ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইসির স্পেশালাইজড ল্যাপটপই ব্যবহার করেছে সিন্ডিকেট

রোহিঙ্গাদের এনআইডি পাওয়ার নেপথ্যে চাঞ্চল্যকর জালিয়াতি

প্রকাশিত: ২৩:২৬, ২০ জুন ২০২১

রোহিঙ্গাদের এনআইডি পাওয়ার নেপথ্যে চাঞ্চল্যকর জালিয়াতি

মোয়াজ্জেমুল হক/হাসান নাসির, চট্টগ্রাম অফিস ॥ লাখ লাখ রোহিঙ্গাকে এনআইডি কার্ড করে দেয়ার নেপথ্যে রয়েছে সিন্ডিকেট সদস্যদের বিস্ময়কর জালিয়াতি। এসব ঘটনা নিয়ে দুদকের অনুসন্ধান এবং এ পর্যন্ত ১৮টি মামলা দায়েরের পর একদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও অপরদিকে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) শীর্ষ কর্মকর্তাদের মধ্যে নড়াচড়া শুরু হয়েছে। যেসব রোহিঙ্গাকে এনআইডি কার্ড দেয়া হয়েছে তা ইসির মাধ্যমেই বাতিল করে দেয়ার ঘোষণা আসতে পারে। এছাড়া বাংলাদেশী ১৮ বছরের উর্ধে এবং নিচের নাগরিকদের এনআইডি কার্ড সরবরাহ কাজ ইসি থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগে ন্যস্ত করার ইতোপূর্বেকার সরকারী সিদ্ধান্ত দ্রæত বাস্তবায়ন নিয়েও চিন্তা-ভাবনা চলছে। তবে এ নিয়ে দুই সংস্থার মধ্যে চলছে রশি টানাটানি। একদিকে ইসি কার্যালয় থেকে চুরি যাওয়া ল্যাপটপ, অপরদিকে, দু’ধাপে ইসির ৩ হাজার স্পেশালাইজড ল্যাপটপ টেন্ডারে বিক্রি করে দেয়ার পর সিন্ডিকেট সদস্যরা তা ব্যবহার করেছে অত্যন্ত গোপনে। দুদকের অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এ ঘটনা। উদঘাটিত হয়েছে যে ৩ হাজার ল্যাপটপ বিক্রি করা হয়েছে এবং যেগুলো চুরি হয়েছে সেসব হার্ডডিস্কের তথ্য মুছে ফেলা হয়নি। অর্থাৎ নির্দিষ্ট সফটওয়্যার ডি-এ্যাক্টিভেট করা হয়নি। টেন্ডারে বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর সিন্ডিকেট সদস্যরা এসব ল্যাপটপ দিয়ে অবৈধ এনআইডি সরবরাহ করেছে, যার বেশিরভাগ রোহিঙ্গা সদস্যদের। এ কাজে আরও ব্যবহার করা হয়েছে চুরি হওয়া ল্যাপটপ। ইসি থেকে কতটি ল্যাপটপ বিক্রি হয়েছে তা এখনও অনুদঘাটিত। এ কাজে জড়িত ৫০ জনের সম্পদ অনুসন্ধানের কাজও শুরু করেছে দুদক। এ ৫০ জনের মধ্যে রয়েছেন কতিপয় জনপ্রতিনিধি, পুলিশের ডিএসবি, সিটিএসবি এবং নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তা কর্মচারী। এদিকে এনআইডি সরবরাহের কাজ ইসি থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগে এখনও হস্তান্তর হয়নি। এটি নিয়ে ইসি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চলছে রশি টানাটানি। ইসির এক কমিশনার স্থানান্তরের বিষয় নিয়ে তার আপত্তির কথা জানিয়েছেন। এসব ঘটনার পরও এনআইডি কার্ড সরবরাহ কাজে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন না হওয়ায় কতিপয় জনপ্রতিনিধি ও পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের দুর্নীতিবাজ কিছু কর্মকর্তা ও দালাল চক্রের সহায়তায় লাখ লাখ অবৈধ এনআইডি কার্ড সরবরাহের ঘটনা ঘটেছে। প্রসঙ্গত, রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ বহু আগে থেকে। তবে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে আশ্রয় লাভ করেছে তাদের তালিকা দুভাবে হয়েছে। একটি সরকারীভাবে ও অপরটি বেসরকারী এনজিওদের মাধ্যমে। এর মধ্যে সরকারী সংস্থার মাধ্যমে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ১১ লক্ষাধিক। অপরদিকে জাতিসংঘের তথ্য রয়েছে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর ৭ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা প্রায় ১৩ লাখ। উল্লেখ করা যেতে পারে, প্রথমে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি, তারপর জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) এবং সর্বশেষ ধাপে পাসপোর্ট। এভাবেই বাংলাদেশে বৈধ হওয়ার প্রক্রিয়ায় কয়েক লাখ রোহিঙ্গা। আর এই কাজে জ্ঞাত-অজ্ঞাতসারে সহযোগী হয়েছে নির্বাাচন কমিশন (ইসি), জেলা প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকারদলীয় স্থানীয় নেতা এবং দালালচক্র। মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন সময়ে পালিয়ে এসে আশ্রিত রোহিঙ্গা জনসংখ্যা বর্তমানে প্রায় ১৩ লাখ। এসব রোহিঙ্গার নিজ দেশে ফেরত না যেতে বিভিন্ন অজুহাতে রয়েছে। মুখেই যতই রাখাইন প্রদেশের সমস্যার কথা বলুক না কেন, মূলত তারা এদেশে স্থায়ী বসতি গড়তে তৎপর। অর্থাৎ নানা অনৈতিক পন্থায় বৈধ নাগরিক হওয়ার পথ খুঁজছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এ বিষয়ে পিলে চমকানো কিছু তথ্য। শুরুটা হয়েছিল ওয়ান ইলেভেন পরবর্তী তত্ত¡াবধায়ক সরকার আমলে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তির মধ্য দিয়ে। এমন একটি ভোটার তালিকা নিঃসন্দেহে যুগান্তকারী কাজ। কিন্তু প্রথম তালিকা প্রস্তুতের সময় অত যাচাই-বাছাই সম্ভব ছিল না। লাইন ধরে ছবি তুলে ভোটার হয়েছে সাধারণ মানুষ। সে সুযোগে ঢুকে পড়েছে অনেক রোহিঙ্গা, যার সংখ্যা লাখের কাছাকাছি। এরপর আরও অন্তর্ভুক্তি ঘটে ইসির দায়িত্বহীনতা এবং প্রশাসনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অসততায়। এ কাজে সহযোগী হয়েছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় পর্যায়ে কিছু নেতাও, যারা রোহিঙ্গাদের প্রত্যয়ন করেছে আওয়ামী পরিবারের সদস্য তথা দলের সক্রিয় কর্মী হিসাবে। ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা তৈরির কাজে সারাদেশে ব্যবহৃত হয়েছিল প্রায় ৩ হাজার ল্যাপটপ। একটি প্রকল্পের আওতায় কাজ শেষ হওয়ার পর সেগুলো হস্তান্তর করা হয়েছিল ইসিকে। সেখান থেকে চুরি যায় কয়েকটি ল্যাপটপ। আর এতেই পাওয়া যায় ৫৫ হাজার ৩১০ অবৈধ ভোটার, যার বেশিরভাগই রোহিঙ্গা। কক্সবাজার, বান্দরবান ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলার ঠিকানায় রোহিঙ্গা ভোটার বেশি হয়েছে। এক্ষেত্রে রয়েছে অসাধুদের সঙ্গে ইসি, প্রশাসন, পুলিশের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং স্থানীয় পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের যোগসাজশ। দুদকের অনুসন্ধানে কক্সবাজারে সাত রোহিঙ্গার ভোটার ও জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়ার নেপথ্যে দেখা যায় ধাপে ধাপে বিভিন্ন পর্যায়ের সম্পৃক্ততা। কক্সবাজার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুর রহমান চেয়ারম্যান ২০১৮ সালের ৭ এপ্রিল এক প্রত্যয়নপত্রে সাত রোহিঙ্গা প্রসঙ্গে বলেন, ‘নি¤েœাক্ত ব্যক্তিবর্গ আওয়ামী লীগ পরিবারের সদস্য। বর্তমানেও তারা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। আমি তাদের ভালভাবে চিনি ও জানি।’ প্রত্যয়নপত্রে তিনি জালাল আহমেদ, মোহাম্মদ ইয়াহিয়া, মোহাম্মদ ওয়ারেস, মোহাম্মদ তৈয়ব, মোহাম্মদ রহিম, মোহাম্মদ নাঈম এবং মোহাম্মদ নুরুল আলমের নামোল্লেখ করেন। ওই বছরের ৬ মে কক্সবাজার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোঃ মোজাম্মেল হোসেন স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে এ সংক্রান্ত মামলাটি ‘যথাযথ সাক্ষ্য প্রমাণ না থাকায় খারিজযোগ্য’ বলে সিদ্ধান্ত দেয়া হয়। এ সংক্রান্ত মামলায় মোট ১৫ জনের বক্তব্য উল্লেখ করা হয়। এর মধ্যে ইসলামাবাদ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, পরিষদের দুই কর্মী এবং স্থানীয় এক সাংবাদিকের বক্তব্যও রয়েছে। সাক্ষীদের প্রায় সকলেই অভিযুক্ত রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশের স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে প্রত্যয়ন করেন। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে, যে ৩ হাজার ল্যাপটপ দিয়ে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা করা হয়েছিল সেগুলো নিলামে বিক্রি করার পূর্বে সফটওয়্যার ডি-এ্যাক্টিভেট করা হয়নি। ২০০৮ এবং ২০১৭ সালে ল্যাপটপগুলো নিলামে বিক্রি করে ইসি। এগুলোর ক্রেতা যারা তারাও জালিয়াত চক্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এখনও এসব ল্যাপটপ কিনতে পাওয়া যাচ্ছে। তদন্তে দেখা যায়, সফটওয়্যার ডি-এ্যাক্টিভেট না করায় মডেম দেয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কার্যকর হয়ে যাচ্ছে। কোন এলাকার ঠিকানায় ভোটার করতে হলে প্রয়োজন হয় সে এলাকার একটি পাসওয়ার্ড। সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কর্মকর্তা বা কার্যালয়ের কারও কাছ থেকে এ পাসওয়ার্ডটি পেতে হয়। সুতরাং স্থানীয় প্রত্যয়ন থেকে শুরু করে ভোটার হওয়া এবং আইডি কার্ড পাওয়া পর্যন্ত এ কাজে অনেক পক্ষের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত। কয়েকটি ল্যাপটপ চুরি এবং এতগুলো কার্যকর ল্যাপটপ নিলামে বিক্রির মাধ্যমে হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় কী পরিমাণ রোহিঙ্গা ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে এবং কতসংখ্যক এনআইডি রোহিঙ্গারা বানিয়ে ফেলেছে, তা কল্পনার বাইরে। তবে এর মধ্যেই অন্তত কয়েক লাখ রোহিঙ্গা জায়গা মতো নথিভুক্ত হয়ে বৈধ হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। দুদক সূত্রে জানা গেছে, এ পর্যন্ত পাসপোর্ট সংক্রান্ত ১৩টি এবং রোহিঙ্গা এনআইডি জালিয়াতি সংক্রান্ত ৫টিসহ মোট ১৮টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে ৮টির বাদী দুদকের উপসহকারী পরিচালক (ডিএডি) মোঃ শরীফ উদ্দিন, ৬টির বাদী ডিএডি সুভাষ চন্দ্র দত্ত এবং ৪টি বাদী ডিএডি মাহবুবুল আলম। মামলায় মোট আসামি ১০৬ জন। পাসপোর্টের ১৩ মামলায় আসামি ৩৬ জন। এর মধ্যে পাসপোর্ট পেয়ে ১০ জন বিদেশে রয়েছেন। অবশিষ্ট ২৬ জন পাসপোর্ট পেয়ে থাকলেও তা বাতিল করা হয়েছে। এনআইডি জালিয়াতির ৫ মামলায় আসামি ৩৪ জন। এর মধ্যে রোহিঙ্গা ১০ জনসহ একটি পৃথক মামলায় ৫৫ হাজার ৩১০ জন অবৈধ ভোটার, যার অধিকাংশই রোহিঙ্গা। এ মামলাগুলোতে এনআইডি ব্যবহার করে পাসপোর্ট পেয়ে বিদেশে আছে ৩ রোহিঙ্গা। এসব মামলায় এ পর্যন্ত ২৫ জন গ্রেফতার হয়েছেন, যার মধ্যে সরকারী বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তা-কর্মচারীও আছেন। আরও ১২টি মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সেগুলোর অনুসন্ধান হলে ভোটার তালিকায় কতসংখ্যক রোহিঙ্গার অন্তর্ভুক্তি ঘটেছে, তা অনুমান করাও কঠিন।
×