ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

একযুগে আরেকটি স্বপ্নপূরণ

প্রকাশিত: ২৩:৪৫, ২০ অক্টোবর ২০২১

একযুগে আরেকটি স্বপ্নপূরণ

এম শাহজাহান ॥ ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ ব্র্যান্ড পৃথিবীর সব দেশে ছড়িয়ে দিতে একযুগ চেষ্টার পর অবশেষে বিশ্বমানের একটি স্থায়ী ‘পণ্য প্রদর্শনী কেন্দ্র’ তৈরি সম্পন্ন হয়েছে। এতে পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেলের মতো দেশের আরেকটি স্বপ্নপূরণ হলো। এবার পুরোদমে চালু হওয়ার পালা। আলোচিত ও কাক্সিক্ষত এই প্রদর্শনীটির নাম দেয়া হয়েছে-‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশীপ এক্সিবিশন সেন্টার (বিবিসিএফইসি)। সরকারের এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের ফলে বাংলাদেশের রফতানিখাতে নতুন যুগের সূচনা হলো বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আগামীকাল বৃহস্পতিবার গণভবন থেকে সকাল দশটায় ভার্চুয়ালি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক্সিবিশন সেন্টারটির আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করবেন। মহামারী করোনা কমে আসায় আগামী ১ জানুয়ারি থেকে মাসব্যাপী ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা এই প্রদর্শনীতে করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শুধু বাণিজ্য মেলা নয়, সারাবছর বাংলাদেশে তৈরি যেকোন পণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রি কার্যক্রম করা যাবে স্থায়ী এই এক্সিবিশন সেন্টারে। এমনকি বিদেশীরাও তাদের কোম্পানির উৎপাদিত ব্র্যান্ড বছরের যেকোন সময়ে এই এক্সিবিশন সেন্টারে প্রদর্শনীর সুযোগ পাবেন। জানা গেছে, পৃথিবীর ১৯০টি দেশে বাংলাদেশে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী রফতানি করা হচ্ছে। তৈরি পোশাক, চামড়া, ওষুধ, মৎস্য, জাহাজ, ইলেক্ট্রনিক্স এবং আইটিখাতের সফটওয়্যারসহ কয়েক হাজার পণ্য রফতানি হয় বিভিন্ন দেশে। রফতানিখাতে শক্তিশালী বাজারের তালিকায় এখন বাংলাদেশের নাম উঠে এসেছে। কিন্তু পণ্য রফতানিতে আমদানিকারক দেশের প্রতিনিধি কিংবা ক্রেতাদের উৎপাদিত পণ্য দেখানোর জন্য এতদিন কোন স্থায়ী প্রদর্শনী কেন্দ্র ছিল না। এ অবস্থায় সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ও দুবাইসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিদেশী ক্রেতাদের সঙ্গে উদ্যোক্তারা নিয়মিত বৈঠক করে ক্রয়াদেশ এনে থাকেন। স্থায়ী প্রদর্শনী কেন্দ্র হওয়ায় বিদেশীরা বাংলাদেশমুখী হবেন। ক্রেতাদের চাহিদা ও পছন্দমতো পণ্য প্রদর্শনী করা যাবে। এ প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি জনকণ্ঠকে বলেন, এক্সিবিশন সেন্টার না থাকার কারণে বছরব্যাপী নিজস্ব রফতানি পণ্যের কোন প্রদর্শনী কেন্দ্র ছিল না। এখন নিজস্ব রফতানি পণ্য প্রদর্শন করার সুযোগ হলো। এতে করে বিদেশী ক্রেতারা এদেশে এসে পছন্দ মতো পণ্যের ক্রয়াদেশ দিতে পারবেন। শুধু তাই নয়, উদ্যোক্তারা নতুন নতুন পণ্যসামগ্রী উৎপাদন ও প্রদর্শনীর আয়োজন করে বিদেশী ক্রেতা ও অতিথিদের আমন্ত্রণ করে বাংলাদেশে নিয়ে আসতে পারবেন। এতে করে দেশের রফতানি বাণিজ্য বাড়বে। শক্তিশালী হবে অর্থনীতি। সংশ্লিষ্টদের মতে, বিশ্বের হাতেগোনা কয়েকটি দেশে মাত্র এ ধরনের স্থায়ী প্রদর্শনী কেন্দ্র রয়েছে। বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। এতে করে বিদেশী উদ্যোক্তা, ক্রেতা ও বিনিয়োগকারীদের কাছে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। আগামী ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশ এলডিসি বা স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়শীল দেশে উন্নীত হচ্ছে। এরপর স্থায়ী টেকসই উন্নয়ন, দারিদ্র্য শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনা এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্রের স্বপ্ন পূরণের মতো লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে সরকারের সামনে। এলডিসি উত্তরণে পণ্য রফতানিতে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ আসলেও তা মোকাবেলা করে রফতানি বাড়াতে হবে। মেইড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ছড়িয়ে দিতে হবে সারাবিশ্বে। এ সংক্রান্ত একটি বৈঠকে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, মেইড ইন বাংলাদেশ ব্র্যান্ড সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য এই এক্সিবিশন সেন্টার গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে সক্ষম হবে। শুধু বাণিজ্য মেলা নয়, সারাবছর এখানে বিভিন্ন ধরনের পণ্য প্রদর্শনী ও বাণিজ্য মেলা অনুষ্ঠিত হবে। এতে করে রফতানি পণ্যের বাজার আরও বাড়বে। তিনি বলেন, উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেরও দুটো গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে এর একটি হলো বিবিসিএফইসি সেন্টারটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধন করছেন। দ্বিতীয়ত সেন্টারটি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে নামকরণ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, স্থায়ী এক্সিবিশন সেন্টারটির নির্মাণ কাজ শেষে বছরের শুরুতে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করে চীনা কর্তৃপক্ষ। ওই সময় ‘চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ এক্সিবিশন সেন্টার’ নামে স্থায়ী কমপ্লেক্সের হন্তান্তর পত্রে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাক্ষর করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি ও চীনের পক্ষে স্বাক্ষর করেন ঢাকায় নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। স্থায়ী এই কমপ্লেক্সে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার পাশাপাশি সারাবছরই যাতে দেশী-বিদেশী কোম্পানিগুলো তাদের পণ্যসামগ্রী নিয়ে মেলা আয়োজন করতে পারে সেই ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। বিদেশী ক্রেতারা এখানে এসে পছন্দ মতো পণ্য কেনার ক্রয়াদেশ করতে পারবেন। স্বপ্নপূরণ ॥ এক্সিবিশন সেন্টারটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হওয়ায় দীর্ঘ একযুগ চেষ্টার পর যেন দেশের আরেকটি স্বপ্নপূরণ হলো। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণের পরই ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা স্থায়ী কমপ্লেক্সে নিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরে এই প্রকল্পের সহযোগিতার হাত বাড়ায় চীন। বাংলাদেশ ও চীনের যৌথ উদ্যোগে অবশেষে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের পূর্বাচল নতুন শহরে বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশীপ এক্সিবিশন সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাণিজ্যমেলার স্থায়ী কমপ্লেক্স হওয়া আরেকটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন। গত ২৫ বছর ধরে রাজধানীর ঢাকার ব্যস্ততম এলাকা আগারগাঁওয়ের শেরে-বাংলা নগরে প্রতিবছরের ১ থেকে ৩১ জানুয়ারি মাসব্যাপী মেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছিল। এতে করে সেই সময় ওই এলাকায় তীব্র যানজট তৈরি হয়ে পুরো ঢাকা শহর চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়ত। এছাড়া ব্যবসায়ীদের প্রতিবছর লাখ লাখ টাকা খরচ করে প্যাভিলিয়ন ও স্টোর নির্মাণ করতে হতো। অস্থায়ী কমপ্লেক্স হওয়ায় সেখানে বছরের অন্য কোন সময় পণ্যসামগ্রী প্রদর্শন বা বিক্রি করা সম্ভব হতো না। কিন্তু স্থায়ী কমপ্লেক্স হওয়ায় এসব সমস্যা দূর হবে বলে মনে করা হচ্ছে। দর্শনার্থী ও ক্রেতারাও এখন থেকে স্বাচ্ছন্দ্যে কেনাকাটা করে বাসায় ফিরতে পারবেন। এজন্য মেলাকালীন সময়ে ঢাকার প্রধান প্রধান সড়ক থেকে পূর্বাচল পর্যন্ত যাওয়ার বিশেষ পরিবহন সার্ভিস চালু করার চিন্তাভাবনা করে রেখেছে ইপিবি। পূর্বাচল ৪ নম্বর সেক্টরে ২০ একর জমির ওপর ২০১৭ সালের ১৭ অক্টোবর মেলার অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করে চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করপোরেশন। গত বছর ৩০ নবেম্বর নির্মাণ কাজ শেষ করার ঘোষণা দেয় তারা। চায়না-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশীপ এক্সিবিশন সেন্টার’ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ৩০৩.৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে চীনের অনুদান ৬২৫.৭০ কোটি টাকা। চায়না স্টেট কনস্ট্রাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন এ এক্সিবিশন সেন্টারটি নির্মাণ করে। ৩৩ হাজার বর্গমিটারে ফ্লোর স্পেসের মধ্যে বিল্ডিং নির্মাণ করা হয়েছে ২৪,৩৭০ বর্গ মিটার, এক্সিবিশন হলের আয়তন ১৫,৪১৮ বর্গ মিটার, এতে ৮০০টি স্টল রয়েছে। দোতলা পার্কিং বিল্ডিংয়ের পার্কিং স্পেস ৭,৯১২ বর্গ মিটার, গাড়ি পার্কিং করা যাবে ৫০০টি। এছাড়া এক্সিবিশন বিল্ডিংয়ের সামনে খোলা জায়গায় আরও ১,০০০টি গাড়ি পার্কিং করার সুযোগ রয়েছে। ৪৭৩ আসন বিশিষ্ট ১টি মাল্টি ফাংশনাল হলো, ৫০ আসন বিশিষ্ট একটি কনফারেন্স রুম, ৬টি নেগোশিয়েশন মিটিং রুম, ৫০০ আসন বিশিষ্ট রেস্টুরেন্ট, শিশুদের খেলার স্পেস, নামাজের রুম, ২টি অফিস রুম, মেডিক্যাল বুথ, ডরমেটরি- গেস্ট রুম, ১৩৯টি টয়লেট, বিল্ট ইন পাবলিক এড্রেস সিস্টিম, নিজস্ব ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্যান্ট, স্টোর রুম, সিএটিভি কন্ট্রোল রুম, অটোমেটেড সেন্ট্রাল এসি সিস্টেম, ইনবিল্ট ইন্টারনেট-ওয়াইফাই, আধুনিক অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা, আলাদা রেজিস্ট্র্রেশন হলো, আধুনিক ফোয়ারা, ইন বিল্ট পতাকা স্ট্যান্ড এবং রিমোট কন্ট্রোল-ইলেক্ট্রনিক প্রবেশ গেট রয়েছে।
×