ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ফাওয়াজ রবের ‘লং ওয়াক হোম’

অধিকারহারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, ঠিকানার সন্ধানে দীর্ঘ পথ

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ১৩ জুন ২০২১

অধিকারহারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী, ঠিকানার সন্ধানে দীর্ঘ পথ

মোরসালিন মিজান ॥ কয়েকদিন পরপরই চিত্রকর্ম প্রদর্শনী। ঘটা করে উদ্বোধন। কৌতূহলী চোখে গ্যালারি ঘুরে বেড়ানো। ছবি দেখা। সবই, আজ বলা চলে, হারিয়ে গেছে। কোভিড সংক্রমণের ভয়ে সব কিছু বন্ধ। তালা ঝুলছে গ্যালারিগুলোতে। তবে ঘরে বসে কম বেশি ছবি আঁকছেন শিল্পীরা। কখনো সখনো প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হচ্ছে। না, শুধু দেশে নয়, বিদেশে পাঠানো হচ্ছে ছবি। সর্বশেষ খবর, বিদেশের একটি প্রদর্শনীতে ছবি পাঠিয়ে পুরস্কার জিতে নিয়েছেন বাংলাদেশের এক শিল্পী। হ্যাঁ, তার কথা, তার ছবির কথা কথা বলতেই এই প্রাক কথন। শিল্পীর নাম ফাওয়াজ রব। কম্বোডিয়ায় আয়োজিত পেনআর্ট আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে পুরস্কার জিতেছে তার ছবি। প্রদর্শনীটি, জানা যাচ্ছে, গত ৫ জুন শুরু হয়েছে। চলবে ২৭ জুন পর্যন্ত। এতে ফ্রান্স জাপান যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ৮০ জন শিল্পী অংশগ্রহণ করেছেন। প্রত্যেকের একটি করে ছবি। ফাওয়াজ রবও নিজের পছন্দ মতো ছবি জমা দিয়েছিলেন। জুরিবোর্ড সমস্ত ছবি দেখে তার ছবিটিকেই সেরা নির্বাচিত করেছে। ছবি বলতে, ছাপচিত্র। ছাপচিত্রের গুণ যেমন বিদ্যমান, তেমনি বিষয়ের গভীরতা আলাদা দৃষ্টি কাড়ে। শিল্পী মিয়ানমার থেকে উচ্ছেদ হওয়া রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছেন। মরতে মরতে বেঁচে যাওয়া মানুষগুলোর কথা বিশ্বসম্প্রদায় যখন ভুলতে বসেছে, যখন এ নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই, তখন মানবিক মানুষের সংবেদনশীলতা ও শিল্পের দায় থেকে ইস্যুটিকে সমকালীন করে তুলেছেন রব। বঞ্চনার ইতিহাস নতুন করে সামনে এনেছেন তিনি। ‘লং ওয়াক হোম’ শীর্ষক ছাপচিত্রে জীবন থেকে ছিটকে পড়া ঠিকানাহীন মানুষের দুঃখগাঁথা। দীর্ঘশ্বাস। এতে দেখা যায়, সবহারা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দীর্ঘ কাফেলা। অসংখ্য মৃত্যু পেরিয়ে এসেও জীবনের সন্ধান তারা পায় না। শূন্যতা আর হাহাকার পুঁটুলিতে ভরে রুদ্ধশ্বাস ছুটে চলেছে তারা। তারা ছুটছে। সামনে কোন ভবিষ্যত নেই। গন্তব্য অজানা। তবুও নদী কাদা-জল মারিয়ে হেঁটে চলেছে। হাঁটতে হাঁটতে বাংলাদেশে আপাতত ঠাঁই মিলেছে বটে, নিজ ঠিকানায় ফেরার পথটি বন্ধ। নিজের বাড়িতে ফিরতে চায় তারা। ফেরার আকুতি ছবিতে যারপরনাই জোরালো হয়ে ওঠেছে। কোন পথে ফিরবে তারা? আছে কি কোন পথ? ছবি দেখে প্রশ্ন জাগে মনে। দর্শনার্থীর মনটাকে এভাবে যেন জাগিয়ে দেন শিল্পী। নাড়া দেয়ার চেষ্টা করেন। ছাপচিত্রটিতে ডিটেইল ফিগারেটিভ কাজ। অনেকগুলো ফিগার, চমৎকার সমন্বয়। মুখগুলো মুখ নয়, নতমুখ। মুখগুলো অস্পষ্ট। মৌন। তবু অন্তর্ভেদী। ভাষা বুঝতে বাকি থাকে না। ছাপচিত্রের কালোকে আরও ডার্ক ডিপ করে একটা শোক, একটা রোদন শিল্পী স্পষ্ট করেছেন। তার সাদায় কালোয় দৃশ্য তৈরি হয়। দৃশ্যের ভেতরের দৃশ্যও বাদ পড়ে না। এর পর আর পুরস্কার জুটবে না কেন? মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে শিল্পীর কথা এখানে হচ্ছে তিনি মূলত স্থপতি। একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ান। আর ফাঁকে ফাঁকে ছাপচিত্রের কাজ করেন। কথা প্রসঙ্গে ফাওয়াজ রব নিজেই বলছিলেন শিল্পী হয়ে ওঠার গল্পটা- বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রিন্টমেকিং বিভাগের বন্ধুদের এই কাজ করতে দেখতাম। বেশ লাগত। দেখতে দেখতেই কখন যেন নিজে আগ্রহী হয়ে উঠলাম। এর পর তো লম্বা সময় গত হয়েছে। এখন নিজের স্টুডিও আছে। সেখানে নিয়মিত কাজ করি। ‘লং ওয়াক হোম’ সম্পর্কে জানতে চাইলে কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন শিল্পী। না, পুরস্কার প্রাপ্তির আনন্দে নয়, বরং রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুর্দশার কথা ভেবে। বলেন, আমি কাজের সূত্রে কক্সবাজারে ওদের ক্যাম্পে গিয়েছি। যে মানবেতর জীবন সেখানে দেখে এসেছি তা চোখে লেগে আছে। ছাপচিত্রটিতে তারই কিছুটা ছাপ। তিনি বলেন, একজন শিল্পীর দায়িত্ব শুধু সুন্দর ছবি আঁকা নয়, তার দায়িত্ব সময়ের কথা বলা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো। আমি দাঁড়িয়েছি। এ দাঁড়ানোর কোনও ফল হবে কিনা জানি না। তবে মানবিক মানুষ হিসেবে শিল্পী হিসেবে দায় ছিল। সেটি কিছুটা হলেও শোধ করতে পেরে ভাল ভাল লাগছে বলে জানান তিনি।
×