ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

প্রণব মজুমদার

কবুতরের সংসার

প্রকাশিত: ২২:৩০, ৫ জুন ২০২১

কবুতরের সংসার

- কী বিশ্রী গন্ধরে বাবা! ইঁদুর মরে রয়নি তো? ভাল মতো দেখতো খাটের নিচটা। - ও মাগো! বলো কী! তুমি দেখো! বিরক্তির চেহারা বাবার। মা ইঁদুর, তেলাপোকা ও টিকটিকিকে বেশ ভয় পান! বাবা ঠিক উল্টো। করোনা অতিমারীর লকডাউনে প্রত্যয়দের অনেকদিন নিজেদের বাসায় থাকা হয়নি। ৪ মাস দিদার বাড়িতে ছিল সবাই। সিদ্ধেশ্বরী ওদের বাসার কাছেই সে বাড়ি। শান্তিনগর বিশাল ইমারেতের কুড়ি তলার সুবিশাল ফ্ল্যাটে দিদন তিন বছর ধরে একা থাকেন। মামা ও মামী পরিবারের সবাই দিদনকে একা রেখে আমেরিকা চলে গেছেন! স্কুল অফিস বন্ধ থাকায় তাই লকডাউনের সময় দিদনের আমন্ত্রণে প্রত্যয়রা দিদনের কাছে থেকেছে। প্রত্যয়দের বাসা ছিলো এ সময় তালাবদ্ধ! অনুপস্থিতির এ সুযোগে প্রত্যয়দের বাসার বারান্দায় সংসার পেতেছে এক ঝাঁক কবুতর! কবুতরদের মলমূত্রের কারণে ওদের ছয় তলার মূল কক্ষের বারান্দাটা বেশ অপরিষ্কার। মুখে মাস্ক লাগিয়ে বারান্দার দরজা খুলেন বাবা। চেঁচিয়ে ওঠেন। - সর্বনাশ! কী হয়েছে বারান্দাটা! বাবার চিৎকারে হতভম্ব হয়ে পড়ে সবাই। এগিয়ে আসে দিদিও। পিছনে প্রত্যয়। - যা যা! তিনটে কবুতর পাখার বাতাস দিয়ে উড়ে যায় বারান্দার গ্রীল ছেড়ে। - কি করলা? দেখেছো মা, বাচ্চা কবুতরটার মা বাবাকেও তাড়িয়ে দিল বাবা। বাবা তাকালেন প্রত্যয়ের দিকে! হিসাবশাস্ত্রের অধ্যাপক বাবা সবেমাত্র পঞ্চম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ ছেলের কথা শুনে অবাক হয়ে যান! তারপর বাবাকে মা বলেন কবুতরের ঘর সংসারের গল্প। প্রত্যয়দের বাসার পাশেই মন্দিরের ছাদ। ছয় তলার ফ্ল্যাট থেকে তা পরিষ্কার দেখা যায়। ছাদের কেয়ারটেকার অনেক কবুতর পোষে বিক্রির জন্য। এক ঝাঁক পাখি যখন বড় হয়, তিনি বেশি দামে তাদের বেচে দেন! ছোট ছোট পাখি কবুতরের মাংসপ্রিয় ক্রেতা আসে কেয়ারটেকারের কাছে। রোজ সকালে প্রত্যয় ওদের বাসার বারান্দা ও জানালা থেকে কেয়ারটেকারকে গম ও চালও দিতে দেখে। দিদনের বাসায় প্রতিদিন এক ঝাঁক কবুতর আসে। দালানের প্রান্তে এসির পুরো টিনের ঢাকনা। তাতে এসে বসে ২০ থেকে ২৫টি কবুতর। ভোরে খাবার অপেক্ষায় থাকে ওরা। পশুপাখিপ্রিয় দিদন প্রতি প্রত্যুষে এসি ঢাকনার ওপর গম ছিটিয়ে দেন। দলবেঁধে আনন্দে খাবার খেয়ে ফেলে ওরা নিমিষেই। তীরের ফলার মতো কবুতরের চৌকো মুখের ঠকঠক টিনের শব্দ! তাাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় আশপাশের সবার! খুব ভোরে প্রত্যয় তা উপভোগ করে। এ নিয়ে প্রত্যয়ের অনেক প্রশ্ন। লকডাউনের সময় দিদনকে সে বলে - আচ্ছা দিদন ওরাতো তোমার কেউ না। অসুস্থ শরীর নিয়েও ওদের খাবার দিতে ভোরে ঘুম থেকে ওঠে যাও কেনো? - ওরাও জীব ভাই। মানুষের মতো ওদের জীবন। ওদেরও সংসার আছে। দুঃখ আছে। আনন্দ আছে! যে কোন জীবকে ভালোবাসা মানেই ঈশ্বরকে পাওয়া। দিদন গড়গড় করে আরও বলেন- ‘জীবে প্রেম করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর!’ ড্রয়িং রুমে এ সময় প্রত্যয়ের দিদি মহাবিদ্যালয়ের বিজ্ঞান পড়ুয়া প্রমিতি ছিল চেয়ারে বসা। অনলাইনে ক্লাস করছিলো। সে বলে উঠলো - ঠিক বলেছো দিদন! এটা মহাপুরুষ জ্ঞানী স্বামী বিবেকানন্দের বাণী। এর মানে হলো জীবের আত্মারূপে স্রষ্টা স্বয়ং জীবের মধ্যেই অবস্থান করেন। তাই জীবের সেবা করালেই আসলে স্রষ্টারই সেবা করা হয়। রান্নাঘর থেকে নিজ মা ও ছেলেমেয়ের বুদ্ধিদীপ্ত মানবিক ধর্মকথা শুনে মুচকিয়ে হাসেন প্রত্যয়ের মা। বাবা যখন গৃহে থাকেন না তখন প্রত্যয় ও মা গভীর মমতায় কবুতরদের কাছে ডাকে। ‘আয় আয় আয় বাক বাকুম, আয়! নে নে!’ নির্দয় কেয়ারটেকারকে ছেড়ে ওরা চলে আসে প্রত্যয়দের বারান্দায়। বাসায় রোজ প্রত্যয় সকালে কবুতরকে খেতে দেয়। শুধু গম নয়। বাসমতি, পোলাও চালও। দামী পোলাও চাল কেন? বাবাকে প্রত্যয়ের সোজা উত্তর - তুমিই তো বলেছিলে কাউকে কিছু দিলে ভালটা দিতে হয়! মিতব্যয়ী আদর্শবান বাবা ওর এমন সংলাপে চুপসে যান। বাবা মাকে এবার দেন ভিন্ন ব্যাখ্যা। - শোনো মারিয়া! চারদিকে করোনা, ডেঙ্গু ও বার্ড ফ্লু। কতো জীবাণু রোগ! কত মহামারী! - জানো ওরা ভালোবাসার টানে ছুটে আসে এখানে। - বারান্দায় রাখা বড় বালতিতে? - তুমি জেনেছো সব? - প্রত্যয় আমায় বলেছে! ৬০ লিটারের প্লাস্টিক বালতিতে কবুতরের ঘর সংসার! -তোমাকে তো আগে বলিনি! তুমি রাগ করবে! লকডাউনের আগে চারটে ডিম পেড়েছিল একটা কবুতরি। একটা ডিম নষ্ট হয়ে গেছে। বাকি দু’টোর বাচ্চা ফুটেছিল! একটা বাচ্চা চৌদ্দ দিন বেঁচেছে। অন্য কবুতর তাকে কামড়ে যাওয়ার পরদিন সকালে সে মারা যায়। সে শোকে প্রত্যয়ও সেদিন কিছু মুখে দেয়নি! বাকি ছানা টিকে গেছে! উড়তে শিখেছে সে। মাঝে মাঝে সন্ধ্যায় বারান্দায় ফিরে আসে আমাদের কবুতর সন্তান! বাবা গভীর আগ্রহ ভরে মার কথা শুনেন। চশমা খুলে অস্পষ্ট কাঁচ মুছতে মুছতে বলেন - এ দেখি আরেক সংসারের গল্প! প্রত্যয় যোগ দেয় মা বাবার কথোপকথনের মাঝখানে। - ঠিক বলেছো বাবা! বারান্দায় কবুতরের সংসার! অলঙ্করণ : প্রসূন হালদার
×