ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ জুলাই ২০২৫, ১৭ আষাঢ় ১৪৩২

কালেভদ্রেও মিলছে না ইলিশ

দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে ইলিশের অভয়াশ্রম আন্ধারমানিক

মেজবাহউদ্দিন মাননু

প্রকাশিত: ০০:১১, ১ জুলাই ২০২৫

দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে  ইলিশের অভয়াশ্রম আন্ধারমানিক

.

ইলিশের অভয়াশ্রম আন্ধারমানিক নদী ভালো নেই। জোয়ারেও থাকে না স্রোতের ধারা। পলির আস্তরণে তলদেশ ভরাট হয়ে গেছে। দুই পাড় সংকুচিত হয়ে গেছে। দখল করা হয়েছে দুই  তীরের প্লাবন ভূমি। করা হয়েছে বাড়িঘর, পুকুর, মাছের ঘের। নির্মাণ করা হয়েছে দশের অধিক ইটভাঁটি। দূষণ চলছে সমানতালে। কলাপাড়া পৌরশহরের অধিকাংশ  বর্জ্য যাচ্ছে  নদীতে। মোহনায় নিজামপুরে জেগেছে ডুবোচর। এক কথায় ঐতিহ্যবাহী এককালের স্রোতস্বিনী এই নদীটি এখন সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছে। পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় সাগর মোহনা থেকে উজানে উঠে আসা এ নদীটি মিলেছে রাবনাবাদ চ্যানেলে।
৩৯ কিলোমিটার দীর্ঘ আন্ধারমানিক নদীর সঙ্গে সংযুক্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা নদী মেরে ফেলার কারণে এ নদীর অবস্থা ক্রমশ সংকটাপন্ন হয়ে পড়ে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি প্রবীণ ব্যক্তিত্ব আইয়ুব আলী হাওলাদার জানালেন, ৮০র দশকের প্রথম দিকে আন্ধারমানিকের সঙ্গে সংযুক্ত প্রায় ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ কচুপাত্রা নদীতে বাঁধ দেওয়ায় পানির প্রবাহ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এ নদীর পানির প্রবাহ বন্ধ হওয়ার প্রথম ও অন্যতম একটি কারণ কচুপাত্রার বাঁধ। এরপর আরেক শাখা নদী ১৫ কিমি দীর্ঘ আড়পাঙ্গাশিয়া প্রাকৃতিকভাবে ভরাট হয়ে দুই-তৃতীয়াংশ চাষের জমিতে পরিণত হয়েছে। এ দুই শাখা নদী দিয়ে জোয়ারের পানি বরগুনার পায়রা নদীতে পর্যন্ত গড়াত। একইভাবে নদীর সঙ্গে স্লুইস সংযুক্ত অসংখ্য খালে জোয়ারের পানি প্রবেশের পথও রুদ্ধ হয়ে গেছে। পানির প্রবাহ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হতে থাকে। সবশেষ ঘূর্ণিঝড় সিডরের সময় সৃষ্ট ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে সাগর মোহনায় নিজামপুরে বিরাট ডুবোচর জেগে ওঠে। পানির প্রবাহ চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এরপর থেকে দ্রুত পলির আস্তরণে নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যায়। অবস্থা এমন হয়েছে যে, ছোট ট্রলার পর্যন্ত   ভাটিতে চলাচলে সমস্যা হয়। এক সময় স্টিমার, দোতলা-একতলা লঞ্চ চলাচল করা নদীটি সংকটাপন্ন অবস্থায় পতিত হয়েছে। রাবনাবাদ থেকে কলাপাড়া পৌরশহর লঞ্চঘাট পর্যন্ত এখন দোতলা লঞ্চ চলাচল করতে পারছে। তাও সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়।
৮০’র দশকের পরে এই নদীর তীরের দুই পাড়ের শত একর প্লাবন ভূমিকে কাগজপত্রে চাষযোগ্য কৃষি জমি দেখিয়ে কথিত ভূমিহীনদের বন্দোবস্ত দেওয়া হয়। এই চক্র কাগজপত্রে নদীতীরের মালিকানা পেয়ে চুপচাপ থাকে। এরা দশ-বিশ বছর পর ওই জমি দখল করে পুকুর, মাছের ঘের থেকে শুরু করে বাড়িঘর তৈরি করেছে। আবার কেউ কেউ লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে হস্তান্তর করে দিয়েছে। প্রকৃতির বিরূপ আচরণের পাশাপাশি মানুষের দখলদারিত্ব নদীটিকে অস্তিত্ব সংকটে ফেলে দিয়েছে। এছাড়া এ নদীতে আট কিলোমিটারের মধ্যে দুইটি সেতু নির্মাণ করা হয়েছে। আরও একটি সেতুর নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। নদীঠিকে মেরে ফেলার এটিও একটি অন্যতম কারণ।
কলাপাড়া পৌরসভা এলাকায় পুরানো ফেরিঘাট থেকে বালিয়াতলী খেয়াঘাট পর্যন্ত ইটভাঁটিসহ অসংখ্য স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে। এই দখল প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া পৌরশহরের পুরান বাজার স্লুইসখাল থেকে প্রতিদিন মণকে মণ পলিথিন, প্লাস্টিকসহ বিভিন্ন ধরনের বর্জ্য আন্ধারমানিক নদীতে যাচ্ছে। পৌরবাসীর পারিবারিক বর্জ্য সব ভেতরের খাল থেকে নদীতে যায়। কাঁচাবাজার এলাকায় নদীতীরে পানির লেভেল বরাবর নিত্যকার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে। নদীটিকে যেন পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হচ্ছে।
এখন শুধু নামেই ইলিশের অভয়াশ্রম আন্ধারমানিক নদী। নেই  ইলিশের অস্তিত্ব।  সবশেষ কবে ইলিশ পেয়েছেন-এমন সঠিক তথ্য কোনো জেলে দিতে পারেননি। এখন বৈঠাচালিত ছোট নৌকায় বড়শি কিংবা চরে সূক্ষ্ম ফাঁসের জাল দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মাছের পোনা ধরতে দেখা যায় খন্ডলীন  জেলেদের।
নদীতীরের রহমতপুর গ্রামের বাসিন্দা মন্নাফ চৌকিদার (৬০) জানান, জীবনটাই তার কেটেছে আন্ধারমানিক নদীতে মাছ ধরে। ইলিশের পাশাপাশি অনেক মাছ ধরতেন। জীবিকার প্রয়োজন মেটাতেন। কিন্তু এখন আর ইলিশ নাই। ছয় বছর আগে ইলিশের জাল পাল্টে এখন বেহুন্দী জালে ছোট্ট মাছ ধরেন। একই দশা ফতেহুপুর গ্রামের হোসেন মুন্সী (৫০) ও নেছার মুন্সীর (৪৮)। দুই-এক বছরে আন্ধারমানিকে ইলিশ পেয়েছেন এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। মাছের সংকটে আন্ধারমানিকে ইলিশসহ বিভিন্ন মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা অন্তত ৩৫০ জেলে পরিবারকে উন্নয়ন সংস্থা একশন এইড বাংলাদেশ বিকল্প পেশায় পুনর্বাসনের লক্ষ্যে বহু আগে উদ্যোগ নেয়। এজন্য এসব দরিদ্র জেলেকে দাদনসহ বিভিন্ন সংস্থায় থাকা তাদের প্রায় ৬০ লাখ টাকার ঋণ পরিশোধ করে দেনামুক্ত করে দেয়। আন্ধারমানিকের ইলিশের আকালের এটি একটি উদাহরণ হয়ে আছে।
২০১১ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর আন্ধারমানিক নদীকে ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণা করা হয়। তখন ইলিশের বিচরণ ছিল এই নদীতে। অসংখ্য জেলের জীবিকার উৎস ছিল ইলিশ শিকার। এখন নদীটি একেবারে ইলিশশূন্য হয়ে গেছে।
মূলত এখন আন্ধারমানিকে ইলিশ মেলা স্বপ্নের মতো। জেলেসহ পরিবেশ সংগঠকদের শঙ্কা আন্ধারমানিক নদী ইলিশের অভয়াশ্রমের সুখ্যাতি হারাতে পারে। এজন্য প্রধান সমস্যা মনে করছেন নাব্য সংকট। পাশাপাশি দখল-দূষণ-ভরাটও বহুলাংশে দায়ী। পরিবেশ সংগঠক নজরুল ইসলাম এমন শঙ্কার কথা ব্যক্ত করেন।
বর্তমানে আন্ধারমানিকে বাস্তব অবস্থা নিরূপণে কাজ করে যাচ্ছে মৎস্য অধিদপ্তর। পটুয়াখালী জেলা মৎস্য কর্মকর্তা কামরুল ইসলাম জানান, আন্ধারমানিকের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। ইলিশের বিচরণসহ বর্তমান বাস্তবতা প্রতিবেদনসহকারে সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরা হবে।

×