ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

সাধন চন্দ্র মজুমদার

টেকসই উন্নয়ন ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা

প্রকাশিত: ২১:১৭, ২৬ নভেম্বর ২০২১

টেকসই উন্নয়ন ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বের কারণেই জাতি খুঁজে পেয়েছে নতুন ঠিকানা, নতুন সভ্যতা। ’৭৫ পরবর্তী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার বিপন্ন দিনগুলোর কথা মনে হলে আজও চোখ বেয়ে আসে জল। রাজনৈতিক নানা ঘটনা পরিক্রমায় শেখ হাসিনা বিশ্ব নেতৃত্বের আসনে সমাসীন হয়েছেন। টানা তৃতীয় দফা তিনি বাংলাদেশের সরকারপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এনে দিয়েছেন অভূতপূর্ব সাফল্য। কি প্রক্রিয়ায় একটি দেশের টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা যায়, তার মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সামনে। টেকসই উন্নয়নের অন্যতম প্রধান শর্ত যে স্বয়ম্ভর নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা, তা তিনিই বুঝিয়ে দিয়েছেন। একটা জাতি খাদ্যে স্বয়ম্ভর না হলে প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়। শুধু খাদ্যের স্বয়ংসম্পূর্ণতা নয়, খাদ্য হতে হবে নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত। মানুষকে সুস্থ ও সবল হয়ে বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের পুষ্টিগুণ বজায় রাখা অপরিহার্য। সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষকে সেই পুষ্টিসম্মত খাবার গ্রহণ করতে হবে। উল্লেখ্য, সরু চাল, বড় মাছ, মাংস ও বিদেশী দামী ফলমূলের যে গুণ; ঠিক মোটা চাল, ছোট মাছ, দেশীয় কমদামী শাকসবজি, ফলমূলেরও একই গুণ। যারা নিম্ন আয়ের মানুষ, তারাও পুষ্টিগুণ বজায় রেখে খাবার গ্রহণ করতে পারে। এখানে ইচ্ছাটাই বড় কথা। মানুষকে সুস্থ ও সবল থাকতে হবে। জাতি যদি সুস্থ-সবল না হয়, সুস্থ সমাজ গঠনও সম্ভব নয়। সুস্থ সমাজ প্রতিষ্ঠিত না হলে টেকসই উন্নয়নের কথা ভাবা অবান্তর। বিশ্বে মহামারী করোনাকালে বিভিন্ন দেশেই খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে। বেঁচে থাকার অনন্ত সংগ্রামে মানুষ হিমশিম খাচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলায় অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছে। খাদ্যাভাবে কোথাও মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে এমন নজির নেই। খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলার পাশাপাশি এর পুষ্টিমান উন্নয়নেও সরকার কাজ করে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সরকার দেশের মানুষের জীবন ও জীবিকার ওপর সমান গুরুত্ব দিয়ে করোনাকালীন বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করে স্বস্তির পরিবেশ তৈরি করেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো পথেই হাঁটছেন আমাদের প্রিয় নেত্রী শেখ হাসিনা। আর তাই আমরা মানবাত্মার যথার্থ গৌরবের অংশীদার হতে পেরেছি। মানুষের হৃদয়ে কীভাবে পরহিতৈষী বা পরার্থপরতার ভাব জাগানো যায়, কিভাবে তার ভেতর ভালবাসা বাড়ানো যায়, কিভাবে মানুষের প্রতি মানুষের যথার্থ সহমর্মিতা গড়ে তোলা যায়, সেটিই চিন্তার বিষয়। এই চিন্তার আলোকেই সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। গৃহীত পদক্ষেপগুলো প্রশংসিতও হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। দরিদ্র, গৃহহীন মানুষের জন্যে আশ্রয়ণ প্রকল্প মানবতার অনুষজ্ঞ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। মানবিক উৎকর্ষ সাধিত না হলে চরিত্র পুনর্গঠন সম্ভব নয়। চারিত্রিক উন্নতি ছাড়া নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা হবে প্রশ্নবিদ্ধ। আমরা প্রায়ই খাদ্যে ভেজালের কথা শুনি। যারা খাদ্যে ভেজাল দেয় মনুষ্যত্বের বিচারে তারা কোনদিন মনুষ্য পদবাচ্যে উন্নীত হতে পারে না। ব্যাপক অর্থেবিত্তে বলীয়ান হলেও শেষ বিচারের ফল শূন্য। মানুষকে হতে হবে নীতিনিষ্ঠ। স্বামী বিবেকানন্দ বহুকাল আগেই আমাদের সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, পার্লামেন্টে আইন করে মানুষকে নীতিনিষ্ঠ করে তোলা যায় না। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে আমরা সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। নতুন নতুন আইন করে মানুষকে ভাল করার চেষ্টা করছি। এ আমাদের দুর্ভাগ্য। বলাবাহুল্য আমাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের একমাত্র উপায় নৈতিক শিক্ষা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই শিক্ষার ওপরই জোর দিয়েছেন। তিনি সেবা ও ত্যাগকে জাতীয় আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশিষ্ট সমাজতত্ত্ববিদ সোরেকিন (ঝড়ৎবড়শরহ) বলেছেন যে, একমাত্র মানুষের হৃদয়ে কিছু পরিমাণ পরমার্থপরতার ভাব সঞ্চারিত হলেই মানব সভ্যতা রক্ষা পেতে পারে। বাট্রান্ড রাসেল মন্তব্য করেছেন, যদি মানব সভ্যতাকে তার সমকালীন সঙ্কট ও নৈরাজ্য থেকে মুক্তি পেতে হয়, তবে মানুষকে তার হৃদয়ের ভালবাসার পরিমাণ বাড়াতে হবে। এসব দুর্যোগ মোকাবেলা করার সৎসাহস এ জাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। আজকাল গণমাধ্যমে প্রায়ই প্রকাশিত হচ্ছে যে, চালের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, আটার দাম বৃদ্ধি পেয়েছে, ভোজ্য তেলের দামও অনেক বেড়েছে। এসব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে কিছু মৌলিক কারণ থাকে। সেই কারণগুলো চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করছে সরকার। আবার অস্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্য কমে যাওয়ার পেছনেও কারণ থাকে। বিশেষত, চালের দাম কমে গেলে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রান্তিক কৃষক। যারা আমাদের অন্নদাতা তারা যদি ক্ষতির মুখে পড়ে, তবে তারা ধান চাষে নিরুৎসাহিত হবে। ধান চাষ কমে গেলে চালের চাহিদা মেটাবার জন্য আমদানি নির্ভর হতে হবে। আমদানি নির্ভরতা স্থায়ী সমাধান নয়। ধানের উৎপাদন খরচের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করেই চালের মূল্য নির্ধারিত হয়। কিছু ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম অস্বীকার করছি না। বর্তমানে চালের যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। তবে বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে অনেকগুণ। ঘটেছে মানুষের রুচির পরিবর্তন। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ফলেই এসব পরিবর্তন। কি গ্রাম, কি শহর সব মানুষের মধ্যে অভূতপূর্ব পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। সারা বাংলাদেশই আজ আলোকিত। শতভাগ বিদ্যুতায়ন হয়েছে। গ্রামে মাটির চুলার ব্যবহার নেই বললেই চলে। গ্রামের মানুষও এলজি গ্যাস ব্যবহার করে রান্নার কাজ সারছে। শহরের রীতিনীতি; সংস্কৃতিতে নব সভ্যতার সংযোজন ঘটেছে। তবে এটা ঠিক যে, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দ্বারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নতি ঘটিয়েও সৎ ও সুখী মানুষ সৃষ্টি করা যায় না। বড় জোর সৎ ও সুখী মানুষ সৃষ্টির পরিবেশ রচনায় সহায়তা করতে পারে। এ পরিবেশের আঙ্গিকে অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক পরিম-ল সম্পর্কে সচেতন হয়ে তাকে পরিপুষ্ট করে, তার অন্তর্লোকের উদ্বোধন ঘটিয়ে, আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্বে নিহিত অনন্ত শক্তির স্ফুরণ ঘটিয়েই মানুষ নৈতিকতাবোধকে জাগ্রত করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী অনন্ত করুণা ও সেবাভাবে ভাবিত হয়ে দেশ পরিচালনায় মনোনিবেশ করেছেন। তিনি অসীম ব্যক্তিত্বে রূপান্তরিত হয়েছেন। তিনি মানবিক মূল্যবোধের পূর্ণতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন। মানবিক মূল্যবোধের প্রকাশ হচ্ছে মানুষের জন্মগত অধিকার। এটি বোঝাতে তিনি সক্ষম হয়েছেন। একটা সময় আসবে মানুষকে নিজের ভার নিজেকেই নিতে হবে। তখন আর রাজনৈতিক পরিবেশের হাতে খেলার পুতুল হয়ে থাকবে না। জীবনের যত কিছু শক্তি সবই তাকে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের যে উন্নয়ন ঘটে চলেছে, তা সুনির্দিষ্ট কোন সময়, সীমারেখার মধ্যে আবদ্ধ নয়। আধুনিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে মানুষের একটি মর্যাদাপূর্ণ ভাবমূর্তি গড়ে উঠেছে। বিগত ১২ বছরের বেশি সময় ধরে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে বর্তমান সরকার চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাতে সরকার অনেকটাই সফল হয়েছে। আমরা যতই লক্ষ্যের দিকে এগুবো ততই শক্তির দ্বিতীয় উপাদানটি জাতির ধমনীতে অমিত শক্তির সঞ্চার করবে। এই দ্বিতীয় উপাদানটি হচ্ছে রাজনৈতিক চেতনা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারার সূচনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের মধ্যে মানবিক বিকাশের কাজটিকেও এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে নাগরিকদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অসামান্য মূল্য সম্পর্কে শিক্ষিত করে তোলার চেষ্টা করছেন। সবগুলো সূচকের বিকাশমান চরিত্র ঠিক থাকলে টেকসই উন্নয়নসহ নিরাপদ খাদ্যের নিরাপত্তাও নিশ্চিত হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কেবল বাংলাদেশ নয়, সমগ্র পৃথিবীতে স্থিতিশীল খাদ্য ব্যবস্থার ওপর জোর দিয়েছেন। জাতিসংঘের সদ্যসমাপ্ত সম্মেলনের একটা গুরুত্ব¡পূর্ণ ইভেন্ট ‘ফুড সিস্টেম সামিট-২০২১’ এ ভার্চুয়াল ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য অধিক খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী একটি স্থিতিশীল খাদ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন; একই সঙ্গে তিনি একটি বৈশ্বিক জোট ও অংশীদারিত্ব গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতার মাধ্যমে খাদ্যের অপচয় হ্রাসের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেন। তিনি বলেছেন, ‘পর্যাপ্ত খাবার পাওয়ার অধিকার একটি মৌলিক অধিকার; যা বিশ্বের সকল নাগরিকের কল্যাণ ও স্বাস্থ্যের সঙ্গে যুক্ত।’ বৈশ্বিক ব্যবস্থায় সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত প্রভাবে সুষম খাদ্যের ভূমিকা অপরিসীম। সামিটে বক্তৃতাকালে প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করনে যে, ‘খাদ্য নিরাপত্তা জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে আন্তঃসংযুক্ত। পূর্ব রেকর্ডকৃত বক্তৃতায় ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক জনসংখ্যা ১০ বিলিয়ন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এই’ অতিরিক্ত জনসংখ্যার জন্য আরও খাদ্য উৎপাদন করা অপরিহার্য। তিনি খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতে কৃষি উন্নয়নের জন্য গবেষণা, বিনিয়োগ ও উন্নত প্রযুক্তি বিনিময়ের ওপর জোর দিয়েছেন। টেকসই খাদ্য ব্যবস্থা অর্জনের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বর্ধিত তহবিল প্রয়োজন। আমাদের মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বল্প সময়ে একটি সংবিধান প্রণয়ন করেছেন। সেই সংবিধানের মহৎ একটি আদর্শ হচ্ছে, পর্যাপ্ত পুষ্টিমান সমৃদ্ধ খাদ্যের নিশ্চয়তা। মূলত সেই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খাদ্য নিরাপত্তায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। সেই উদ্যোগের ফলে খাদ্য ঘাটতির দেশ থেকে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। আমরা দীর্ঘমেয়াদী খাদ্য নিরাপত্তার জন্যে কাজ করে যাচ্ছি। লেখক : এমপি ও খাদ্যমন্ত্রী
×