
.
লোকসানের দোহাই দিয়ে আজ মঙ্গলবার থেকে বন্ধ করা হচ্ছে বিমানের বহুল আলোচিত নারিতা ফ্লাইট। দীর্ঘ বিরতি দিয়ে ফের চালুর মাত্র দেড় বছরের মাথায় এমন একটি প্রেস্টিজিয়াস রুট বন্ধ করায় চরম সমালোচনার মুখে পড়েছে বিমান।
হাজার হাজার জাপান প্রবাসীর প্রশ্ন- এভাবে যদি হঠকারী সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বন্ধই করে দেওয়া হয়, তাহলে চালুরই দরকার ছিল কি? লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে বন্ধ না করে বিমানের উচিত ছিল যেকোনো মূল্যে এটাকে হয় লাভজনক করা, নয়তো লোকসান কমিয়ে আনা। কিন্তু বিমান যেটা করছে সেটা মাথা ব্যথার যন্ত্রণায় মাথা কেটে ফেলার মতো অযৌক্তিক ও হঠকারী সিদ্বান্ত।
প্রবাসীদের ক্ষোভের কথা হচ্ছে- যেই মুহূর্তে প্রধান উপদেষ্টা জাপান সফরের সময় আগামী পাঁচ বছরে কমপক্ষে এক লাখ লোক জাপানে কর্মসংস্থানের উদোগ নিশ্চিত করেছন, ঠিক সে সময় নারিতার ফ্লাইট বন্ধ করার মানে কি ? এখন যদি লোকসানও হয়, বিপুল সম্ভাবনার সুযোগ তো খুব নিকটেই। তাহলে কেন এই সিদ্ধান্ত ?
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ড. সাফিকুর রহমান জুলাই থেকে নারিতা ফ্লাইট বন্ধের সিদ্ধান্ত বহাল রাখার কথাই নিশ্চিত করেছেন। বিমান ইতোমধ্যে ১ জুলাই থেকে আর কোন টিকেটও বিক্রি করেনি। কাজেই এটা নিশ্চিত বন্ধই হচেছ। তিনি জানান, প্রতি ফ্লাইটে বিমানের ৯৫ লাখ টাকা লোকসান হয়। এভাবে তো আর লোকসান দেওয়া উচিত নয়। সে কারণে আপাতত বন্ধ করার সিদ্বান্ত নিয়েছে বিমান পর্ষদ।
উল্লেখ্য, গত মে মাসে ঘোষণা দেওয়া হয় জাপানের নারিতায় ফ্লাইট পরিচালনা সাময়িকভাবে বন্ধের। তখন বলা হয় চলমান হজ ফ্লাইট, উড়োজাহাজের স্বল্পতা ও ব্যবসায়িক বাস্তবতায় আগামী ১ জুলাই থেকে ঢাকা-নারিতা-ঢাকা রুটে ফ্লাইট পরিচালনা স্থগিত রাখা হবে। বিজ্ঞপ্তির পর থেকে ৩৫ হাজারেরও বেশি জাপানপ্রবাসী বাংলাদেশির মন খারাপ। একাধারে তারা ক্ষুব্ধ ও মনঃক্ষণ্ণ।
দীর্ঘদিন স্থগিত থাকার পর ২০২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকা-নারিতা রুটে ফের ফ্লাইট চালু করেছিল বিমান। এর আগে ১৯৮০ সালের ২৫ মে প্রথমবারের মতো ঢাকা-নারিতা রুটে ফ্লাইট চালু করেছিল রাষ্ট্রায়ত্ত এ সংস্থা। পরে কয়েক দফা চালু ও বন্ধের মুখে পড়ে। ২০০৬ সালে রুটটি একবার বন্ধ করে দেওয়া হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে অনেক ঢাক ঢোল পিটিয়ে ফের চালু করা হয় নারিতা ফ্লাইট।
অত্যাধুনিক ড্রিমলাইনার ৭৮৭ দিয়ে ফ্লাইট চালু করায় বেশ সুনামও অর্জন করে বিমান। জাপান প্রবাসীদের মাঝেও দেখা দেয় বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা। কারণ তারা ঢাকা থেকে মাত্র ৬ ঘণ্টায় জাপান যেতে আসতে পারতেন। শুরুতে ফ্লাইটে যাত্রীর সংখ্যাও ছিল চোখে পড়ার মতো। লাভের সম্ভাবনাও উঁকি মেরেছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের পর থেকে সেটা পর্যায়ক্রমে নিম্নমুখী হতে থাকে। তারপর বিমান পর্ষদ গত মে মাসে সিদ্ধান্ত নেয় নারিতা রুট আগামী ১ জুলাই থেকে বন্ধ করা হবে।
বিমান এ ফ্লাইট বন্ধের কারণ দেখিয়েছে, ক্রমাগত লোকসানের মুখে ব্যবসায়িক বাস্তবতা, উড়োজাহাজ ও ক্রু স্বল্পতা। আর ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ২২৫টি ফ্ল্যাইটের মাধ্যমে ৮৪ হাজার ৬৭৪ যাত্রী ও ২৩৬৫ টন কার্গো পরিবহন করে বিমান। এতে কেবিন ফ্যাক্টর ছিল শতকরা ৬৯ ভাগ। এতে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে- ২১৫ কোটি ৫৮ লাখ টাকা। যা প্রতি ফ্লাইটে গড়ে ৯৫ লাখ ৮১ হাজার টাকা। বিমানের বিশ্লেষণে আরও বলা হয়েছে- নারিতায় সপ্তাহে দুটো ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়ে সেই ফ্লাইট দিয়ে ঢাকা মাস্কাট, ঢাকা দাম্মাম ও মদিনায় অতিরিক্ত ১টি করে ফ্লাইট চালালে লাভ হবে মাসিক ৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ এই একটি রুট বন্ধ করা হলে অন্য তিনটি রুটকে আরও লাভজনক করা সম্ভব হবে।
লোকসানের অজুহাত দেখিয়ে নারিতা ফ্লাইট বন্ধ করাটা কতটা যৌক্তিক জানতে চাইলে বিমানের সাবেক পর্ষদ সদস্য ও শীর্ষ এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদ বলেন, মাথা ব্যথা হলে তো চিকিৎসা দিতে হবে। বিমান তো সেটা না করে এখন মাথাই কেটে ফেলতে চাইছে। নারিতা রুট দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর দেশি বিদেশি স্টেকহোল্ডার ও প্রবাসীদের দাবির মুখেই অনেক আশা উদ্দীপনা নিয়ে চালু করা হয়। এবার লক্ষণও ভালো ছিল। কিন্তু মাত্র দেড় বছরের মাথায় বন্ধ করা দেয়াটা একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়।
এক প্রশ্নে কাজী ওয়াহিদ বলেন, আমরা বিগত ওয়ান ইলেভেনের সময় বোয়িং থেকে ব্র্যান্ড নিউ দশটি বিমান কিনেছিলাম। সেগুলো দিয়েই বিমান টিকে আছে। তারপর থেকে বিমান একটা প্লেনও কিনতে পারেনি। এমনকি একটা প্লেন লিজও নিতে পারেনি। পৃথিবীর অনেক এয়ারলাইন্সই প্রেস্টিজিয়াস রুট লোকসান দিয়ে হলেও চালু রাখে। একটা এয়ারলাইন্সও সব রুটেই শুধু লাভের আশায় ফ্লাইট চালায় না। দশটায় লাভ করবে দুটো লোকসান দেবে। এটাই তো নিয়ম। পৃথিবীর অনেক এয়ারলাইন্স লোকসান দিয়ে নিউইয়র্ক নারিতা ও অস্ট্রেলিয়ার মতো প্রেস্টিজিয়াস রুট চালু রাখে।
গত সপ্তাহে নারিতা থেকে ঢাকায় আসা ক’জন প্রবাসী জানালেন তাদের প্রচ- ক্ষোভের কথা। টোকিও প্রবাসী আলমাস প্রচ- ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, দুনিয়ার এয়ারলাইন্সগুলো নতুন নতুন রুট খোলে, আর বহর বাড়ায়, আর বিমান চলছে উল্টা পথে। দীর্ঘ ১৭ বছর পর ২০২৩ সালে যখন ঢাকা-নারিতা-ঢাকা রুটে সরাসরি ফ্লাইট চালু হয় তখন বলতে পারেন অনেকটা ঈদের চাঁদ হাতে পাওয়ার মতো খুশি হয়েছিলাম আমরা। কারণ এর আগে ট্রানজিট নিয়ে দেশে ফিরতে কোনো কোনো দেশের বিমানবন্দরে ২১ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতো। গত বছর সরাসরি ফ্লাইট চালুর পর আমরা মাত্র ৮ ঘণ্টায় দেশে ফিরতে পারতাম। সাময়িকভাবে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ হলে আমাদের সেই আগের ভোগান্তি পোহাতে হবে। রেমিটেন্স যোদ্ধা হিসেবে কি আমরা সরকারের কাছে সরাসরি এ ফ্লাইট চালু রাখার আশা করতে পারি না?
এদিকে ফ্লাইট বন্ধের ঘোষণার পর টোকিও প্রবাসীরা বেশ ক্ষুব্ধ হলেও তারা নতুন করে আশায় ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের জাপান সফরের সময় এ দাবি নিয়ে সুখবর পাবার। ‘নিক্কেই ফোরামের ‘ফিউচার অব এশিয়া’ সম্মেলন উপলক্ষে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের টোকিও সফর করেন। গত ৩০ মে জাপানে বাংলাদেশ দূতাবাসে স্থানীয় প্রবাসীদের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে প্রবাসীদের পক্ষ থেকে নারিতা রুটে ফ্লাইট চালু রাখার জন্য অনুরোধ জানিয়ে বলা হয়, সরাসরি ফ্লাইটটি জাপানগামী শিক্ষার্থী, কর্মজীবী ও ব্যবসায়ীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও প্রবাস-জীবনে গতি এসেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে শাক-সবজি, মাছসহ নানা পণ্য জাপানে পৌঁছানোর সুযোগ বাড়ায় বাণিজ্যিক লাভবানও হচ্ছিলেন প্রবাসীরা। তারা সরাসরি ফ্লাইট বন্ধ না করার অনুরোধ জানান। বক্তব্যে কেউ কেউ প্রধান উপদেষ্টার কাছ থেকে ফ্লাইটটি বন্ধ হচ্ছে না এমন ঘোষণা শুনতে চান। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টা বক্তব্যে ফ্লাইটটি অব্যাহত রাখার ব্যাপারে সরাসরি কোনো আশ্বাস দেননি। এতে উপস্থিত সবাই হতাশ হয়ে পড়েন।
এ বিষয়ে সম্প্রতি ঢাকায় বেড়াতে আসা টোকিও প্রবাসী হাসান মিয়া বলেন, কি কারণে সাময়িকভাবে বন্ধ হচ্ছে তা বোধগম্য নয়। এটা কী রাজনৈতিক নাকি অন্য কোনো কারণ তাও বোঝা যাচ্ছে না। ১৭ বছর বন্ধ থাকার পর আমরা যাকে ফ্যাসিস্ট সরকার বলি, তারা গত বছর সেটি চালু করল। অথচ আমাদের কাক্সিক্ষত সরকার এটি বন্ধ করছে। এটি আমাদের জন্য একটি ভয়াবহ দুর্বিষহ ও দুঃখজনক ঘটনা। ‘ঢাকা-নারিতা-ঢাকা রুটের যাত্রী চাহিদা প্রচুর। যতবার আমি দেশে গিয়েছি ততবারই ফ্লাইট ফুললি বুকড দেখেছি। এ রুটে শুধু বাংলাদেশি নয়, নেপালি যাত্রীরাও চলাচল করেন। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম সরকারকে ভর্তুকি দিতে হয। আমরা যারা রেমিটেন্স যোদ্ধা তাদের জন্য কি অল্পস্বল্প ভর্তুকি দিয়ে ফ্লাইটটি চালু রাখা যায় না। কারণ ট্রানজিট হয়ে গেলে কখনো কখনো ২১ ঘণ্টা বিমানবন্দরে বসে থাকতে হয়। সেজন্যই এত জোরালো দাবি আমাদের। আসলে বিমান যদি আন্তরিকভাবে দক্ষতার সঙ্গে চেষ্টা করত তাহলে লাভ না হলেও অন্তত ব্রেক ইভেন পয়েন্টেও এই রুট ধরে রাখতে পারত। বিমানের যারা চাকরি করেন তারা শুধু চাকরিই করেন। তারা বিমানের ভালোমন্দ কিছুরই ধার ধারেন না।
প্যানেল