বাবু ইসলাম, সিরাজগঞ্জ ॥ প্রমত্তা যমুনা ! প্রলয়ঙ্করী যমুনা ! কখনও স্রোতস্বিনী, আবার কখনও বা স্থির, শান্ত যমুনা। এমন নানারূপেই যমুনাকে দেখা যায়। এই যমুনা নদী সিরাজগঞ্জের মানুষের জন্য এক সময় ‘দুঃখ’ ছিল। যেমনটি ছিল চীনের দুঃখ হুয়াংহো নদী। এখন সেই যমুনা অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশাল অবদান রাখছে। যমুনাপাড়েই গড়ে উঠেছে নানা উন্নয়ন কর্মকাÐের অবকাঠামো, যা জাতীয় প্রবৃদ্ধিতে বড় ভ‚মিকা রাখছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় যমুনাকে শাসন করে বশে আনার ফলে বিধ্বংসী যমুনা সিরাজগঞ্জের সামগ্রিক উন্নয়নে আশীর্বাদ হয়ে উঠেছে, কল্যাণ বয়ে এনেছে। পর্যটকদের আকর্ষণের জন্যও যমুনারপাড়ে ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা’ বইয়ের আদলে নির্মাণ করা হয়েছে ম্যুরালসহ নানা স্থাপনা।
যমুনা অপ্রতিরোধ্য নদী নামে পরিচিত। বাংলাদেশের প্রধান তিনটি নদীর মধ্যে এটি একটি। এটি ব্রহ্মপুত্র নদীর প্রধান শাখা। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে (পাউবো) যমুনা নদীর পরিচিতি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদী। যমুনা গোয়ালন্দের কাছে পদ্মা নদীর সঙ্গে মিশেছে। ১৭৮৭ সালে ভ‚মিকম্পে এই যমুনা নদীর সৃষ্টি হয়। ষাটের দশক থেকে ফি বছরই প্রমত্তা যমুনায় ভাঙ্গন দেখা গেছে। বন্যার পানি নদী ছাপিয়ে ভেসে গেছে মানুষের ঘরবাড়ি, ডুবে নষ্ট হয়েছে জমির ফসল । আবার ভাঙ্গনে নদীপাড়ের আবাদি জমি, বাড়িঘর বিলীন হয়েছে যমুনাগর্ভে। যমুনা পাড়ে যাদের বাড়ি তারা দেখেছেন নদীর ভাঙ্গন খেলা। নাচুনে নদী যমুনা প্রতি বছরই ভাঙ্গন খেলায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে। পাড় ভেঙ্গে গ্রামের পর গ্রাম বিলীন হয়ে যায়। বর্ষার আগে কোনভাবেই বোঝা যায় না এবার কোন পাড় ভাঙবে। কত সংখ্যক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কী পরিমাণ জমি-জিরাত, বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হবে। যমুনার এই ভাঙ্গনে দিশাহারা মানুষ প্রতি বছরই সহায় সম্বল হারিয়ে নাড়ির বন্ধন, পারিবারিক বন্ধন ছিন্ন করে দূরে বহু দূরে আশ্রয় নিয়েছে। অনেক পরিবারই ১০ থেকে ১২ বার যমুনার হিংস্র ছোবলে পরাজিত হয়েছে। প্রতি বছর যমুনার এমন হিংস্র আচরণে সিরাজগঞ্জের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
কিন্তু এখন যমুনাপাড়ের চিত্র বদলে গেছে। ভাঙ্গনের শব্দ শোনা যায় না। কারও কপালে আর দুশ্চিন্তার বলিরেখা দেখা যায়না। ড্রেজিং করে যমুনাকে জয় করে, বশে এনে যমুনাপাড়ে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য স্থাপনা। প্রমত্তা যমুনা এখন অর্থনৈতিক উন্নয়নের চাবিকাঠি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু সেতু উদ্বোধনের পর এই সেতুকে ঘিরে সিরাজগঞ্জে গড়ে উঠছে শিল্প পার্ক, ইকোনমিক জোন, গোটা উত্তরাঞ্চলজুড়ে সড়ক অবকাঠামোরও উন্নয়ন হয়েছে। প্রমত্তা যমুনা নদী ড্রেজিং করে, যমুনাকে শাসন করে, সুচারুভাবে বশে এনে নদীপাড়ে ১৬ বর্গ কিঃমি জমি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। এই জমি ব্যবহৃত হচ্ছে বিসিক শিল্পপার্কের কাজে। যমুনার বুকের ওপর সিরাজগঞ্জ সীমানা দিয়ে নির্মাণ করা হচ্ছে চার দশমিক আট কিঃমি দীর্ঘ শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু। এ ছাড়াও গ্যাসভিত্তিক শিল্প কারখানা, বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রসহ বড় বড় অসংখ্য অবকাঠামো গড়ে উঠেছে। যমুনার পাড়ে শিল্প পার্ক, ইকোনমিক জোন এবং রেলওয়ে সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হলে সিরাজগঞ্জের আর্থ- সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের দ্বার উন্মোচিত হবে।
পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার সিরাজগঞ্জে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পরিদর্শন বাংলোয় জনকণ্ঠকে বলেন, প্রমত্তা যমুনাকে জয় করে নদীপাড়ে অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা, বিসিক শিল্প পার্ক, বিদ্যুত উৎপাদন কেন্দ্রের মতো মেগা প্রকল্প গ্রহণ এবং বাস্তবায়ন করা বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বেই সম্ভব হয়েছে। গত তিন বছরে বন্যার ক্ষয়ক্ষতি হতে দেশের জনসাধারণের জানমাল রক্ষা ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নদী ভাঙ্গনরোধ, নদী ড্রেজিং, সেচ ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, জলাবদ্ধতা দূরীকরণ ও ভূমি পুনরুদ্ধারের কাজ করেছে। যমুনা নদীর সিরাজগঞ্জ অংশে ভাঙ্গনরোধে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। ৪ দশমিক ৫০ কিঃমিঃ যমুনা নদী ক্যাপিটাল (পাইলট) ড্রেজিং প্রকল্পের আওতায় সিরাজগঞ্জে ১৬ বর্গ কিঃমিঃ ভূমি পুনরুদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধার করা জমিতে অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন শুরু হয়েছে। ডেজ্ড ম্যাটেরিয়াল দিয়ে ৩টি ক্রসবার নির্মাণ করা হয়েছে। শহর উপকণ্ঠের মালশাপাড়া বরাবর তিন নম্বর ক্রসবার পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য উপযুক্ত করতে ইতোমধ্যেই কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়াও হার্ডপয়েন্টে ইতোমধ্যেই ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ও কারাগারের রোজনামচা’ বই এর আদলে নির্মাণ করা হয়েছে ম্যুরালসহ নানা স্থাপনা। যমুনা ঘিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়নসহ সিরাজগঞ্জে যমুনা নদী ড্রেজিং করে উদ্ধার করা জমিতে গৃহহীন মানুষের স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য আবাসন প্রকল্প গড়ে তোলার পরিকল্পনাও রয়েছে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের। ক্রসবার ১-২ এর মাঝখানে মাটি ভরাট করে ঘর নির্মাণ করে স্বামী স্ত্রী উভয়ের নামে বরাদ্দ দেয়া হবে। যাতে কেউ কাউকে ছাড়া জমি হস্তান্তর বা বিক্রি করতে না পারে।
সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার আরও বললেন এক সময় বলা হতো যমুনা নদী সিরাজগঞ্জবাসীর দুঃখ। এই দুঃখকে জয় করে যমুনা অববাহিকায় নতুন সভ্যতা গড়ে তুলতে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় কাজ করছে।