ২৭ নভেম্বর ২০২১

ঘোর আঁধারে পথ দেখাবে আগুনের নিশান

সাজেদ রহমান ॥ গণসঙ্গীতের বেশ বড়সরো একটি উৎসব। তিন দিনের উৎসবে দেশের বিভিন্ন এলাকায় সক্রিয় ১৮ সংগঠন ও তিন শতাধিক শিল্পী অংশ নিয়েছেন। জাগরণের গানে মুখর হয়ে উঠেছে উৎসবস্থল। প্রাথমিক বর্ণনা শুনে মনে হতেই পারে আয়োজনটি রাজধানীতে। আসলে তা নয়। যশোরে। যশোরের বিখ্যাত টাউন হল ময়দানে গণসঙ্গীতের, বলা চলে, গণ জোয়ার বইছে। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদ্যাপন উপলক্ষে এ উৎসব আয়োজন করেছে ‘পুনশ্চ যশোর’ নামের স্থানীয় একটি সংগঠন। ঢাকার বাইরে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এমন ত্বরিত আয়োজন এখন পর্যন্ত তেমন লক্ষ্য করা যায়নি। যশোরে ব্যতিক্রম দেখা গেল। বৃহস্পতিবার শুরু হওয়া উৎসবের প্রতিদিনই থাকছে গণসঙ্গীত, গণমুখী আবৃত্তি ও গণমুখী নৃত্যের পরিবেশনা। শতাব্দী বটমূলে রওশন আলী মঞ্চে প্রতিদিন বিকেল পাঁচটায় শুরু হয়ে উৎসব চলছে রাত পর্যন্ত। গণসঙ্গীতপ্রেমী শ্রোতা, দেশ ও রাজনীতি সচেতন মানুষ লম্বা সময় ধরে উপভোগ করছেন উৎসব। বিভিন্ন অঞ্চলের সংস্কৃতিকর্মীদের মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে বৃহৎ এ আয়োজন। উৎসবের দ্বিতীয় দিন শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় আরও জমজমাট হয়ে ওঠে উৎসব। এদিন ঢাকার সত্যেন সেন শিল্পীগোষ্ঠী তাদের একটি উল্লেখযোগ্য গীতি নৃত্যনাট্য ‘ইতিহাস কথা কও’ নিয়ে মঞ্চে ছিল। সঙ্গীত ও নাটকের ভাষায় এ অঞ্চলের মানুষের রাজনৈতিক ইতিহাস, ভৌগোলিক পরিবর্তন ও এসবের প্রভাবে দুর্দশাগ্রস্ত জীবন সমাজ সংস্কৃতির চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়। দেশভাগের চির বেদনা, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডসহ ইতিহাসের নানা বাঁক স্বতন্ত্র ভাবনা থেকে তুলে ধরে প্রযোজনাটি। একই দিন ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে ছিল খুলনা উদীচী, মেহেরপুর উদীচী ও চুয়াডাঙ্গার দর্শনার আনন্দধাম। যশোরের রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ, সুরবিতান, শেকড় ছাড়াও আয়োজক সংগঠক পুনশ্চ’র শিল্পীরা এদিন গণসঙ্গীত ও গণনৃত্য পরিবেশন করেন। এর আগে উৎসবের উদ্বোধনী দিনে বৃহস্পতিবার পরিবেশনা নিয়ে মঞ্চে ছিল ঢাকার বহ্নিশিখা, বাগেরহাটের অংকুর, গণসঙ্গীত সমন্বয় পরিষদের সাতক্ষীরা শাখা, নড়াইলের বেনুকা, ঝিনাইদহ জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, যশোরের নৃত্যবিতান, সুরধুনী ও পুনশ্চ। আজ শনিবার উৎসবের সমাপনী দিনেও থাকবে একইরকম আয়োজন। উৎসবের স্লোগান ‘ঘোর আঁধারে পথ দেখাবে আগুনের নিশান।’ প্রতিবাদ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে উৎসবের আহ্বায়ক পান্না লাল দে বলেন, আসলে মানুষের অধিকার আদায়ের এবং আদর্শিক আন্দোলন-সংগ্রামের নানা ঘটনা বাংলায় অগণিত গণসঙ্গীতের জন্ম দিয়েছে। ব্রিটিশ আমল তো ছিলই পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক আমলেও আমাদের সাংস্কৃতিক যুদ্ধ করতে হয়েছে মুসলিম লীগ ও সামরিক জান্তার দুঃশাসনের বিরুদ্ধে। আর এই সংগ্রামের পথপরিক্রমায় রক্তিম বাংলার অমিততেজ মানুষ যে বিদ্রোহ-বিপ্লবের সৃষ্টি করেছে, তারই পরিণতিতে সৃষ্টি হয়েছে গণসঙ্গীত। এ ছাড়া দেশের গান, স্বদেশী সঙ্গীত, দেশাত্মবোধক গান, সর্বোপরি গণসঙ্গীত রচিত হয়েছে ব্রিটিশ ও পাকিস্তানী নিপীড়কগোষ্ঠীর নির্যাতনের বিরুদ্ধে, প্রতিরোধ সংগ্রামে। এ দেশের সাহসী গীতিকার যেমন সৃষ্টি করেছেন গণসঙ্গীত দেশপ্রেমের অকুতোভয় সাহসে, সেই গান পরিবেশিত হয়েছে প্রগতিশীল সুরকারের অমর সৃষ্টিতে এবং গণশিল্পীর বজ্রকণ্ঠে। এইসব গণসঙ্গীত দেশের নানা সংগ্রাম ও আন্দোলনে গীত হয়েছে মানুষকে উজ্জীবিত করার জন্য। সেই উজ্জীবনী গান মানুষের প্রাণে সৃষ্টি করেছে প্রবল জাগরণ, দিয়েছে অনুপ্রেরণা লড়াইয়ের ময়দানে অমিততেজে শত্রুকে নিধনে। তাই এতদিনের সৃষ্ট গানগুলো মানুষকে যেমন প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে একত্রে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, তেমনি যূথবদ্ধ লড়াইকে সামনে এগিয়ে নিতে সহায়তা করেছে। তিনি বলেন, এখনও অন্ধকার পুরোপুরি দূর হয়নি। তাই অন্ধকারের শক্তির বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নতুন করে ঘোষণা করছি আমরা। করোনার বাধা শেষে এমন একটি উৎসবে যোগ দিতে পেরে শিল্পীরাও বেশ উৎফুল্ল। চুয়াডাঙ্গার দর্শনার ‘আনন্দধাম’-এর শিল্পী অমিতোষ দাস বলছিলেন, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনুপ্রেরণার অন্যতম মূল একটা উৎস ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে রচিত গণসঙ্গীত। গণ জাগরণের এই সঙ্গীত রচনা ও পরিবেশনায় সেসময় অসামান্য অবদান যারা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন বাংলাদেশের বহু সঙ্গীত রচয়িতা, সুরকার-গীতিকার ও শিল্পী। সই সময়ের আবেগ আর উদ্দীপনার ঢেউ তখন স্পর্শ করেছিল প্রতিবেশী পশ্চিমবাংলার বহু মানুষকেও, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার সঙ্গীতজগতকেও ব্যাপকভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। ’৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধ রচিত হয়েছিল স্মরণীয় কিছু গান। আজ আমরা এখানে তা পরিবেশন করেছি। আমাদের খুব ভাল লেগেছে। এমন আয়োজন বাংলাদেশের মফঃস্বল শহরে হয় না। সেজন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। মেহেরপুর উদীচীর হারুন অর রশিদ বলছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উদ্দীপ্ত রেখেছিল যেসব দেশাত্মবোধক গান, সেইসব গানের বাণী আর সুরে যেমন ছিল সাহসের কথা, যুদ্ধ জয়ের সম্ভাবনার মন্ত্র, তেমনি ছিল দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য আকুতি। এসব গান সমানভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ রেখেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের এবং পাশাপাশি অবরুদ্ধ জনগণকে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই উত্তাল দিনগুলোতে প্রেরণার উৎস হিসাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রও। উৎসবে এসব গান হচ্ছে। নতুন প্রজন্ম এসব গান থেকে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ গড়ার অনুপ্রেরণা পাবে বলে মনে করেন তিনি।
×