ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

এক কন্যার কাহিনী

প্রকাশিত: ১৯:৫৩, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২১

এক কন্যার কাহিনী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আধুনিক ও নতুন বাংলাদেশ তৈরির অবিস্মরণীয় নির্মাতাই নন, বরং জাতির জনকের যোগ্য উত্তরসূরির মর্যাদায় স্বপ্নের সোনার বাংলা উপহার দেয়ারও অনন্য স্থপতি। তাঁর যাত্রাপথের চরম সঙ্কটকাল থেকে শুরু করে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ভিন্নমাত্রার জীবন তৈরি হওয়াও যেন মহাকালের অমোঘ নির্দেশ। ১৯৮১ সালে দেশের মাটিতে পা রাখার দুঃসহ পালাক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ জীবনটা কতভাবেই না দুর্যোগের ঘোর অন্ধকারে নিপতিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে তেমন বাস্তব কাহিনী নিয়ে নির্মিত হয় এক সাড়া জাগানো শিল্পকর্ম। তরুণ নির্মাতা পিপলু খান শেখ হাসিনার বাস্তব ঘটনাপঞ্জির সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর স্বল্প জীবনের বর্ণাঢ্য কর্মদ্যোতনার মহাসম্মিলনে যে চিত্রকল্প দর্শক-শ্রোতাদের উপহার দেন সেটাও এক অভিনব এবং বিস্ময়ে মন্ত্রমুগ্ধ হওয়ার মতোই। পরিচালকের শৈল্পিক শৌর্যে যে মাত্রায় শেখ হাসিনার সংগ্রামী জীবন দর্শকদের আবিষ্ট করে একইভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের লড়াকু অভিযাত্রার অনন্য দলিলও বটে। শেখ হাসিনার কঠিন ও দুর্গম সময়ের স্বচ্ছ প্রতিবেদন তৈরি করতে গিয়ে যে বাস্তবতার নির্মম চিত্র আঁকা হয় তা সত্যিই মর্মস্পর্শী এবং স্পর্শকাতর। দর্শকনন্দিত এই চিত্রকল্পটি শৈল্পিক সুষমায় অভিষিক্ত করতে শেখ হাসিনার যে জীবন কাহিনী তুলে ধরে তাতে শোকে মুহ্যমান হতে যেমন সময় লাগেনি একইভাবে বাংলাদেশের সংগ্রামী অভিযাত্রাকেও যথার্থভাবে উপস্থাপনে তেমন ত্রুটি-বিচ্যুতিও পরিলক্ষিত হয়নি। অসাধারণ এক নির্মাণশৈলী যেখানে বাস্তবতার অভিঘাতে নির্মম কাহিনীচিত্র দর্শক-শ্রোতাদের আবেগে অভিভূত করে দেয়। পিতা-কন্যার দুজনের মহাসম্মিলনের গ্রন্থি তৈরি করতে গিয়ে নির্মাতাকে কোনভাবে কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়নি। কাহিনীর গতি নির্ণয়ে পিতা-কন্যা যে ঐতিহাসিক মাত্রায় এক সূত্রে গেঁথে যান সেটা শুধু চিত্র রূপকারের অনন্য সফলতা ছাড়াও দুই প্রজন্মের অচ্ছেদ্য আদর্শিক বোধ আর দেশপ্রেমের অনমনীয় চেতনার সমৃদ্ধ যাত্রাপথও বটে। ঐতিহাসিক পালাক্রমে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা তাঁদের নিঃস্বার্থ আর নিঃশর্ত আত্মনিয়োগে ব্রতী থেকে দেশ ও জনগণকে সর্বোচ্চ স্থানে অভিষিক্ত করেন সেটাও এক সুদৃঢ়, বলিষ্ঠ ও নির্ভীক জীবনবোধ। তেমন অনমনীয় মনোশক্তিতে অপ্রতিহতভাবে এগিয়ে যেতে দুজনের একজনকেও পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। এক অনন্য কন্যার কাহিনী বিধৃত করতে গিয়ে পিতার মহিমান্বিত ঘটনাপঞ্জি যে মাত্রায় মিলিত সৌধে অবিচলিত থাকে তাও লড়াকু অভিযাত্রার মহাসম্মিলন। কন্যা আর পিতার এমন সেতুবন্ধন বাংলাদেশের ইতিহাসে যেভাবে অবিচ্ছিন্ন পথযাত্রার মিলন ঘটায় সেখানে স্বপ্নের সোনার বাংলা আর আধুনিক ডিজিটাল বাংলা মিলেমিশে একাত্ম হয়ে যায়। তবে বঙ্গবন্ধুর লালিত স্বপ্নের বাংলাদেশ দেখার সৌভাগ্য হয়নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর নিরলস কর্মসাধনায় বহু কাক্সিক্ষত সোনার বাংলাই নয়, তার চেয়েও বেশি আধুনিক প্রযুক্তির নতুন বাংলাদেশও জনগণকে তার স্বপ্নের দরজায় পৌঁছে দিচ্ছে, যা সত্যিই বিস্মিত আর মুগ্ধতার বিষয় বটে। অকালে, অসময়ে চলে যাওয়াটা কখনই প্রত্যাশিত ছিল না। বিশেষ করে চারপাশে নিকটে থাকা মানুষেরই নৃশংস ছোবলে বঙ্গবন্ধুকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সঙ্গে, যা সত্যিই পুরো জাতিকে ষড়যন্ত্রের আবর্তে ফেলে অস্তিত্ব সঙ্কটের শেষ ধাপে নিয়ে যেতে খুব বেশি সময়ও লাগেনি। দুর্গম এবং পিচ্ছিল পথ পাড়ি দিতে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যাসহ সারা জাতির সামনে যে পর্বতপ্রমাণ প্রাচীর তৈরি করা হয় তা ভাঙতেও ২১ বছর যে সংগ্রামী অভিগমন তাড়া করে বেড়ায় সেটা এখনও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে কুচক্রী মহলের অপতৎপরতা নিঃসন্দেহে অশুভ সঙ্কেত। বঙ্গবন্ধুর প্রথম সন্তান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিদিনের সাদামাটা জীবনের ইতিবৃত্তে যে চিত্রসম্ভার দর্শকদের মুগ্ধতার স্রোতে ভাসিয়ে নেয় তা হলো এক সুযোগ্য কন্যার অমিত তেজ, দেশের প্রতি অবিচলিত মমত্ববোধে পিতার রেখে যাওয়া স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে সব ধরনের ঝুঁকির মুখে নিঃসঙ্কোচে, নিঃসংশয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। যাত্রাপথকে যেমন লড়াই-সংগ্রাম দিয়ে অতিক্রম করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন তেমন ঘটনাপ্রবাহও চিত্রকাহিনীতে দক্ষভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। ঘটনার শুরুতেই মনে হয় এক আদুরে কন্যার স্নেহ-মায়া-মমতায় পরিবেষ্টিত পিতা-মাতার স্নেহধন্য হওয়ার নিরেট বাস্তবতা যা কোন এক সময়ে যে ক্ষতবিক্ষত আঁচড় বসে যায় সেটাকে কঠোর মনোবলে পাড়ি দেয়াও প্রতিদিনের এক অসহনীয় যন্ত্রণাকাতর পালাক্রম। এমন দুঃসময়ও তাড়া করেছে নির্মমতার বাঁকে মোড় নিতে গিয়ে চাপা কান্নায়। অজানা-আশঙ্কিত যাত্রায় কোন সুনির্দিষ্ট গন্তব্য একেবারেই ছিল না। দুঃসাহসিক অভিযাত্রা মোকাবেলা করতে গিয়ে পিতার বলিষ্ঠ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে উজ্জীবিত হওয়াও যেন পরিস্থিতির দাবি ছিল। সেটাই মুগ্ধ বিস্ময়ে তাক লাগানোর মতো। চিরায়ত এক বাঙালী রমণী যিনি কিনা স্বামী-সন্তান নিয়ে সংসারধর্ম পালনে এক প্রকার তালিম নেয়ার অবস্থায় নিজেকে দাঁড় করালেন, সেখানে কোটি কোটি বাঙালীর দায়িত্বভার নিয়ে একটি পুরো দেশকে নিয়ন্ত্রণ করা। তাও আবার শত্রু পরিবেষ্টিত এক অলঙ্ঘনীয় কঠিন রাস্তা। কিন্তু সেই শাশ্বত বঙ্গললনা কোন এক সময় নিজের প্রতিকূল পরিস্থিতিকে সামলাতে গিয়ে ভেতরে থাকা অসাধারণ ব্যক্তিসত্তার মহিমান্বিত প্রকাশেও নিজেকে সমর্পণ করতে খুব বেশি কিছু ভাবেননি। অকাতরে, অবলীলায় পিতার রেখে যাওয়া সোনার বাংলা আর স্বপ্নের দেশ গড়ার প্রত্যয়ে নিজের সর্বশক্তি উজাড় করতেও পেছনের দিকে তাকালেন না। সেই ১৯৫২ সালে বঙ্গবন্ধুর সপরিবারে রাজধানী ঢাকা শহরে নিজের বসতি স্থাপন সমৃদ্ধ জীবনের এক অনন্য ঘটনাপঞ্জি, যা বহুমাত্রিক আর ঘটনাবহুল যাত্রাপথের মাইলফলক। শেখ হাসিনা তখন ৫ বছরেরর অবোধ শিশু। তখনও স্থায়ীভাবে ঢাকায় আবাসস্থল তৈরি করা যায়নি। পিতার সংগ্রামী জীবনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাকে সরাসরি দেখতে দাদা-দাদি ও মাকে নিয়ে ঢাকায় আসার স্মৃতিময় সময়গুলো এখনও স্মরণ চেতনায় স্পষ্ট হয়ে আছে। নদীমাতৃক গ্রামবাংলার অপার নৈসর্গিক সম্ভারে নিজের শৈশব তৈরি করার আনন্দঘন মুহূর্তগুলো এখনও চিরায়ত বঙ্গরমণী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নাড়া দেয়। গ্রামবাংলার অবারিত বৈভবই শুধু নয়, মাটি আর মানুষের নির্মল সান্নিধ্যে তৈরি হওয়া সমৃদ্ধ জীবন আজও তাঁর কাছে অত্যন্ত দামী। সেই অতিপ্রিয় টুঙ্গিপাড়া জীবনের আনন্দযোগের যে রসদ তৈরি করেছে তেমন ঐশ্বর্য অন্য কোথাও দেখতে না পাওয়া এক প্রকার গ্রামীণ প্রতিবেশের প্রতি নির্মোহ টান বলাই যায়। এমন স্বতঃস্ফূর্ত আবেগাচ্ছন্ন অনুভূতি থেকে এখনও বিচ্ছিন্ন থাকতে পারেন না। বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করা প্রধানমন্ত্রী আজ অবধি অনিন্দ্য সুন্দর টুঙ্গিপাড়াকেই মুগ্ধতার আবেশে জড়িয়ে রাখেন। ‘এ ডটারস টেইলে’ প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত সাবলীলভাবে আপন বৈশিষ্ট্যে নিজেকে উপস্থাপন করতে গিয়ে বাস্তবসম্মত ঘটনাবহুলতায় একাত্ম হয়ে যান। মনেই হচ্ছিল না কোন সিনেমার অভিনয় দেখছি। বরং প্রধানমন্ত্রীকে স্বচক্ষে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হওয়া ছাড়া অন্য কিছু ভাবাই যায়নি। কাহিনীর গতিময়তায় বঙ্গবন্ধুর লড়াকু অভিযাত্রা যেমন দৃশ্যমান হয় পাশাপাশিা পারিবারিক পরিবেশে স্ত্রী-কন্যা-পুত্রদের সঙ্গে সময় কাটানোও দর্শকদের আবেগে আচ্ছন্ন করে দেয়। মায়ের হাতের সুস্বাদু রান্না কিভাবে সবাই মিলে আনন্দ-আয়োজনে পরিতৃপ্ত হতো তেমন চমৎকার দৃশ্যও অভিভূত হওয়ার মতো। স্ত্রী রেণুর ওপর পরম নির্ভরশীলতায় বঙ্গবন্ধুর সংসার জীবনের দিকে তাকাতে পর্যন্ত হয়নি সেটাও লড়াকু অভিযাত্রার পরম আশ্বস্তের ব্যাপার ছিল। তা না হলে রাজনৈতিক জীবনের ঝড়ঝাপটা সামলানো আরও কঠিন হয়ে যেত। অতি সাধারণ এক বাঙালী স্ত্রী কিভাবে অসাধারণ আকর্ষণীয় এক ব্যক্তিত্বের ঘরনির মর্যাদায় শুধু অভিষিক্ত হওয়াই নয়, বরং রাজনৈতিক দুঃসহ পালাক্রমের কাছের সঙ্গী ছাড়াও পরামর্শক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর পাশে দাঁড়াতেন। ভেতরে লুকানো সেই প্রচ্ছন্ন ক্ষমতা ও দক্ষতা দেশের সঙ্কটকালে বেরিয়ে আসতে সময় নিত না। রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সঙ্গে যে অভাবনীয় বাগ্মিতার অনন্য সম্মিলন তেমন দুর্জয়, দুঃসাহসিক, অজেয় ব্যক্তিত্বকে সামলানোর কাহিনীও দর্শক-শ্রোতার হৃদয়কে দারুণভাবে নাড়িয়ে দেয়। নির্মাতা তার অসাধারণ নির্মাণশৈলীতে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের ঘটনাপরম্পরাকে শৈল্পিক সুষমায় অনবদ্য করে তোলেন তাও এক অভাবনীয় নান্দনিক দ্যোতনা। আর শেখ হাসিনার জীবনের পালাক্রমে বাস্তবোচিত ঘটনার ইতিবৃত্তও উঠে আসে সাবলীলভাবে যথার্থ প্রেক্ষাপটে, যা প্রধানমন্ত্রীর জীবন সংগ্রামের অনন্য যাত্রাপথ। লেখক : সাংবাদিক
×