ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মহাস্থান ব্রাহ্মীলিপি

বাংলালিপির আদি উৎস, প্রাচীন ইতিহাসের স্মারক

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২১

বাংলালিপির আদি উৎস, প্রাচীন ইতিহাসের স্মারক

মোরসালিন মিজান ॥ পাথরে নাম লিখতে বারণ করেছিলেন মান্না দে। কারণ হিসেবে গানে গানে তিনি বলেছিলেন : ‘পাথরে লেখো নাম, পাথর ক্ষয়ে যাবে।’ আসলেই কি ক্ষয়ে যায়? ইতিহাস কিন্তু ভিন্ন কথা বলছে। শত সহ¯্র বছর আগের শিলা আবিষ্কারের পর দেখা গেছে, এর গায়ে যা উৎকীর্ণ করা ছিল তা মুছে যায়নি। বিভিন্ন সময় আবিষ্কৃত শিলালিপির পাঠোদ্ধার করে চমকিত হতে হয়েছে শুধু। লিপি গবেষণায় উঠে এসেছে হারিয়ে যাওয়া জনপদ, রাজ্য, রাজা, জনমানুষের নানা তথ্য। বহু অজানাকে জানা গেছে। ইতিহাস চর্চাকে এগিয়ে নিতে বিরাট ভূমিকা রাখা এইসব শিলালিপির খুব উল্লেখযোগ্য একটি মহাস্থান ব্রাহ্মীলিপি। বাংলার প্রাচীনতম লিপিতাত্ত্বিক দলিল হিসেবে এর গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে, যতদূর তথ্য, আরও একটি ব্রাহ্মী মূর্তিলেখ পাওয়া গিয়েছিল। নোয়াখালী জেলায় পাওয়া মূর্তিলেখ একদমই পাঠোপযোগী ছিল না। জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত পোড়ামাটির ফলক সিল মৃৎপাত্রেও প্রাচীন ব্রাহ্মীলিপি উৎকীর্ণ থাকতে দেখা যায়। তবে মহাস্থান ব্রাহ্মী শিলালিপি বাংলায় পাওয়া প্রাচীনতম নিদর্শন। ১৯৩১ সালের ৩০ নবেম্বর এটি বগুড়ার মহাস্থানগড়ে আবিষ্কার হয়। ঠিক আস্ত পাওয়া যায়নি। ভগ্নাংশ। জায়গাটির নাম বারুফকির। একজন কৃষক সেখানে জমি চাষ করছিলেন। চাষবাসের জন্য প্রয়োজনীয় খনন করতে গিয়েই প্রস্তর খ-টির দেখা মেলে। গবেষকদের হাতে আসার পর জানা যায়, এটি মামুলি প্রস্তর খ- নয়- মহামূল্যবান ইতিহাস আঁকড়ে ধরে থাকা ব্রাহ্মী শিলালিপি। ৩১ বাই ৪ ইঞ্চি পাথরে সাতটি লাইন উৎকীর্ণ করা আছে। লিপির পাঠোদ্ধার করেন দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভা-ারকার। তার নিজের সম্পাদনায় লিপিটি প্রথম প্রকাশ হয়। প্রকাশের পর চলে আরও অনেক গবেষণা। গবেষণা বলছে, শিলালিপিটি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকে উৎকীর্ণ করা হয়েছিল। এটি মৌর্য যুগের। মাগধী প্রভাবিত প্রাকৃত ভাষায় লেখা। শিলালিপি পাঠোদ্ধারে চমকিত হওয়ার মতো অনেক তথ্য সামনে আসে। শিলালিপির বক্তব্য পর্যালোচনায় একে একটি প্রশাসনিক আদেশ বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। ইতিহাসবিদ ড. ফিরোজ মাহমুদের মতে, পুডনগল, মানে, পু-্রনগর মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মৌর্য সম্রাট অশোক এ আদেশ প্রদান করেছিলেন। দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষিতে নাগরিকদের পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় লিপিতে। লিপির বক্তব্যটি অনেকটা এ রকম : সকল দরিদ্র, ষড়বর্গীয় প্রজাকে ধান দেয়া হলো। এর দ্বারা অভাব দূর হবে। সুদিন এলে এই কোষাগারের কোষ যেন কাকনিক, গ-ক মুদ্রা ও ধান দিয়ে পূরণ করা হয়। জানা যায়, সে সময় গ-ক নামক মুদ্রা ও কড়ি প্রচলিত ছিল। সে কালের দুর্যোগ হিসেবে বন্যা, অগ্নিকা-ের কথা উল্লেখ করা হয়। তোতা পাখি শস্য বিনষ্ট করতে পারে উল্লেখ করে এ বিষয়েও সতর্ক করা হয়। উত্তর ভারতীয় ব্রাহ্মীলিপি রূপ বাংলা লিপিরও আদি উৎস। কালক্রমে এটি দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। একটি পশ্চিমী ধারা বলে বিবেচিত হয়। অপরটি পূর্বী। এ পূর্বীধারা থেকেই বাংলালিপির উদ্ভব। ব্রাহ্মী থেকে বাংলালিপির যে পথ-পরিক্রমা তা দীর্ঘ গবেষণায় প্রমাণ করেছেন বাংলাদেশের ক্ষণজন্মা লিপি বিষারদ ড. শরিফুল ইসলাম। বাংলা প্রতিটি বর্ণের পরিবর্তনের ধারা একে একে তুলে ধরেছেন তিনি। প্রমাণ করেছেন কী করে ব্রাহ্মী থেকে আজকের বাংলা অক্ষরগুলো স্পষ্ট হয়েছে। তার মতে, খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয়-প্রথম শতকে এর জন্ম। কুষাণ লিপি থেকে গুপ্ত লিপির উৎপত্তি হয়। গুপ্ত লিপির ক্রমবিবর্তনের ফলে সিদ্ধমাতৃকা লিপির উৎপত্তি হয়। এর কালক্রমিক পরিণতি বাংলা লিপি বর্তমান রূপ। বাংলা একাডেমির জাদুঘরে এই বিবর্তনের ইতিহাসটি ধারাবাহিকভাবে তুলে ধরেছেন তিনি। বাংলালিপির উৎস হিসেবে জাদুঘরের দেয়ালে মহাস্থান শিলালিপির একটি ছবিও রাখা হয়েছে। সেটি দেখিয়ে প্রয়াত গবেষক ও লিপিবিশারদ জীবদ্দশায় এই লেখকের কাছে বারবারই বলেছেন, মহাস্থান ব্রাহ্মীলিপি এ অঞ্চলের ইতিহাস চর্চাকে অভাবনীয়ভাবে এগিয়ে নিয়ে গেছে। এ লিপির পাঠোদ্ধারে দারুণ সক্ষম শরিফুল ব্রাহ্মীর সঙ্গে বাংলার সম্পর্ক নিয়ে আরও অনেক গবেষণা করেছেন। মহাস্থান লিপিতে কী লেখা রয়েছে, তা অত্যন্ত আগ্রহ নিয়ে অনুবাদ করে শোনান তিনি। তখন শুধু চমতিকই হতে হয়েছে। মহাস্থান ব্রাহ্মীলিপির ছবি বিভিন্ন বইয়ে, লেখায় ঘুরে ফিরেই আসে। আসছে। কিন্তু বাস্তবে এটি কোথায় এখন? জরুরী জিজ্ঞাসা বৈকি। জানতে চাইলে শরিফুল ইসলাম কিছুটা মন খারাপ করেই বলেছিলেন, আমাদের কাছে নেই। বাইরে চলে গেছে। বাইরে বলতে, অন্য দেশে। আরেক ইতিহাসবিদ ও জাতীয় জাদুঘরের সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা ড. ফিরোজ মাহমুদ আরও স্পষ্ট করে বলেন, শিলালিপিটি দেশে নেই। এটি ওই সময়ই ইন্ডিয়ান মিউজিয়াম অব ক্যালকাটায় চলে যায়। সেখানে এখনও এটি আছে বলে নিশ্চিত করেন তিনি। বলেন, তখন তো আর বাংলাদেশ ছিল না। নিদর্শন সংগ্রহ সংরক্ষণে আজও আমরা অত সচেতন নই। তখন তো আরও খারাপ অবস্থা ছিল। ফলে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার মধ্য দিয়ে যা কিছু পাওয়া গিয়েছিল সবই কলকাতা মিউজিয়ামে ঠাঁই হয়। একই কারণে এ অঞ্চলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিলালিপিটি বাংলাদেশে নেই বলে জানান তিনি।
×