ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সমস্যা সমাধানে বিআরটিএ অফিসে শনিবার জরুরী বৈঠক

পঞ্চাশ বছরেও আইনী রূপ না পাওয়ায় হাফ ভাড়া নিয়ে বিপত্তি

প্রকাশিত: ২৩:০৮, ২৬ নভেম্বর ২০২১

পঞ্চাশ বছরেও আইনী রূপ না পাওয়ায় হাফ ভাড়া নিয়ে বিপত্তি

আজাদ সুলায়মান ॥ স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরেও ছাত্রদের হাফ ভাড়ার বিষয়টি আইনী রূপ না পাওয়ায় বিপত্তি ঘটেই চলেছে। তেলের দাম বৃদ্ধির ইস্যুতে সর্বশেষ পরিবহন ভাড়া বেড়ে যাওয়ায় শিক্ষার্থীরা ফের হাফ ভাড়া ইস্যুতে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। হাফ ভাড়া নিয়ে ছাত্রদের অসন্তোষে আবারও রাজধানীতে ক্ষোভ বিক্ষোভ দেখা দেয়ায় নতুন করে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে এই জটিলতা নিরসনের। হাফ ভাড়ার বিষয়ে সরকারের নীতিগত সমর্থন থাকলেও আইনী ভিত্তি না থাকার দোহাই দিয়ে পরিবহন মালিকরাও জোট বেঁধেছেন তা অস্বীকার করার। যে কারণে থেমে থেমে প্রায়ই সময় সুযোগ বুঝে শিক্ষার্থীরা রাজপথে সরব হচ্ছেন। অথচ বর্তমানে পরিবহন মালিক সমিতি ও নীতিনির্ধারকরা দৃশ্যত সরকার সমর্থিত হলেও তারা নিজেদের স্বার্থে প্রায়ই সরকারকে বেকায়দায় ফেলার পরিস্থিতি সৃষ্টি করছেন। মালিক সমিতি বলছে, হাফ ভাড়া আইনে নেই- কাজেই এটা মানার সুযোগ নেই। মানতে হলে সরকারকে ভর্তুকি দিতে হবে। অন্যদিকে শিক্ষার্থী, রাজনীতিক ও সুশীল সমাজ বলছে, আইনে না থাকলেও হাফ ভাড়ার একটি ঐতিহাসিক ভিত্তি রয়েছে, যার রাজনৈতিক গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া বিশ্বের অনেক দেশেই সরকারী ও বেসরকারী গণপরিবহনগুলোতে শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ছাড় দেয়ার বিধান রয়েছে। তারপরও এই ইস্যুতে পরিবহন মালিক পক্ষ ও শিক্ষার্থীদের বিপরীতমুখী অবস্থানে পরিস্থিতি জটিল হওয়ার আগেই সরকার বিষয়টি বেশ গুরুত্বসহকারে সমাধানের উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিষয়ে আগামীকাল শনিবার বিআরটিএ-অফিসে জরুরী বৈঠক ডাকা হয়েছে যেখানে উপস্থিত থাকবেন সংশ্লিষ্ট সব সেক্টরের প্রতিনিধিরা। জানতে চাইলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, এ নিয়ে পরিবহন মালিকদের সঙ্গে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। তারা হাফ ভাড়ার বিষয়ে আইনী ভিত্তি না থাকার কথা জানালেও বিষয়টি নিয়ে আরও ফলপ্রসূ আলোচনার জন্য শনিবার জরুরী বৈঠক ডাকা হয়েছে। সেখানে মালিক শ্রমিক, পরিববহন বিশেষজ্ঞ, ছাত্রদের প্রতিনিধি, শিক্ষাবিদ ও অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকবেন। আশা করা যাচ্ছে এতে একটা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এদিকে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া ইস্যুতে চলমান সভা সমাবেশ ও বিক্ষোভকে কাজে লাগিয়ে কোন মহল যাতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে না পারে সেজন্য সতর্ক ও সংযত রয়েছে সরকার। একদিকে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দাবির প্রতি সরকারের সহানুভূতি ধৈর্য ও সংযম প্রদর্শন অন্যদিকে অশুভ শক্তির প্রতি কঠোর নজরদারিও রাখার নীতি অবলম্বন করেছে সরকার। একটি গোয়েন্দা সংস্থার নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ইস্যুটি পঞ্চাশ বছরের পুরানো হলেও সময় সুযোগ বুঝে মাঝে মাঝেই শিক্ষার্থীরা সক্রিয় ও আন্দোলনমুখী হয়ে ওঠেন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, নিজেদের প্রয়োজনের চেয়ে তৃতীয় পক্ষের ইন্ধনেই তারা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠেন। হাফ ভাড়া নিয়ে শিক্ষার্থীরা আবারও রাজপথে জোরালো আন্দোলনে নামার আগেই সরকার বেশ আন্তরিকভাবেই আলোচনা ও বৈঠকের উদ্যোগ নিয়েছে। এবার একটা ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আসতে পারে কিংবা দীর্ঘ পাঁচ দশকের এই পুরানো দাবির একটা সুরাহা হতে পারে বলে এমন ইঙ্গিত দিয়েছে গোয়েন্দা সূত্রগুলো। উল্লেখ্য চলতি মাসে তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়। বর্ধিত ভাড়ার মধ্যে কয়েক দিন ধরে শিক্ষার্থীরা দাবি জানাচ্ছেন তাদের জন্য অর্ধেক ভাড়া চালুর। রাজধানীর সায়েন্সল্যাব, ফার্মগেটসহ অন্যান্য এলাকায় এ দাবিতে বাস ভাংচুর করেছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের এ ধরনের আকস্মিক কর্মসূচীর প্রতি যথেষ্ট ধৈর্য ও সংযত থাকার কৌশল অবলম্বন করছে সরকার। কারণ এবার যাতে আর ২০১৮ সালের অপ্রীতিকর ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেদিকে যথেষ্ট সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। উল্লেখ্য, শিক্ষার্থীদের টানা ৯ দিন ধরে চলা ২০১৮ সালের আন্দোলনের পর প্রণয়ন হয়েছিল সড়ক পরিবহন আইন। কিন্তু সেখানেও ৯ দফার অন্যতম অর্ধেক ভাড়া বিষয়টির সুরাহা করা হয়নি। এ অবস্থায় চলতি মাসের শুরুতে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভাড়াবৃদ্ধির দাবিতে অঘোষিত ধর্মঘট পালন শুরু করেন বাস, ট্রাকসহ পণ্যবাহী যানবাহনের মালিকেরা। এ বিষয়ে বিআরটিএ পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে নতুন ভাড়া নির্ধারণ করে দেয় গত ৭ নবেম্বর। কিন্তু ওই বৈঠকেও শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার বিষয়ে কোন আলোচনা হয়নি। যে কারণে হাফ ভাড়া দেয়ায় বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থীকে মারধর করে বাস থেকে জোর করে নামিয়ে দেয়া হয়। এমনকি অর্ধেক ভাড়া নিয়ে তর্কাতর্কির জেরে রাজধানীর বদরুন্নেসা মহিলা কলেজের শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের হুমকি দেয়ার অভিযোগে একটি বাসের হেলপার ও চালককেও আটক করে র‌্যাব। এর আগে অভিযুক্ত হেলপার-চালকের গ্রেফতার ও হাফ ভাড়া নির্ধারণের দাবিতে ওই কলেজের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করে সরকারকে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেয়। অভিযুক্ত আটক হলেও তাদের মূল দাবি এখনো পূরণ হয়নি। এর আগে গত ১৫ নবেম্বর রাজধানীর আফতাবনগরে অবস্থিত ইম্পেরিয়াল কলেজের এক শিক্ষার্থী রাইদা পরিবহন-এর একটি বাসে ‘হাফ ভাড়া’ দিতে চাইলে কথা কাটাকাটি ও তর্কাতর্কি হয়। এক পর্যায়ে ওই শিক্ষার্থীকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বাস থেকে নামিয়ে দেয়া হয়। ওই ঘটনার জের ধরে রামপুরা ব্রিজে অবস্থান নেয় কলেজটির শিক্ষার্থীরা। তারা রাইদা পরিবহনের অন্তত ৫০টি বাস আটকে দেয়। ফলে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনায় বসতে বাধ্য হয় রাইদা কর্তৃপক্ষ। থানায় বসে চলা ওই আলোচনায় মালিকপক্ষ কথা দেয় ইম্পেরিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে হাফ ভাড়া নেয়া হবে। পরবর্তীকালে মহাখালীর তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা হাফ পাসের দাবিতে মাঠে নামে। তারা রাইদা পরিবহনের প্রতিটি বাসের গায়ে হাফ পাস আছে কথাটি লিখে দেয়। হাফ পাস নির্ধারণ দেশের সকল শিক্ষার্থীরই চাওয়া বলে মন্তব্য করেন স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইংরেজী বিভাগের ছাত্রী নুসরাত জাহান শতাব্দী। তিনি বলেন, এটা সরকার বা পরিবহন মালিকদের সহানুভূতি বা দয়া নয়। হাফ ভাড়া দেয়াটা শিক্ষার্থীদের অধিকার। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ- হাফ ভাড়া দিতে চাইলে হেলপারদের খারাপ আচরণের শিকার হতে হয়। নিজেদের আয় না থাকলেও পরিবহনে বাড়তি ভাড়া দিতে হিমশিম অবস্থা তাদের। শিক্ষার্থীরা জানান-পরিবহন মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করে ছাত্রদের হাফ পাস নিশ্চিত করতে হবে। শনিবারের মধ্যে এ বিষয়ে সুরাহা না হলে কঠোর আন্দোলনে যাবেন তারা। হাফ ভাড়ার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অন্যতম কান্ডারি রাশেদ খান মেনন বলেন, মূলত স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম ইস্যু ছিল ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া। যাতে ছিল হাফ ভাড়ার বিষয়টি। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার দাবিটি মেনে নিলেও কিন্তু দেশ স্বাধীনের পরও তা চলতে থাকে। কিন্তু মাঝে মাঝেই তা নিয়ে পরিবহন মালিক ও শিক্ষার্থীদের মতবিরোধ দেখা দেয় এবং পরি¯িস্থতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আসলে ছাত্রদের এ দাবি অযৌক্তিক। তা নিয়ে কোন মত বিরোধ বা সংশয় থাকার কথা নয়। এটা মানাই সরকার ও শিক্ষার্থী উভয়ের জন্যই কল্যাণকর। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবহন মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের অন্যতম শীর্ষ নীতি নির্ধাারক মো.ছাদিকুর রহমান হিরু দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, শিক্ষাথীদের এই দাবি অযৌক্তিক। কেননা বেসরকারী খাতের পরিবহনে হাফ ভাড়া নেয়া হলে মালিকের ক্ষতির বিষয়টি দেখবে কে ? এটা তো একটা ব্যবসা। ব্যবসার ভাগ যদি কাউকে ছেড়ে দিতে হয়- তাহলে হয় সরকারকে ভর্তুকি দিতে হকে নয় শিক্ষাথীদের অন্যভাবে তা পুষিয়ে দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের আমাদের কোন বিরোধ নেই। আমরাও তাদের দাবির প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ও শ্রদ্ধাশীল। তবে তা বাস্তবায়িত করতে হলে এমন একটা পদ্ধতি বা উপায় বের করতে হবে যাতে উভয়পক্ষেরই স্বার্থ রক্ষা হয়। কেননা হাফ ভাড়ার কোন আইন নাই। এটাকে হয় আইনী কাঠামোর আওতায় আনতে হবে নইলে সাবসিডি দিতে হবে। তিনি বলেন, সরকার থেকে যে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে তাতে বাসে হাফ পাস দিয়ে সেই লসই থেকে যায়। ঢাকায় পরিবহনে বেশিরভাগ যাত্রী নিজেদের ছাত্র পরিচয় দেয়, একটা বাসে যদি ১০ জন যাত্রীর ৯ জন ছাত্রের হাফ ভাড়া নেয়া হয় তাহলে লাভ থাকে কিভাবে। হাফ ভাড়া যুগ যুগ ধরে চলে আসায় এটা একটা প্রথায় রূপ নিয়েছে। এটাকে অস্বীকার করছে কেন মালিকপক্ষ এমন প্রশ্নের জবাবে ছাদিকুর রহমান হিরু বলেন- ট্রাডিশান বা প্রথা কথাটা সর্বক্ষেত্রে ঠিক নয়। শুধু সরকারী বাস অর্থাৎ বিআরটিসির বাসে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার প্রথা ছিল। আমরা পাকিস্তান আমলের শেষের দিকে এমনকি স্বাধীনতার পরও ছাত্র জীবনে বিআরটিসি বাসে অর্ধেক ভাড়া দিতাম। এটা পরবর্তীকালে বহুদিন চলেছে। এখন হয়তো বিআরটিসির সেই জনপ্রিয়তা বা প্রাধান্য নেই,হাফ ভাড়ার আওয়াজও নেই। বেসরকারী বাসে কোন যুক্তিতে হাফভাড়া দিতে বা নিতে হবে তা আমার বোধগম্য নয়। তবে দেখি শনিবারের বৈঠকে এ নিয়ে কিভাবে নিষ্পত্তি ঘটানো হয়। জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন- বাসে শিক্ষার্থীদের জন্য অর্ধেক ভাড়া টাস্কফোর্সের মাধ্যমে পর্যায়ক্রমে বা¯তবায়ন করা হবে। শিক্ষার্থীদের প্রতি বর্তমান সরকার যথেষ্ট সহানুভূতিশীল ও মানবিক।
×