
ছবি: সংগৃহীত।
আমাদের জীবনে এমন অনেক অদৃশ্য সামাজিক নিয়ম রয়েছে, যেগুলো আমরা প্রতিদিন অনুসরণ করি—প্রশ্ন না করেই। যদিও এসব নিয়ম সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে সাহায্য করে, তবুও কিছু নিয়ম চুপিসারে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য, আত্মমর্যাদা এবং ব্যক্তিগত সুখের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
বিশেষ করে নারীদের জন্য—যাঁরা একসঙ্গে ব্যক্তিগত ও পেশাগত ভূমিকা পালন করেন—এই সামাজিক প্রত্যাশাগুলো অনেক সময় ‘সঠিক কাজ’ করার নামে মানসিক চাপ এবং আবেগগত ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নিচে এমনই ৮টি আচরণ তুলে ধরা হলো, যেগুলো আপনি হয়তো সচেতনভাবে বুঝতেই পারছেন না, অথচ এগুলো আপনার সুখকে চুপিসারে গ্রাস করছে।
১. নিজের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে ভয় পাওয়া:
শিশু অবস্থায়ই শেখানো হয়—অন্যকে আগে রাখাই ভালো মানুষ হওয়ার লক্ষণ। বিশেষ করে নারীদের মধ্যে নিঃস্বার্থ আচরণকে প্রশংসিত করা হয়, আর নিজের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দিলে তা “স্বার্থপরতা” হিসেবে ধরা হয়। এই ধরণের সামাজিক শর্তাবলী মানুষকে ‘না’ বলতে নিরুৎসাহিত করে, যা একপর্যায়ে মানসিক ক্লান্তি বা বার্নআউটের দিকে ঠেলে দেয়।
২. সব সময় ব্যস্ত থাকার চাপ:
‘সবচেয়ে ব্যস্ত, সে-ই সবচেয়ে সফল’—এই চিন্তাধারায় সমাজ কর্মব্যস্ততাকে গর্বের বিষয় করে তুলেছে। এতে আত্মমূল্যায়ন শুধুই কাজের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, বিশ্রাম, সৃজনশীলতা বা মানসিক সুস্থতার জন্য কোনো জায়গা আর থাকে না।
৩. সাফল্য মানেই নির্দিষ্ট কিছু মাইলফলক:
স্নাতক হওয়া, বিয়ে, বাড়ি কেনা, সন্তান নেওয়া—এইসব ধাপকে জীবনের একমাত্র মানদণ্ড বানিয়ে ফেলা হয়েছে। কিন্তু যারা এই ধারার বাইরে জীবনযাপন করেন, তারা অনেক সময় ব্যর্থতা বোধে ভোগেন। এই চাপে ব্যক্তিগত উন্নয়ন ও আবেগীয় স্বাস্থ্য গুরুত্ব হারায়।
৪. নিজের দুর্বলতা লুকিয়ে রাখেন, যাতে ‘পরিপূর্ণ’ দেখান:
অনেক সংস্কৃতিতে আবেগ প্রকাশকে দুর্বলতা হিসেবে দেখা হয়। ফলে মানুষ নিজের কষ্টের কথা বলতে দ্বিধা বোধ করেন। এই সামাজিক আচরণ মানসিক সহনশীলতা গড়ে ওঠার পথে বাধা সৃষ্টি করে।
৫. আত্ম-সেবা মানেই ‘স্বার্থপরতা’—এই বিশ্বাস:
নিজের জন্য সময় নেওয়া মানেই গিল্টি ফিলিং। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে, যাঁদের সবসময় ‘যত্নশীল’ ভূমিকা পালনের প্রত্যাশা করা হয়। ফলে মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষার প্রয়োজনীয়তা সমাজে এখনো অনেকাংশে অগ্রাহ্য হয়।
৬. নিজের অর্জনকে খাটো করে দেখা:
বিভিন্ন সমাজে বিনয়কে এমনভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় যে মানুষ নিজেদের কৃতিত্বও লুকিয়ে রাখে। নিজের সফলতা প্রকাশ করলে তা অহংকার হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়। এই মনোভাব আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয় এবং সুখ প্রকাশে বাধা সৃষ্টি করে।
৭. সামাজিক মাধ্যমে নিজের জীবন ‘প্যাকেজ’ করে দেখানো:
সোশ্যাল মিডিয়ায় সৌন্দর্য, সফলতা ও জীবনধারার একটি নিখুঁত সংস্করণ উপস্থাপন করতে গিয়ে মানুষ এক ধরনের মানসিক চাপে পড়ে যান। এই তুলনামূলক মানসিকতা আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দেয় এবং প্রকৃত সুখকে বিলীন করে দেয়।
৮. অন্যের সহানুভূতি বা সহযোগিতা গ্রহণে অস্বস্তি:
অনেকেই অপরের সাহায্য নিতে বা ভালোবাসা গ্রহণ করতে সংকোচ বোধ করেন। মনে হয় যেন ‘ঋণ’ হয়ে গেলাম। এই মানসিকতা আবেগগত সংযোগে বাধা দেয় এবং মানুষকে একাকীত্বের দিকে ঠেলে দেয়।
এই অদৃশ্য সামাজিক চাপে আমাদের অনেকেই সুখী থাকার সুযোগ হারাচ্ছি—অজান্তেই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিজের প্রয়োজনকে মূল্য দেওয়া, মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া এবং আবেগ প্রকাশে দ্বিধা না করাই হতে পারে সুস্থ ও সুখী জীবনের মূল চাবিকাঠি। এখন সময় এসেছে এসব সামাজিক বোঝা প্রশ্ন করার এবং নিজের সুখকে গুরুত্ব দেওয়ার।
সূত্র: ব্রাইট সাইড।
মিরাজ খান