ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

প্রতারণার অভিযোগে মামলা মোহাম্মদপুরের বাসায় র‌্যাবের অভিযান মামলা তদন্ত করে ২১ অক্টোবর প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ

ইভ্যালির রাসেল সস্ত্রীক গ্রেফতার

প্রকাশিত: ২২:১৯, ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২১

ইভ্যালির রাসেল সস্ত্রীক গ্রেফতার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রতারণার অভিযোগে এক গ্রাহকের করা মামলায় ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম ইভ্যালির এমডি মোহাম্মদ রাসেল এবং তার স্ত্রী প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোছাঃ শামীমা নাসরিনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। বৃহস্পতিবার বিকেলে ঢাকার মোহাম্মদপুরে রাসেলের বাসায় ঘণ্টাখানেক অভিযান চালানোর পর তাদের দুজনকে র‌্যাবের সদর দফতরে নিয়ে যাওয়া হয়। বিষয়টি গণমাধ্যমে নিশ্চিত করে র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল খায়রুল ইসলাম বলেন, তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। সে জন্য তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে। এর আগে গত বুধবার গভীর রাতে আরিফ বাকের নামের এক গ্রাহক গুলশান থানায় প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে ইভ্যালির এমডি ও চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এদিকে মামলাটি তদন্ত করে আগামী ২১ অক্টোবর প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার মামলার এজাহার আদালতে পৌঁছালে ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরী এজাহার গ্রহণ করে এই আদেশ দেন। মামলার বাদী আরিফ বাকের তার অভিযোগে বলেন, ইভ্যালির বিজ্ঞাপন দেখে প্রভাবিত হয়ে তিনি ৩ লাখ ১০ হাজার টাকার পণ্যের অর্ডার দেন। কিন্তু দীর্ঘ সময়ে তাকে কোন পণ্য সরবরাহ করা হয়নি। পণ্যের ব্যাপারে ইভ্যালির অফিসে এবং পরে সিইও মোঃ রাসেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ‘প্রাণনাশের হুমকি’ দেন বলে মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে। মামলার এজাহারে রাসেল ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে তিনটি ধারায় অপরাধের কথা বলা হয়েছে। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ধারাগুলো হচ্ছে, ৪২০, ৫০৬ ও ৪০৬। দণ্ডবিধির ৪২০ নম্বর ধারাটিতে প্রতারণা করে সম্পত্তি বা অর্থ হাতিয়ে নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এ অপরাধে কোন ব্যক্তির সাত বছরের কারাদণ্ড, অর্থদণ্ড ও উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। ৪০৬ নম্বর ধারায় ‘বিশ্বাসঘাতকতা’র অপরাধে সর্বোচ্চ তিন বছর জেল, অর্থ জরিমানা ও উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। ৫০৬ নম্বর ধারায় ভিক্টিমকে ‘হত্যা বা আঘাত করার ভয়ভীতি’ দেখানোর অপরাধের কথা বলা হয়েছে। এ ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি সাত বছর নির্ধারণ করা আছে। প্রতারণা ও গ্রাহক হয়রানির অভিযোগে ইভ্যালির এমডি রাসেল ও চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিনের বিরুদ্ধে এর আগেও কয়েকটি মামলা হয়েছে বিভিন্ন জেলায়। জানা গেছে, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যাত্রা শুরু করে মাত্র আড়াই বছরের মাথায় সরবরাহকারী কোম্পানি ও গ্রাহকদের কাছে ৫৪৩ কোটি টাকার দায়ে পড়েছে ইভ্যালি। এত অল্প সময়ে এই বিপুল টাকা কোথায় গেল, তার হদিস এখনও মেলেনি। আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে গত জুলাই মাসে দুদকের আবেদনে ইভ্যালির শীর্ষ কর্তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা জারি করে আদালত। এদিকে বৃহস্পতিবার রাসেল গ্রেফতার হওয়ার খবরে গ্রাহকদের অনেকে তার মোহাম্মদপুরের বাসার সামনে ভিড় করেন। রাসেলকে র‌্যাব নিয়ে যাওয়ার সময় প্রতিবাদ জানিয়ে মোটামুটি অর্ধশতাধিক লোককে সেখানে বিক্ষোভ করতেও দেখা যায়। নিজেদের ইভ্যালির গ্রাহক হিসেবে পরিচয় দিয়ে তারা রাসেলকে ছেড়ে দেয়ার দাবি জানান। রেদোয়ান নামে একজন গ্রাহক সাংবাদিকদের জানান, ইভ্যালির রাসেলকে যথাযথ নজরদারির মধ্যে রেখে আরও কিছুদিন সময় দেয়া উচিত। একটা নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে তাকে গ্রাহকদের টাকা ফেরত বা পণ্য দিতে বাধ্য করা যেতে পারে। তাকে ধরে নিয়ে গেলে গ্রাহকরা পণ্য বা টাকা কিছুই পাবেন না। আলী নামে ইভ্যালির একজন গ্রাহক বলেন, ইভ্যালির চেয়ারম্যান-এমডি তো বিদেশে পালিয়ে যাননি। যদি পালিয়ে যেতেন, তাহলে প্রশাসন ইভ্যালির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারত। কিন্তু রাসেল ভাই দেশেই ছিলেন এবং আজকেও তিনি কিছু পণ্য গ্রাহকদের ডেলিভারি দিয়েছেন। তাকে গ্রেফতার না করে মুক্ত করে দিন। এদিকে গত মঙ্গলবার ইভ্যালির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করার সিদ্ধান্ত নেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বাধীন আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি। এদিন সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মোঃ হাফিজুর রহমান। তিনি জানান, যেহেতু আইন লঙ্ঘন হয়েছে, তাই বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দায়িত্ব না নিয়ে তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে দেবে। তার আগে কমিটির সুপারিশ বাণিজ্যমন্ত্রী ও বাণিজ্য সচিবকে জানানো হবে। হাফিজুর রহমান জানান, ১০টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে চাওয়া হয়েছিল। একটি পাওয়া গেছে। বাকিগুলোর তথ্যও আসবে। বৈঠকে ধামাকা, ই-অরেঞ্জ ইত্যাদির কর্মকাণ্ড নিয়েও আলোচনা হয়েছে। ইভ্যালির সম্পদ ও দায় ॥ বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে গত সপ্তাহে সম্পদ ও দায়ের হিসাব দাখিল করে ইভ্যালি। সেখানে উল্লেখ করা হয়, তাদের মোট দায় ৫৪৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে এক কোটি টাকা শেয়ারহোল্ডার হিসেবে কোম্পানির চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোঃ রাসেল কোম্পানিকে দিয়েছেন। বাকি ৫৪৩ কোটি টাকাই কোম্পানিটির চলতি দায়। ইভ্যালির হিসাব অনুযায়ী, দায়ের বিপরীতে এর চলতি সম্পদ রয়েছে ৯০ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আর সম্পত্তি, স্থাপনা ও যন্ত্রপাতি মিলিয়ে রয়েছে ১৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। মোট ১০৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা দেখানো হচ্ছে স্থাবর সম্পত্তি হিসেবে। মোট দায় ৫৪৩ কোটি টাকা থেকে ওই অঙ্ক বাদ দিলে বাকি থাকে ৪৩৮ কোটি টাকা। যাকে ইভ্যালি বলছে তার অস্থাবর সম্পত্তি। বিবরণী মেলাতে ইভ্যালি দেখিয়েছে, অস্থাবর সম্পত্তি ৪৩৮ কোটি টাকার মধ্যে ৪২৩ কোটি টাকা হচ্ছে ইভ্যালির ব্র্যান্ড মূল্য, আর ১৫ কোটি ৮৩ লাখ টাকা হচ্ছে অদৃশ্য সম্পত্তি। কোম্পানিটি নিজের ব্র্যান্ড মূল্য নিজেই নির্ধারণ করেছে। শুধু গ্রাহকদের কাছে ইভ্যালির দেনার পরিমাণ ৩১১ কোটি টাকা। এ দেনা আছে মোট ২ লাখ ৭ হাজার ৭৪১ গ্রাহকের বিপরীতে। এ হিসাব গত ১৫ জুলাই পর্যন্ত। এর পরেও ইভ্যালি গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে এবং পণ্য বিক্রি করেছে। গত ২৫ আগস্ট ইভ্যালির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও চেয়ারম্যানের সব ব্যাংক এ্যাকাউন্টের হিসাব চেয়েছিল বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। চিঠিতে ইভ্যালি প্রতিষ্ঠান, চেয়ারম্যান শামীমা নাসরিন ও এমডি মোহাম্মদ রাসেলের ব্যাংক হিসাবের তথ্য পাঁচ কার্যদিবসের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়েছিল। এর আগে গত বছরের আগস্টে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান নাসরিন ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাসেলের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করে বিএফআইইউ। আরেক মামলায় প্রতিবেদন ২১ অক্টোবর ॥ কোর্ট রিপোর্টার জানান, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোঃ রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা নাসরিনের (ইভ্যালির চেয়ারম্যান) বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের এক মামলায় তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ ২১ অক্টোবর ধার্য করেছেন আদালত। বৃহস্পতিবার ঢাকার এডিশনাল চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আসাদুজ্জামান নূরের আদালত মামলাটির এজাহার গ্রহণ করে প্রতিবেদন দাখিলের তারিখ নির্ধারণ করেন। সংশ্লিষ্ট থানার আদালতের সাধারণ নিবন্ধন শাখা এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। গত বুধবার রাতে আরিফ বাকের নামে একজন ভুক্তভোগী গুলশান থানায় মামলাটি করেছেন। মামলায় অর্থ আত্মসাত ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ করা হয়েছে। ইতোমধ্যেই আনা প্রতারণার অভিযোগে ইভ্যালির সিইও রাসেল ও তার স্ত্রী শামীমা গতকাল গ্রেফতার হয়েছেন। আরিফের মামলার এজাহারে বলা হয়, গত মে মাসে ইভ্যালির চমকপ্রদ বিজ্ঞাপনে আকৃষ্ট হয়ে আরিফ বাকের তার বন্ধুদের নিয়ে কিছু পণ্য অর্ডার করেন। এছাড়া পণ্যের অর্ডার বাবদ সকল মূল্য বিকাশ, নগদ ও সিটি ব্যাংকের কার্ডের মাধ্যমে সম্পূর্ণ পরিশোধ করেন। আরিফ অভিযোগ করেন, ‘পণ্যগুলো ৭-৪৫ কার্যদিবসের মধ্যে সরবরাহে ব্যর্থ হলে উক্ত প্রতিষ্ঠান সমুদয় টাকা ফেরত দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিল। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে তারা পণ্য সরবরাহ করেনি। ফোন করা হলে বারবারই তারা আমার পণ্যগুলো শীঘ্রই দিচ্ছে বলে আশ্বস্ত করে যাচ্ছিল। এক পর্যায়ে ইভ্যালি পণ্য অথবা টাকা প্রদানে ব্যর্থ হওয়ার পর আমি তাদের অফিসে যাই। তখন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মোঃ রাসেলের সঙ্গে দেখা করতে চাইলে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছি’। এজাহারে আরিফ আরও বলেন, গত ১০ সেপ্টেম্বর তিনি ও তার বন্ধুরা ইভ্যালি অফিসে গিয়ে পণ্যের অর্ডার সম্পর্কে কথা বলতে চাইলে ইভ্যালির লোকজন উত্তেজিত হয়ে চিৎকার-চেঁচামেচি করে। এক পর্যায়ে অফিসের অভ্যন্তরে থাকা ইভ্যালির সিইও রাসেল উত্তেজিত হয়ে তার রুম থেকে বেরিয়ে এসে বলে পণ্য অথবা টাকা কিছুই তারা দিবেন না। এক পর্যায়ে প্রাণনাশের হুমকি দেয়া হয় বলেও অভিযোগ করেছেন আরিফ। আরিফ আরও বলেছেন, পণ্য না পাওয়ায় আর্থিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তিনি। ইভ্যালির চলতি সম্পদের পরিমাণ ৯০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। সম্পত্তি স্থাপনা ও যন্ত্রপাতির মিলিয়ে রয়েছে ১৪ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। তবে প্রতিষ্ঠানটির দায় ৫৪৩ কোটি টাকা। সম্প্রতি ইভ্যালিসহ বেশকিছু ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে গ্রাহকের সঙ্গে অর্থ নিয়ে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে। একই সঙ্গে তাদের বর্তমান সম্পদের সঙ্গে গ্রাহকের কাছ থেকে নেয়া অর্থের কোন সামঞ্জস্য পায়নি বাংলাদেশ ব্যাংকের ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট। পরে তারা লিখিতভাবে বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে।
×