ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মণীশ রায়

গল্প ॥ সন্ধ্যা

প্রকাশিত: ২৩:৪৮, ২৬ নভেম্বর ২০২১

গল্প ॥ সন্ধ্যা

কেমন ছেলে সুবল? জানতে চান? একেবারেই নিরীহ-গোবেচারা, সাতচরে রা কাড়ে না টাইপ। মাথা নিচু করে হাঁটে, গুরুজনরা সামনে পড়লে মাটির সঙ্গে মিশে যেতে চায় শ্রদ্ধা ও ভক্তির ভারে। তৃণা দপি সুনীচেনভাব প্রতি পদক্ষেপে। অথচ কেউ জানে না, বুকের তলায় ওরও বরুণার রুমালের মতন ভাঁজ করে রাখা রয়েছে এক গোপন প্রেয়সী। শুধু সে জানে, আর কেউ নয়। মেয়েটা সবার চেনা; পাশাপাশি তিন-চারটে গ্রামে বেশ পরিচিত সে; এসব স্থানের কারও কাছে নামটা বললেই হলো, যে-কেউ রবীন্দ্রনাথের ফটিকের মতন ‘ওই হোথা’ বলে অবলীলায় রাস্তা দেখিয়ে দেবে। তাতে কোন সন্দেহ নেই। সন্ধ্যাকে মোটেই সুন্দরী বলা যাবে না, তবু সামনা-সামনি হলে সহজেই অন্যের ভেতর যৌবনের উন্মাদনা ছড়িয়ে দিতে পারে। তাতেই মন মজেছে বেচারা সুবলের। যখনই চোখাচোখি হয়, একই সঙ্গে সুখ-দুঃখ জাগানিয়া উচ্ছ্বাসে-আনন্দে খলবল করে ওঠে মন। তিলক মাটির মতন গায়ের রঙের সঙ্গে উপচেপড়া এ রেশমি উচ্ছলতা মিশে গিয়ে এক অপরূপ সুগন্ধির জন্ম দেয় ওর ভেতর। তখন ন্যাতানো মন-টনও নিমিষে তাজা হয়ে ওঠে। খুব গোপনে চলে সুবল-সন্ধ্যার এ অভিসার। এ সময় গ্রামবাসীর কানে ভেসে আসে সুরেলা বাঁশির ধুন। লোকে ভাবে, নিতাইর পোলাটা পড়াশোনায় যেমন ভাল, বাঁশিতেও তেমনি। তবে এখনও গ্রামে-গঞ্জে যেসব মন দেয়া-নেয়ার কারবার হয়, সেগুলো বেশির ভাগ আড়ালে-আবডালে, বলতে গেলে লুকো-ছাপার ভেতরই ঘটে থাকে। ছায়ার মতন, বায়ুর মতন, স্বচ্ছ জলের ডানকিনি মাছের ঝাঁকের মতনÑ এমন ভাবে, যেন কেউ টের পেলেও ধরতে পারবে না। এমনি সদাসতর্ক হয়ে পথ চলতে হয় মনের সব গোপন কারবারিদের। অথচ রাস্তার ধারে লুঙ্গি তুলে চরচর করে মুতে দিলে বা খালের কোল ঘেঁষে যে বিশাল-বিপুল রেন্ট্রি কড়ই, সেটার শেকড়ে বসে চোখ বন্ধ করে ভরভর করে হেগে দিলেও কেউ কিছুই মনে করবে না। চোখের উপর এসব দৃশ্য হুমড়ি খেয়ে পড়লে গ্রামবাসী বড় জোর একখানা এলানো হাসি দেবে আকাশ-বাতাস মাতিয়ে। এটুকুনই। যত লজ্জা-শরম আর মান-ইজ্জতের সওয়াল-জওয়াব এসে ঘাড় মটকায় মন দেয়া-নেয়ার বেলায়। তখন দর্শকের বিবেক-বুদ্ধি সব উধাও, চোখ বড় বড় করে এক বুক ঈর্ষা নিয়ে আর্তনাদ করে উঠবে, সব গেল, সব শেষ। শ^শুরবাড়ি থেকে বছরে একবারই বাবার বাড়ি বেড়াতে আসে মেয়েটা; সুবলও বলতে গেলে এখন গ্রাম ছাড়া, ঢাকার জগন্নাথ কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র সে, চাইলেই যখন তখন আগের মতন আর গ্রামে আসতে পারে না। তবু বর্ষার শুরুতে মনটা কেমন আইঢাই করতে শুরু করে। হাজার অসুবিধা সত্ত্বেও একবার অন্তত আসা চাই এখানে; সন্ধ্যার সান্নিধ্য পেতে কেবলি উথালি-পাতালি করে মন। সুবল রোদতপ্ত আকাশের মতন টগবগ করে ফুটতে শুরু করে তখন, ঢাকার বাহারি বড় লোক মেয়েদের দেখে ভেতরে ভেতরে অবসন্ন সে। তাতানো শরীর ফুঁড়ে জ্বরের অনিয়ন্ত্রিত উত্তাপ ছড়িয়ে পড়তে চায় চার পাশে। অথচ যেই মাত্র সন্ধ্যার কাছে এসে বসলও মনি ভেতরটা চুপচাপ রকমের ঠা-া; সংগোপনে পুষেরা খাইচ্ছা-অনিচ্ছাগুলো অসহায়ের মতন খাবি খেতে থাকে, উন্মত্ত উন্মাদনাগুলো নিমিষে মায়ায় বদলে যায়। বাঁশির মাতোয়ারা জয়-জয়ন্তির সুরে থৈ-থৈ করতে শুরু করে ওদের ভাব-বিনিময়। ওদের নিয়মিত এ দেখা-সাক্ষাতের জায়গাটা বেশ মনোরম; অথচ আশপাশের সবার কাছে একদম অপরিচিত। পাতায়-পাতায়, ঘাসে-ঘাসে, ঝোপে-ঝাড়ে, গাছের ডালে কিংবা শিকড়ে বুনো এক ঝাঁঝ ভেসে বেড়ায়। একদ- দাঁড়ালেই শরীরে জাগে শিহরণ; মনের গহ্বর থেকে মরা বাসনার ঝরাপাতাগুলো কার নির্দেশে যেন সজীব হয়ে ধরা দেয়। বর্ষার ঘোলাজল ছুঁইয়ে বাঁশঝাড়ের পাতায় শিরশিরানি জাগিয়ে সেই দিশাহারা আনন্দ ঘুরে বেড়ায়, পা ঘেঁষে ছোটাছুটি করে বেজি আর ইঁদুর। চনমনে চড়ুই আর শালিকগুলো অদূরে ফুড়ৎ-ফুড়ৎ করে নির্ভয়ে। জায়গাটা নদীপাড়। প্রচ- গরমেও শীতল অন্ধকারে ডুব মেরে থাকে জায়গাটা। এখানে পারতপক্ষে কেউ পা রাখে না। জেলে নৌকাগুলো খুব একটা দাঁড়ায়ও না। কারণ এখানে জলের তোড় খুব বেশি; নৌকা তিষ্ঠাতে পারে না। ঘুরপাক খায় কেবল। একবার মৌমাছির চাক ভাঙতে একদল গ্রামবাসী এসেছিল নির্জন এ জায়গাটায়। কিন্তু বাঁশ ঝাড়টায় ধোঁয়া ছড়াবার আগেভাগেই কিভাবে যেন টের পেয়ে যায় হিং¯্র মধুমক্ষিকার দল। কোন রকমে জান হাতে নিয়ে বেঁচে ফিরে আসে সেখান থেকে। সেই থেকে চাউর হয়ে হয়ে যায়, এখানকার বাঁশ ঝাড়টায় কিছু একটা আছে, হয়তো জোড়াভূত-পেতœী, কে জানে স্বামী-স্ত্রী হয়ে দীর্ঘকাল থেকে বসবাস করছে কিনা এই ঝাড়ে! চোখে ধোঁয়া লাগায় এখন খেপেছে। এমনি নানা লোককথা ঝাড়টি ঘিরে; তাই কেউ এদিকে সাহস করে তাকায় না পর্যন্ত। এখানে বসে দুদ- জিরোবার কথা তো চিন্তার বাইরে। তবু সুবল বাঁশি বাজাতে এখানেই চলে আসে। বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই ওর। ছুটি পেলে কিংবা ছুটি নিয়ে ঠিকই ছুটে আসে গোপন প্রণয়ের টানে। ওর বাবা নিত্যানন্দ বসাক কীর্তনিয়া দলের পেশাদার বংশীবাদক ছিলেন এককালে। খুব নাম ডাক তার এ তল্লাটে। শীতের ভোর বেলায় রাধা-কৃষ্ণের বিরহগাঁথা তার আকুল বাঁশির করুণ সুরে শিউলি ফুল হয়ে টপটপ করে ঝরে পড়ত চার পাশে। মাইকে ছড়িয়ে যেত সে সুর। আধো ঘুম আধো জাগরণে মগ্ন দূরের-কাছের দর্শক-শ্রোতার চোখ ভিজে উঠত সেই আবেগে। সেই বাপের ছেলে সুবল। সে কি সন্ধ্যাকে ওর সুরে রাঙাবে না? বাঁশিটা মিশ্র পিলু হয়ে বাতাস আর ঢেউয়ের সঙ্গে কোলাকুলি করে চক্কর কাটছে এখন। সুরটা বংশানুক্রমে এখন ওরই দখলে; বাবা নেই, তবু সুরটুকু নানা রকম দৃশ্য হয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে ভরা গাঙে। এ সুর শুনেই সন্ধ্যা প্রেমে পড়ে ওর। ঢাকা থেকে এলেই ওদের নিবিড় প্রেম পাখনা মেলে। অথচ ক’দিন থেকেই সুবলের কানে আসছে ভিন্ন কথা। মাটি ফেলে সন্ধ্যাকে জীবন্ত কবর দিতে চাইছে এখানকার একদল স্বার্থপর মানুষ। এখানে বড় বড় মার্কেট আর অট্টালিকা তৈরি হবে। গ্রাম আর গ্রাম থাকবে না, হয়ে উঠবে শহর। সামান্য কিছু হাড়গিলা শরীর-স্বাস্থ্যের প্রতিবাদী তরুণের প্রতিবাদ করছে। সে-ও তাদের একজন। প্রতিবাদ করার আগে সন্ধ্যাকে সুবল ওর বাঁশি শুনিয়ে চলেছে। নদীপাড়ের কাশবনে দোল খাচ্ছে সেই সুর। সামনে দুর্গাপূজা। কে জানে সামনের বছর সুবল বাঁশির সুরে সন্ধ্যাকে আর মুগ্ধ করতে পারবে কিনা। নিজের অজান্তে একটা দীর্ঘশ্বাস চাপে সে।
×