
চীন সফর নিয়ে সোমবার গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর
বাংলাদেশের নতুন নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চীন মুখিয়ে আছে বলে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। সোমবার বিকালে বিএনপি চেয়ারপারসনের গুলশান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা জানান।
এক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে চীন আন্তরিকতার সঙ্গে মিয়ানমারকে রাজি করানোর চেষ্টা করছে বলে আমাদের জানায়। তিনি বলেন, বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফেরাতে চীনের মনোভাব ইতিবাচক। সেই সঙ্গে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখার বিষয়ে চীনের যথেষ্ট আগ্রহ রয়েছে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, বিএনপির প্রতিনিধি দলের চীন সফরকালে এক চীন নীতির প্রতি বিএনপির দৃঢ় অবস্থানের কথা জানানো হয়েছে। তিস্তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, দেশের প্রয়োজন জানানোর পর চীন এ বিষয়ে ইতিবাচকভাবে সাড়া দিয়েছে। তাই এ নিয়ে চীন ভবিষ্যতে কোনো প্রস্তাব দিলে ইতিবাচকভাবে দেখবে বিএনপি।
মির্জা ফখরুল বলেন, চীনের পলিসি ব্যুরোর সদস্য শি লি হংসং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে দেশটি সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পাশাপাশি দ্রুতই পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে নতুনভাবে দ্বিপক্ষীয় কার্যক্রম শুরু করার বিষয়ে চীন আশাবাদ ব্যক্ত করেছে। এছাড়া চীনা কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে দুই বছর মেয়াদি একটি রাজনৈতিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তাব দেওয়া হয়, যেটিকে বিএনপি ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করেছে।
লিখিত বক্তব্যে বিএনপি মহাসচিব বলেন, সম্প্রতি চীনা কমিউনিস্ট পার্টির আমন্ত্রণে বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল চীন সফরে গিয়েছিলেন। প্রতিনিধি দলে আমি মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়াও ছিলেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সেলিমা রহমান, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিহউল্লাহ, অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়া, জহির উদ্দিন স্বপন, মিডিয়া সেলের আহ্বায়ক মওদুদ হোসেন আলমগীর পাভেল ও চেয়ারপারসনের একান্ত সচিব এবিএম আবদুস সাত্তার। ফখরুল বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সফর বিনিময় চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একটি প্রতিষ্ঠিত ঐতিহ্য। এরই ধারাবাহিকতায় বিএনপির একটি প্রতিনিধি দল চীন সফর করেছেন। পাঁচ দিনব্যাপী এই সফরে আমরা চীনা কমিউনিস্ট পার্টি এবং চীন সরকারের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে মতবিনিময় করার সুযোগ পেয়েছি, যাদের মধ্যে ছিলেন- চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটিক্যাল ব্যুরোর সদস্য এবং ন্যাশনাল পিপলস কংগ্রেসের স্থায়ী কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান লি হংসং, সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিভাগের মন্ত্রী লিউ জিয়ানচাও, সিপিসি কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক বিভাগের ভাইস মিনিস্টার মিসেস সান হাইয়ান।
ফখরুল বলেন, বাংলাদেশ চীন কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তী সম্প্রতি উদ্যাপিত হয়েছে। এটা সেই ঐতিহাসিক সম্পর্ক, যা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের চীন সফরের মধ্য দিয়ে সূচিত হয়েছিল এবং পরবর্তীতে বেগম খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রিত্বকালে সফরের মাধ্যমে আরও ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। প্রতিটি বৈঠকে চীনা নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশ চীন সম্পর্ক উন্নয়নে এই দুই ব্যক্তিত্বের অবদান সসম্মানে ব্যক্ত করেছেন।
ফখরুল বলেন, চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে চীনের বিস্ময়কর উন্নতি ও আন্তর্জাতিক প্রবৃদ্ধি এবং তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিসিয়েটিভ’ এর ইতিবাচকতার কথা মর্যাদা ও সম্মানের সঙ্গে আমাদের পক্ষ থেকে ব্যক্ত করা হয়েছে। বৈঠকে বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে পরীক্ষিত বন্ধু রাষ্ট্র হিসেবে চীনের অবদান সমূহ আমাদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর ধারাবাহিকতায় আগামীতে ডিজিটাল প্রযুক্তি, সেমিকন্ডাক্টর, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, মেডিক্যাল ও স্বাস্থ্যসেবা, উচ্চশিক্ষা, যোগাযোগ, আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, এসএমই বিজনেস, ব্লু ইকোনমি উন্নততর প্রযুক্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে চীনের অধিকতর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানানো হয়েছে। চীনের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে ইতিবাচক অবস্থান সুস্পষ্টভাবে উল্লিখিত হয়েছে।
ফখরুল বলেন, চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে আমরা এর অধিকতর প্রায়োগিক দৃষ্টান্ত দেখার অপেক্ষায় রয়েছি, যাতে আমাদের মাঝে সাংস্কৃতিক ও সফর বিনিময়, প্রযুক্তি হস্তান্তরের মাধ্যমে সেটা আরও দৃঢ়তর হতে পারে। আমরা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা নাগরিকদের নিরাপদ এবং সম্মানজনক প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে চীনের অধিকতর এবং কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানিয়েছি।
ফখরুল বলেন, আমাদের পক্ষ থেকে পারস্পরিক মর্যাদা সমুন্নত রেখে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির ভাবনায় চীনকে এমন সহযোগিতার আহ্বান জানিয়েছি, যেখানে জনগণ এবং জনকল্যাণের অগ্রাধিকার যেন থাকে সর্বোচ্চ স্থানে। আঞ্চলিক ও ভূরাজনৈতিক পরিবর্তিত পরিস্থিতির বিবেচনায় নির্যাতিতদের পক্ষে তাদের অবস্থানকে আমরা সম্মানের সঙ্গে অভিনন্দিত করেছি।
মির্জা ফখরুল বলেন, চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভাইস মিনিস্টার সুং ওয়ে ডংয়ের সঙ্গে সফরের দ্বিতীয় দিনে আমরা পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে কথা বলেছি এবং বাংলাদেশের অবকাঠামো, পরিবেশ ও প্রযুক্তি উন্নয়নে তাদের সহযোগিতা বৃদ্ধির আহ্বান জানিয়েছি। বাংলাদেশে শ্রমশক্তির সক্ষমতা, উন্নত বিনিয়োগ পরিবেশ ও বিনিয়োগের নিরাপত্তার বিষয়টিও আমরা ইতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করেছি।
ফখরুল বলেন, বিগত ১৭ বছরের অনাকাক্সিক্ষত রাজনৈতিক বাস্তবতায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতিকে সহনীয় করতে আমরা ঋণ পরিশোধ সময়সীমা বৃদ্ধি, বিভিন্ন ফি পুনর্বিবেচনা এবং অনুদানের সম্ভাব্যতার বিষয়েও তাদের সহায়তা চেয়েছি। যেটা তারা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছেন। বাংলাদেশ-চীন ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল নির্মাণ, দেশের উত্তরাঞ্চলে উৎপাদিত কৃষিপণ্য সংরক্ষণ ও রপ্তানির সুযোগ বৃদ্ধির বাস্তব পদক্ষেপ, কুনমিংয়ে চারটি বিশেষায়িত হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসা সহজতর করা, চীন-বাংলাদেশের মাঝে স্থলপথে আন্তর্জাতিক যোগাযোগ স্থাপনের উদ্যোগসহ বিভিন্ন বিষয় আমাদের আলোচ্য সূচিতে ছিল, যা ইতিবাচকভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
ফখরুল বলেন, চীন কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে দুই বছর মেয়াদি রাজনৈতিক সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা আমরা ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছি। বেজিং থেকে আমরা সানজি প্রদেশের রাজধানী জিয়াং সফরে যাই, সেখানে আমরা বৈদ্যুতিক গাড়ি প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বি ওয়াই ডি পরিদর্শন করি, পাশাপাশি তাদের হাইটেক প্রযুক্তি পার্ক, জিয়াংটং বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শনও আমাদের সফরসূচিতে অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখানে প্রায় পঞ্চাশজন বাংলাদেশি ছাত্র অধ্যয়নরত রয়েছেন।
ফখরুল বলেন, সানঝি প্রদেশে কমিউনিস্ট পার্টির সেক্রেটারির সঙ্গে আমাদের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আমরা উচ্চশিক্ষা বিনিময় তাদের সঙ্গে গার্মেন্টস শিল্প স্থানান্তরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে বিবেচনায় রাখার প্রস্তাব বিবেচনা করার আহ্বান জানিয়েছি। সফরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্ব ছিল জিয়ান শহরতলীর একটি আদর্শ গ্রাম পরিদর্শন, যা গ্রামবাসীর সক্রিয় অংশগ্রহণে তাদের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিনোদন, কর্মসংস্থানের অপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি করেছে। একই সঙ্গে আমরা জিয়ান মহানগরীর একটি কমিউনিস্ট ইউনিট পরিদর্শন করি, যা স্বেচ্ছাশ্রম ও জনকল্যাণ শিক্ষার একটি সমন্বিত অনুপম উদাহরণ।
বিএনপি মহাসচিব বলেন, সার্বিকভাবে চীন সফরের মাধ্যমে আমরা দুই ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের বিদ্যমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও উন্নততর ও ঘনিষ্ঠতর করার সুযোগ পেয়েছি, যা আগামীতে আরও প্রতিষ্ঠিত হবে বলে আমরা আশাবাদী। এই সফর আয়োজনের উদ্যোক্তা হিসেবে চীনা কমিউনিস্ট পার্টি, ঢাকার চীনা দূতাবাস এবং আমন্ত্রণকারী চীন কমিউনিস্ট পার্টির আন্তর্জাতিক বিভাগকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, সেলিমা রহমান প্রমুখ।