ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রবেশ ফি ১০ টাকায় যাত্রীদের ক্ষোভ

সদরঘাটে চাঁদাবাজির বিস্তার

প্রকাশিত: ২০:৪৩, ৯ জানুয়ারি ২০২১

সদরঘাটে চাঁদাবাজির বিস্তার

মামুন শেখ, ঢাকা ॥ সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল দিয়ে ভোলার চরফ্যাশনগামী তানভীর মোল্লা নামে ৬০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। এ সময় লঞ্চ টার্মিনালে প্রবেশের ক্ষেত্রে টিকেট কাউন্টারে সিবিএ নেতাদের সঙ্গে তর্কাতর্কি করতে দেখা যায় তাকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, আমি ১০ টাকা দিয়ে টিকেট কেটে সদরঘাটের লঞ্চ টার্মিনালে প্রবেশ করার পর মনে পড়ে বাইরে কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করার দরকার ছিল কিন্তু তাড়াহুড়া করার জন্য মনে ছিল না। পরবর্তীতে লঞ্চ টার্মিনালের বাইরে গিয়ে প্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করার পর লঞ্চ টার্মিনালে প্রবেশ করতে গেলে আমাকে আবারও তার বাধ্য করে ১০ টাকা দিয়ে টিকেট ক্রয় করে লঞ্চ টার্মিনালে প্রবেশ করতে। দেশের প্রধান নদীবন্দর ঢাকার সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের প্রবেশ ফি পাঁচ টাকা থেকে বাড়িয়ে দশ টাকা করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে প্রবেশ ফি নির্ধারিত করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সাধারণ যাত্রীরা। বরিশালগামী যাত্রী সোহাগ রাসিফ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএ যে প্রবেশ ফি বাড়িয়েছে, তা আমাদের ওপর জুলুম। এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। আমাদের মতো গরিব মানুষদের জন্য দশ টাকা প্রবেশ ফি দেয়াটা অনেক কষ্টের। কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পুনরায় পাঁচ টাকা করতে হবে। যেন আমরা গরিব মানুষেরা সহজে ও সুলভে যাতায়াত করতে পারি।’ পটুয়াখালীগামী যাত্রী শাহারিয়া আহমেদ বলেন, ‘আগে প্রবেশ ফি ছিল পাঁচ টাকা, যা সবার জন্য ভাল ছিল। কিন্তু এখন দশ টাকা করা হয়েছে, যার প্রভাব পড়েছে আমাদের মতো গরিব লোকের ওপর। প্রবেশ করার পরপরই কোন জরুরী কাজে বের হলাম, তাও আবার টিকেট কিনতে হয়। এতে কোন ছাড় দেয়া হয় না। টিকেটের মূল্য আগের মতো করা দরকার। আর প্রবেশ করার পর কোন জরুরী কাজে বের হওয়ার ক্ষেত্রে টিকেটের শিথিলতা করা খুবই জরুরী।’ সদরঘাটের ঢাকা নদী বন্দরের উপপরিচালক মোহাম্মদ শাহাজাহান সিরাজের কাছে যাত্রীদের অভিযোগের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনক্রমে প্রবেশ ফি বাড়ানো হয়েছে। এখানে আমাদের কিছু করার নেই। সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা আমাদের কাজ। সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের প্রবেশ ফি বাড়াতে বলা হয়েছে, তাই বাড়ানো হয়েছে। যাত্রীরা যেন হয়রানির শিকার না হন, সেজন্য আমরা যথেষ্ট প্রচার করেছি। প্রতিটি থানার দায়িত্বরত কর্মকর্তাদেরও এ বিষয়ে অবহিত করেছি। আর ফি এর দশ টাকা থেকে দুই টাকা করে যাত্রী কল্যাণে ব্যয় হবে। যাত্রীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত ও সামগ্রিক উন্নয়ন করা হবে।’ সদরঘাটের লঞ্চ মালিক সমিতির কাছে এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তারা বলেন, ‘নদী বন্দরের প্রবেশ ফি ৫ থেকে বাড়িয়ে ১০ টাকা করা হয়েছে। এতে আমরা বিআইডব্লিউটিএর এমন সিদ্ধান্তের নিন্দা জানাই। বিআইডব্লিউটিএ যে প্রবেশ ফি বৃদ্ধি করেছে তা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। এটি স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য মাত্র দশ টাকা প্রবেশ ফি দেয়াটাই অনেক কষ্টের। লঞ্চের ডেকে যারা ভ্রমণ করে তাদের অধিকাংশই স্বল্প আয়ের মানুষ। কর্তৃপক্ষের এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে পুনরায় পাঁচ টাকা করা উচিত। বাস টার্মিনাল, রেল স্টেশন ও বিমান বন্দরে প্রবেশে কোন প্রবেশ ফি দেয়া হয় না। তাহলে কেন শুধু সদরঘাটে প্রবেশ ফি দেয়া হয়? আমরা জানি প্রবেশ ফি সাধারণত কোন দর্শনীয় স্থান অথবা বিনোদনের স্থানে প্রবেশের ক্ষেত্রে নেয়া হয়ে থাকে। লঞ্চ টার্মিনাল তো কোন দর্শনীয় না বা বিনোদন কেন্দ্রও না, এখানে সাধারণ যাত্রীরা চলাচল করে থাকে। তাহলে তাদের কেন ঘাটে ১০ টাকা করে দিতে হবে? বিআইডব্লিউটিএর ভাষ্যমতে যাত্রীদের কল্যাণে কিছু টাকা ব্যবহার করা হয়। তাহলে অন্যান্য ট্রান্সপোর্টের টার্মিনাল থেকে কেন এর ফি নেয়া হয় না। অন্যান্য টার্মিনালে তাদের নিজেদের টাকায় যাত্রীদের কল্যাণ করলে বিআইডব্লিউটিএ কেন যাত্রীদের থেকে এর ফি আদায় করে ২ টাকা থেকে শুরু করে এখন ১০ টাকা। পাঁচ টাকা তাও সকলের জন্য মানানসই ছিল। কিন্তু ১০ টাকা একেবারেই অযৌক্তিক। সকল সাধারণ যাত্রীর পাশাপাশি আমাদের লঞ্চ টিমও এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমাদের লঞ্চ সবসময় সাধারণ যাত্রীর জন্য কল্যাণকর নয় এমন বিষয়ে প্রতিবাদ করে আসছে এবং ভবিষ্যতেও প্রতিবাদ করে আসবে। অবিলম্বে সদরঘাটের প্রবেশ ফি ১০ টাকা থেকে কমিয়ে ৫ টাকা করার জোর দাবি জানাচ্ছি। থেমে নেই সদরঘাটের বিভিন্ন পর্যায়ের চাঁদাবাজি। সমানতালে চলা কুলিদের দৌরাত্ম্যেও অতিষ্ঠ সাধারণ যাত্রীরা। প্রতিদিনই এই ঘাটকে কেন্দ্র করে লাখ লাখ টাকার লেনদেন আর ভাগবাটোয়ারা হয় চাঁদাবাজদের মাঝে। যাত্রীদের অভিযোগ, সদরঘাটে যাত্রীদের কাছ থেকে প্রায়ই জোর করে অতিরিক্ত টাকা আদায় করে ঘাটের নীল শার্ট পরা কুলিরা। ঘাটের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ভারি মালামালের জন্য কিছু ফি নির্ধারিত আছে। এছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে যাত্রীরা তাদের খুশিমতো কুলিদের ভাড়া দিবেন। বরিশাল উজিরপুরের কয়েকজন যাত্রীর অভিযোগ, ঘাটের কুলিরাই চাঁদাবাজ বনে গেছে। যাত্রীরা কুলিদের কাছে কোন মালামাল দিতে না চাইলেও কুলিরা জোর করেই তা বহন করে। বহন বাবদ মজুরি হিসেবে আদায় করা হয় অনেকটা জিম্মি করে। দাবি করা টাকা দিতে না চাইলে মালামাল পানিতে ফেলে দেয়ারও হুমকি দেন তারা। তার আগে জেটিতে প্রবেশের মুখে কুলিরা সদলবলে ঘিরে ধরে যাত্রীদের। ঘাটের হকারদের দাবি, যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় হওয়া অতিরিক্ত চাঁদার টাকা পুলিশ, ঘাটশ্রমিক ইউনিয়নের নেতা, রাজনৈতিক নেতাকর্মী, স্থানীয় প্রভাবশালী থেকে শুরু করে ঘাট কর্তৃপক্ষের মধ্যে বণ্টন হয়। তাদের চাঁদাবাজি চলে নৌকার মাঝি, ঘাটের ফলের দোকান এবং হকার থেকে শুরু করে কয়েকটি পর্যায়ে। এসব নিয়ন্ত্রণের জন্য পৃথক পৃথক লোক রয়েছে। জানা গেছে, টার্মিনালে ভ্রাম্যমাণ দোকান বসানো ও হকারির ওপর সরকারী নিষেধাজ্ঞা তোয়াক্কা না করে চাঁদাবাজরা সেখানে ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীদের সুযোগ করে দেয়। প্রতিদিন প্রতি হকারের কাছ থেকে ২০০ টাকার বেশি আদায় করা হয়। এছাড়া নদীর ওপর ভাসমান দোকানগুলো থেকে আদায় করা হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। রুটির এক হকার হারুন অর রশিদ জানান, টার্মিনালের ভাড়া, পুলিশ, কুলিদের চাঁদাসহ ফলের দোকান থেকে আদায় করা হয় ২০০ টাকা। পান, বিড়ির দোকান থেকে আদায় করা হয় ১০০ টাকা। ভাসমান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে ৩০০-৫০০ টাকা আদায় করা হয়। এই চাঁদাবাজদের কবল থেকে মাঝিদেরও রেহাই নেই। সদরঘাট থেকে বিভিন্ন ঘাটে খেয়া পারাপারকারী মাঝিদের কাছ থেকে পার্কিং এবং খাজনার নামে খেয়াপ্রতি ৭০ টাকা করে আদায় করা হয়। চাঁদাবাজদের হাত থেকে রেহাই মিলে না অটোরিক্সা ও রিক্সা চালকদেরও। ভুক্তভোগীরা জানান, টার্মিনালের উত্তরপাশে অর্থাৎ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কমিউনিটি সেন্টারের সামনের দিকের ফাঁকা স্থানে প্রাইভেট গাড়ি, মাইক্রোবাস ও অটোরিক্সা পার্কিং বাবদ নির্ধারিত ফির বাইরে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের ছত্রছায়ায় কিছু লোক সেখানে গাড়িপ্রতি ৪০-১০০ টাকা পর্যন্ত পার্কিং চার্জ নেন। সদরঘাট নৌকা মাঝি শ্রমিক লীগের সভাপতি ও ঘাট শ্রমিক লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাভেদ হোসেন মিঠু বলেন, ঘাটে যারা সার্বক্ষণিক থাকে এবং আশপাশে যাদের পোস্টার ঝুলে তারাই চাঁদাবাজি করেন। প্রতিটি ক্ষেত্রে চলে চাঁদাবাজি। সদরঘাট দিয়ে খেয়া পারাপারে প্রায় প্রতিদিনই ২৫ থেকে ৩০ হাজার লোক হয়। অথচ হিসাব দেখানো হয় ১৫ থেকে ২০ হাজার লোকের। বাকি টাকা লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া যায় সিবিএ নেতাদের বিরুদ্ধে। সূত্র জানায়, আগে ছিল ইজারাদাররা। এখন সিবিএ নেতাদের লোকজনের স্বেচ্ছাচারিতা আর অশোভন আচরণে অনেকটা জিম্মি সাধারণ যাত্রীরা। ইজারা বাতিলের পর সদরঘাট টার্মিনাল ও খেয়াঘাট সরাসরি নিয়ন্ত্রণ করে বিআইডব্লিউটিএ। আর ঘাটে আসা-যাওয়া যাত্রীদের কাছ থেকে টোল আদায় করেন সংস্থাটির কর্মচারীরা। জানতে চাইলে সিবিএ নেতা আবুল হোসেন জানান, আমরা টার্মিনালে প্রবেশ ফি টিকেট কাটার কাজটি করি। এর মধ্যে ২ টাকা জমা হয় যাত্রী কল্যাণ বাবদ, আর বাকিটা সরকারী কোষাগারে। এছাড়া এখন আর কেউ চাঁদাবাজি করে না। যারা চাঁদাবাজির অভিযোগ করেন মূলত তারাই করতেন। ৩৭নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুর রহমান মিয়াজী কাছে সদরঘাট এলাকায় চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, অতীতে এসব এলাকায় ছিনতাই, পকেটমার ছিল। কিন্তু সেই অতীতের তুলনায় এখন অনেকটাই কম। আর আমাদের কাছে এ ধরনের কোন অভিযোগ বর্তমান নেইও। সদরঘাটের হকার, নৌকা মাঝি ও যাত্রীসহ একাধিক সূত্র জানায়, সদরঘাটের আশপাশের তিনটি নৌকাঘাট থেকে কেরানীগঞ্জের আলম মার্কেট, কালীগঞ্জ, আগানগর ঘাটে ২৫০ যাত্রীবহনকারী নৌকা মানুষ পারাপার করে। এসব নৌকায় নদী পারাপারে যাত্রীপ্রতি বিআইডব্লিউটিএ নির্ধারিত টোল ৫০ পয়সা। দলগতভাবে ৮-১০ জন যাত্রী নিয়ে যেসব নৌকা যাত্রী পারাপার করে তারা প্রতি যাত্রীর কাছ থেকে ২-৫ টাকা করে ভাড়া নেয়। আর এককভাবে যে যাত্রী নৌকায় নদীর এপার থেকে ওপার যায় তাদের কাছ থেকে নেয়া হয় ২০-২৫ টাকা করে। ঘাট ব্যবহারে জনপ্রতি ফি দিতে হয় দুই টাকা।
×