
জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বেহাল
এক সময় পুরান ঢাকার বিপুল জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতিচর্চার জন্য ছিল না কোনো আধুনিক মিলনায়তন। সেই বাস্তবতায় ২০০৮ সালে অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে সূত্রাপুরের লোহারপুলে প্রতিষ্ঠিত হয় জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। তবে পুরান ঢাকায় সংস্কৃতির্চচা ও বিকাশের যে লক্ষ্যে কেন্দ্রটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটি এখন ভেস্তে যেতে বসেছে। চারতলা ভবনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলার ৪০০ আসনের মিলনায়তনটি এখন বেহাল। পরিচর্যার অভাবে ধুঁকছে। ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণুতার পথে ধাবিত এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। ফলে মিলনায়তনটি সংস্কৃতিচর্চার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। ৪০০ আসনের অধিকাংশই জোড়াতালি দিয়ে রাখা হয়েছে। ফাটল ধরেছে মঞ্চের পাটাতনে।
নড়বড়ে হওয়ায় যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে মঞ্চটি। ছাদ থেকে চুয়ানো পানি পড়ে মঞ্চের পেছনে বোর্ডে চির ধরেছে। একইভাবে লাইট ও সাউন্ড সিস্টেমও ত্রুটিপূর্ণ। ফলে এক সময় রাজধানীর আলোচিত নাট্যদলগুলো এখানে নাটক করলেও বর্তমানে অনুপযুক্ত পরিবেশের কারণে তারা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। মূলত পুরান ঢাকানির্ভর কিছু নাট্যদল ছাড়া মূল ধারার নাট্যদলের নাটক এখানে মঞ্চস্থ হয় না।
জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের দৈন্যদশা প্রসঙ্গে মঞ্চশিল্পীসহ সংশ্লিষ্টরা দুষছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনকে। তারা বলছেন, সিটি করপোরেশনের গাফিলতিতেই দিন দিন নাজুক হয়ে পড়ছে এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। মিলনায়তনের প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে দফায় দফায় সিটি করপোরেশনকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র থেকে নির্বাহী কর্মকর্তাকে সমস্যা নিরসনে পদক্ষেপ নেওয়ার একাধিকবার সুপারিশ জানানো হলেও কোনো কাজ হয়নি। এভাবে চলতে থাকলে এক সময় এই সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি অচল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
সম্প্রতি সরেজমিনে দেখা যায়, জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের জীর্ণ দশা। কেন্দ্রে প্রবেশের পূর্বেই চোখ আটকে যায় একটি ব্যানারে। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনসহ সংগঠনের স্থানীয় নেতাদের ছবিযুক্ত বিশাল সেই ব্যানারের কারণে ঢেকে গেছে কেন্দ্রের নামফলক। এরপর নিচতলার ৪৬ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয় পেরিয়ে দোতলার মিলনায়তনে প্রবেশ করতেই নাকে আসে গুমোট গন্ধ। নিয়মিত অনুষ্ঠান না হওয়ায় বিরাজ করছিল স্যাঁতসেঁতে ভাব। পরবর্তীতে চোখ চলে যায় লাল রঙের ফাইবারের তৈরি আসনগুলোয়।
সেগুলোর অনেকগুলো ভেঙে যাওয়ায় তার দিয়ে জোড়া দিয়ে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে একটি আসনে বসলে সেটি নড়বড় করে কাঁপতে থাকে। পর্যবেক্ষণে ধরা দেয় ৪০০ আসনের মধ্যে অর্ধেকের বেশি ভাঙাচোরা। আসন ছেড়ে মঞ্চে উঠতেই আরও বিবর্ণ দৃশ্য দৃষ্টিগোচর হয়। কাঠের তৈরি মঞ্চের পাটাতনের অসংখ্য স্থান ছিদ্র হয়ে গেছে। উইপোকার আক্রমণে ঘুণ ধরেছে কাঠের পাটাতনে। প্লাস্টিকের বোর্ড বসিয়ে ছিদ্রগুলো ঢেকে রাখা হয়েছে। ছিদ্রযুক্ত এবড়ো-খেবড়ো পাটাতনের কিছু জায়গায় পা রাখলে সেসব স্থান দেবে যাচ্ছিল।
এদিকে ভবনের ছাদ থেকে চুইয়ে পড়া পানিতে পচন ধরেছে মঞ্চের পেছনের দেওয়ালের বোর্ডে। ছিঁড়ে গেছে ব্যাকগ্রাউন্ডের সাদা পর্দা ও কালো কাপড়ের উইংস। এ সময় কেন্দ্রের অফিস সহকারী সুমন মিয়া জানান, লাইট এবং সাউন্ড সিস্টেমেও ঝামেলা রয়েছে। লাইটের মিকশ্চার ও ডিমার এবং সাউন্ডের মিকশ্চার ও ক্যাচার মাইক্রোফোন ঠিকমতো কাজ করে না।
এ বিষয়ে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সেক্রেটারি জেনারেল কামাল বায়েজিদ বলেন, ২০১৮ সাল পর্যন্ত ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত দলগুলো নাটক করেছে জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে। এরপর মিলনায়তনের আসন, লাইট ও সাউন্ড সমস্যার কারণে দলগুলো সেখানে নাটক করতে আগ্রহী হয়নি। এমনকি অপরিষ্কার থাকায় বাথরুম থেকে দুর্গন্ধ আসে। এছাড়া নিচতলায় কাউন্সিলরের কার্যালয় থাকায় নাটক মঞ্চায়নের অনুকূল পরিবেশ থাকে না।
এসব সমস্যার সমাধানে ফেডারেশনের পক্ষ থেকে ২০১৯ সালে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে চিঠি দেওয়া হয়। ওই চিঠিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানালেও সিটি করপোরেশন নির্বিকার ভূমিকা পালন করে। ফলে সেখানে মূল ধারার দলগুলো আর নাটক করতে যায় না। সিটি করপোরেশনের অযতœ ও অবহেলায় সাংস্কৃতিক কেন্দ্রটি ক্রমশ অচল হয়ে পড়ছে। আমাদের সিটি করপোরেশনের মেয়র থেকে কর্মকর্তারা যদি সংস্কৃতিমনা হতেন তাহলে এমনটি ঘটত না।
এ বিষয়ে কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক অমরেশ ম-ল জনকণ্ঠকে বলেন, ২০০৮ সালে এটি নির্মণ হওয়ার পর থেকে গত ১৭ বছরে কোনো সংস্কার করা হয়নি। মঞ্চের পাটাতন নিজেরা জোড়াতালি দিয়ে ঢেকে রেখেছি। আসন, লাইট, সাউন্ডসহ কেন্দ্রটির প্রয়োজনীয় সংস্কারের তাগিদ দিয়ে সিটি করপোরেশনের মেয়র থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কয়েক দফা জানিয়েও কোনো প্রতিকার হয়নি। শুধু তাই নয়, ২০২১ সাল থেকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত সাউন্ড ও লাইট অপারেটরের চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে। তাদের চুক্তির মেয়াদ নবায়নের বিষয়ে কোনো সুরাহা হয়নি।
চুক্তি নবায়নের পরিবর্তে উল্টো সিটি করপোরেশন থেকে একজন ইলেট্রিশিয়ান পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। বাধ্য হয়ে সাউন্ড ও লাইট অপারেটরকে নিজেদের তহবিল থেকে কোনোরকম খরচ দিয়ে চালিয়ে রেখেছি। এদিকে কোনো কিছু মেরামত বা সংস্কার না হলেও গত বছর গণঅভ্যুত্থানের পূর্বে এখানে একটি লিফট স্থাপন করা হয়। অথচ ওই লিফটটির পেছনে যে টাকা ব্যয় হয়েছে সেই টাকা সংস্কারের জন্য দেওয়া হলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। অপ্রয়োজনীয় লিফটটি বসানো হয়েছিল তৎকালীন মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের সুবিধার্থে।
গত বছর এই ভবনে তিনি একটি ঘুড়ি উৎসব উদ্বোধন করতে এসেছিলেন, সেটাই ছিল লিফট স্থাপনের মূল কারণ। সেই সময় তাকে কেন্দ্রের সকল সমস্যার কথা জানানো হলে সমাধানের আশ্বাস দিয়েও তিনি কোনো ব্যবস্থা নেননি। উল্টো তার সেবায় যে লিফট স্থাপিত হয়েছে সেটি এখন ব্যবহার হয় না। কারণ, লিফটে এআরডি নামের একটি যন্ত্র না থাকায় বিদ্যুৎ চলে গেলে লিফটের দরজা খোলে না। সে কারণে বিপদের আশঙ্কায় লিফট বন্ধ রাখা হয়েছে।
জহির রায়হান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ভঙ্গুর অবস্থা প্রসঙ্গে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রশাসক মো. শাহজাহান মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, এ বিষয়ে আমার জানা ছিল না। তাই বিষয়টির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে নোট করা হলো। আমাদের লোকজন পাঠিয়ে সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা হবে। পরবর্তীতে ওই কেন্দ্রের সংস্কারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
প্যানেল হু