ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

সাম্প্রদায়িক হামলায় ৬ দিন পর চুলায় রান্না চড়িয়েছেন রংপুরের হিন্দুপল্লীর মানুষ

স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে মাঝিপাড়ার বাসিন্দারা

প্রকাশিত: ১৮:০৬, ২৩ অক্টোবর ২০২১

স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছে মাঝিপাড়ার বাসিন্দারা

নিজস্ব সংবাদদাতা, রংপুর ॥ রংপুরের পীরগঞ্জে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনা-পরবর্তী মাঝিপাড়ার বাসিন্দারা স্বাভাবিক জীবনে ফিরেছেন। এখন মাঝিপাড়ায় আতঙ্ক নেই। ক্ষতিগ্রস্থদের মধ্যে আর কোনো ভয়ভীতি নেই। সবাই বাড়ি ফিরেছেন। নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন। নতুন টিনে নতুন ঘর তৈরির কাজ শেষ। সবার মুখে হাসি ফিরেছে। পীরগঞ্জে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে এ কথা বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান। শনিবার (২৩ অক্টোবর) দুপুরে উপজেলার রামনাথপুরম ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্থ বড়করিমপুর মাঝিপাড়া গ্রাম পরিদর্শন করেন প্রতিমন্ত্রী। পরে সেখানকার বটেরহাট আরডিএস দাখিল মাদরাসা মাঠে জেলা প্রশাসন আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন তিনি। ডা. এনামুর রহমান বলেন, সরকারি ও বেসরকারি নানা সংগঠনের সহযোগিতা ও ভালোবাসায় ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলো এখন স্বাভাবিক। তাদের চুলায় এখন রান্না হচ্ছে। কাজকর্মেও যোগ দিয়েছেন তারা। এ পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্থ ৬৬টি পরিবারের মাঝে প্রায় ৬৫ লাখ টাকাসহ খাদ্য ও বস্ত্র সহযোগিতা করা হয়েছে বলে জানিয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, অগ্নিসংযোগের ঘটনায় ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্থ ১৪টি ঘর নির্মাণ এবং ৪০টি ঘর মেরামত করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারগুলোর মাঝে সরকারের পক্ষ থেকে ১৬৬টি শাড়ি, ২৬৬টি লুঙ্গি, ১৬৬টি কম্বল, ৪০০ শুকনা খাবার প্যাকেট, ২৫ প্যাকেট গোখাদ্য, ৪০ প্যাকেট শিশুখাদ্য, ১০০ বান্ডিল টিন এবং নগদ ২৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এ ছাড়া জীবিকা নির্বাহের জন্য ১৫ জেলেকে মাছ ধরার জাল প্রদান করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারের ৪০ জন শিক্ষার্থীর জন্য ৪০ সেট নতুন বই এবং ন্যাশনাল আইডি কার্ডের ১৬টি সার্টিফাইট কপি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে নিয়মিতভাবে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে জানান তিনি। এদিকে জেলা প্রশাসনের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবারদের মাঝে বেসরকারি সংস্থা রেড ক্রিসেন্ট, বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন, আরডিআরএসের পক্ষ থেকে মোট ৩৪ লাখ ৩৫ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্থ পরিবার এবং দুটি মন্দিরের মধ্যে জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে ১১ লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতার এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক), রংপুরকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। হামলার ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিনটি মামলা হয়েছে এবং ৫৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। ঘটনার পর থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগসহ পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে এবং ঘটনাস্থলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বর্তমানে স্বাভাবিক রয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়েছে, ঘটনার পর ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা পরিদর্শন করেছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ও রংপুর-৬ (পীরগঞ্চ) আসনের সংসদ সদস্য শিরীন শারমিন চৌধুরী, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ এবং দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসচিব মো. মোহসীন, রংপুরের জেলা প্রশাসক আসিব আহসান, জেলা পুলিশ সুপার বিপ্লব কুমার সরকার, পীরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র তানজিমুল ইসলাম শামীমসহ উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। ত্রাণ ও দুর্যোগ প্রতিমন্ত্রী এনামুর রহমান শনিবার বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পীরগঞ্জে হিন্দুপল্লী পরিদর্শনে গিয়ে সেখানে ক্ষতিগ্রস্থদের খোঁজখবর নেন। পরে পুষ্প রানী নামের একজনের বাড়িতে গিয়ে তার চুলায় রান্নার হাঁড়ি তুলে দেন। এ সময় প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে জেলা প্রশাসক আসিব আহসানসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন, ৬১ পরিবারকে ১০১ বান্ডেল ঢেউটিন দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া নগদ অর্থের পাশাপাশি দেয়া হয়েছে খাবার, দুটি কম্বল ও শাড়ি-লুঙ্গি। ক্ষতিগ্রস্থদের সার্বক্ষণিক খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা। পুষ্প রানী বলেন, ‘এত দিন তো মন্দিরে রান্নাবান্না করেছি। সেখানেই খেয়েছি। আজ সবাই বাড়ি বাড়ি রান্না করছি।’ ভট্টু চন্দ্র বলেন, ‘শুকুরবার সন্ধের আগে মাইকিন (মাইকিং) করে বলচে, বাড়ি বাড়ি পাক করতে। আজ আমরা পাক করছি।’ মহাদেব চন্দ্র বলেন, ‘সংসার করি খাইতে যা কিছু নাগে সমস্ত কিচু সরকার দিচে। পাক করতে সমস্যা কী। টিওনও (ইউএনও) স্যার কইচে সোগ (সব) তো দিচি, পাক করি খাও। এলা সমস্যা নাই, তাই আইজ পাক করতে কইচি বাড়ি ওয়ালাক (স্ত্রী)।’ আরেক ক্ষতিগ্রস্থ কুসুম বালা বলেন, আইজ একনা শান্তি নাগচে। বাড়িত চুলা জ্বালাইচি। সবাই মিলি খামো। এত দিন তো ওত্তি খাচি, ভয় নাগছিল, এলা ভয়টয় নাই।
×