ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জান্নাতুন নিসা

স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুষ্ঠানের আয়োজন

প্রকাশিত: ২০:৪১, ২৪ ডিসেম্বর ২০২০

স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুষ্ঠানের আয়োজন

একুশ শতকে এসে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষ ভ্রান্ত সময়ের আক্ষরিক আর্তনাদে বখাটে জ্যোৎস্নার সঙ্গী হয়েছে। স্বেচ্ছান্মুখতার তুঙ্গে পৌঁছে মনের মাধুরী ঢেলে প্রকৃতির জঠর করেছে ক্ষত-বিক্ষত। রক্তাক্ত পৃথিবী তাই থমকে গিয়ে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক অনুজীবের আলিঙ্গনে প্রলয় ডঙ্কা বাজিয়ে চলেছে বিশ্বময়। আর নভেল করোনাভাইরাসের আতঙ্কে ব্যক্তি থেকে বিশ্ব আজ পারতপক্ষে অনেকটা থেমে থেমে পথ চলছে। দীর্ঘ লকডাউনে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে অনেক কর্মক্ষেত্র এবং সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সব ধরনের সভা-সমাবেশ অর্থাৎ, গণজমায়েত বন্ধ থেকেছে। পরবর্তী সময়ে বিশ্বের প্রতিটি স্থানে লকডাউন তুলে নেয়া হলেও সামাজিক দূরত্বে থেকেই কর্মক্ষেত্রে অবস্থান, ভোট গ্রহণ-প্রদান থেকে শুরু করে অন্যান্য প্রায় সব কার্যক্রম সীমিত আকারে লোকজনের উপস্থিতিতে শুরু হয়েছে। কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান-গ্রহণ কার্যক্রম বন্ধ রেখে অর্থাৎ, অনলাইনে চালিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমরা বাঙালী- বিশ্বের বুকে ব্যতিক্রম এক জাতি। প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে আমাদের জুড়ি মেলা ভার। বাঙালীর অস্তিত্বের উৎস যিনি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে এসে আমরা মুজিববর্ষ উদযাপনের লক্ষ্যে যখন বিশ্বব্যাপী শত আয়োজন উদযাপনের পরিকল্পনার ফানুস উড়িয়েছি, তখন বৈশ্বিক মহামারীর কারণে আমাদের গণজমায়েত নিষিদ্ধ হয়েছে। আমরা আপামর বাঙালী তা মেনেও নিয়েছি। কিন্তু এখন যখন যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সব আয়োজনের সুযোগ মিলছে আমাদের জাতীয় জীবনে, তখন আমরা ধরাকে সরাজ্ঞান করে যাচ্ছি। অনুষ্ঠানের আনুষ্ঠানিকতায় করোনাভাইরাসকে স্বাগত জানাচ্ছি। কারণ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে বলছে নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে, মাস্ক ব্যবহার করে এবং নিয়মিত সাবান-পানি দিয়ে হাত ধুয়ে (কারণ সাবান পানি দিয়ে হাত ধোয়া হলে তা হাতে থাকা জীবাণুকে মেরে ফেলে) আর একই কারণে সাবান-পানি না থাকলে এ্যালকোহল সমৃদ্ধ হ্যান্ড রাব বা স্যানিটাইজার ব্যবহার করে কার্যক্রম চালাতে। সেখানে আমরা সামাজিক-সাংস্কৃতিক- রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা হল ভরপুর মানুষ না হলে বক্তৃতা প্রদানে জোশ হারানোর আক্ষেপে গুমড়ে মরছি। বিভিন্ন আয়োজনে উর্ধতন সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক নেতা কিংবা কর্র্মীরা অনেক সময়ই যেতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছেন। তবে সেই না যাওয়াটা যতটা না করোনার সংক্রমণের আশঙ্কায়, তার চেয়ে ঢের বেশি দর্শক সারিতে লোকজন কম হওয়ার কথা জেনে। আবার অনেকে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য পৌঁছলেও আয়োজকদের দু-চারটি কথা শুনিয়ে যাচ্ছেন জনসমাগম কম বলে। অকপটে তাঁরা বলে যাচ্ছেন, অমুক অনুষ্ঠানে তো লোকজনে পূর্ণ ছিল এই করোনার মধ্যেও, আপনাদের আয়োজনে দর্শক সারিতে এত কম মানুষের অংশগ্রহণ কেন! আপনারা আসন সংখ্যা এত কমিয়েছেন কেন! এত বড় হলে এত কম মানুষ মিডিয়া কভারেজ কি হবে! এমন অনেক কথা! আর নেতাদের যারা ব্যক্তিগত কর্মকর্তা তাদের কথা শুনে তো মাথা ঘুরে যাওয়ার উপক্রম হয়! কারণ তাদের সহজ প্রশ্নবাণ থাকে অনুষ্ঠান আয়োজকদের প্রতিশ্রুত কম লোকের উপস্থিতি নিয়ে কেন আয়োজন! ‘উনার মতো সম্মানী লোককে কেন আনলেন, যেখানে মাত্র ত্রিশ-চল্লিশ জন দর্শক!’ তাদের এমন কথা শুনে আয়োজকদের অবাক হতে হয়। কারণ নেতা কিংবা তাঁদের কর্মীরা হয়ত বুঝতেই পারেন না যে, নির্দিষ্ট দূরত্বের যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চল্লিশ জন দর্শকের উপস্থিতির মানে দাঁড়ায়- কম করে হলেও আশি থেকে এক শ’ জন দর্শক। কারণ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রত্যেকের কাছ থেকে কমপক্ষে এক মিটার বা তিন ফুট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। কেননা-হাঁচি, কাশি বা কথা বলার সময় মানুষের নাক বা মুখ থেকে যে ড্রপলেটস বের হয়, তাতে ভাইরাস থাকতে পারে। আর আক্রান্ত ব্যক্তির খুব বেশি কাছে গেলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে এই ড্রপলেটস কোভিড-১৯ এর ভাইরাস নিয়ে অন্যদের আক্রান্ত করতে পারে। সতর্কতা হিসেবে ভিড় এড়িয়ে চলারও পরামর্শ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটির মতে, ভিড়ের মধ্যে গেলে কোভিড-১৯ আক্রান্ত কারও সংস্পর্শে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে এবং অন্যদের থেকে এক মিটার দূরত্ব বজায় রাখাটাও সম্ভব হয় না। যে কোন অনুষ্ঠানে এসে অনেকে হয়ত ভুলেই যান যে, বৈশ্বিক মহামারী নভেল করোনাভাইরাসের প্রকোপের এই ক্রান্তিকালেও আয়োজকগণ আবেগ আর ভালবাসার পাশাপাশি বাস্তবতার নিরিখে আয়োজন করছেন উৎসব কিংবা অনুষ্ঠান! তাই হয়ত তারা সাধুবাদ দেয়ার পরিবর্তে হতাশার কথা বলে যান। অথচ তাদের প্রত্যেকের উচিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুষ্ঠান আয়োজনের বিষয়ে জোর দেয়া। কারণ লকডাউন কিংবা পরিস্থিতি যখন অনুকূলে নয়, তখন তো সব আয়োজন বন্ধই থেকেছে কিংবা থাকবে নিঃসন্দেহে! অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে, যেহেতু জনসমাগমে সমস্যা তাহলে অনুষ্ঠানগুলো কেন আয়োজন করতে হবে! আয়োজন করতে হবে কারণ, আজ হতে শতবর্ষ আগে যেমন এসেছে ১৯২০ তেমনি শতবর্ষ পরে আসবে ২১২০। কিন্তু মধ্যিখানে বাঙালী জাতির মুক্তির দিশারী সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবর্ষের যে মাহেন্দ্রক্ষণ ২০২০ অর্থাৎ, মুজিববর্ষ আমার কিংবা আমাদের জীবনে আসবে না। প্রজন্মের কাছে আয়োজনের উৎসমূল রেখে যাওয়ার দায়িত্ব আমাদের, জাতির পিতার সন্তান হিসেবে। আর বাঙালীর সাংস্কৃতিক শক্তির পরিচয়ে অনেক আগেই আধিপত্যবিস্তাকারী সাম্রাজ্যবাদকে ধূলিসাত করে আমরা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেখিয়ে দিয়েছি আমরা বীরের জাতি। ভাষার দাবিকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের পথপরিক্রমায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বজ্রকণ্ঠের উদাত্ত আহ্বানে নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা ছিনিয়ে এনেছি লাল-সবুজ একটি পতাকা, স্বাধীন-স্বার্বভৌম একটি দেশ, ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের একটি মানচিত্র। তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ থেকে আমরা এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। আমরা আজ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্বের বুকে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত হয়েছি। করোনা মোকাবেলায়ও আমরা অন্য অনেক দেশের থেকে এগিয়ে। আমরা কি করে থেমে যেতে পারি! আমাদের কথা-কবিতা-গানই তো আমাদের প্রেরণার উৎস। আমাদের প্রতিটি আন্দোলনই যার প্রমাণ। স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরাসরি কিংবা অনলাইনে অনুষ্ঠান আয়োজনের মাধ্যমেও জাতির পিতার জন্ম শতবর্ষের আয়োজন কিংবা আমাদের আয়োজিত অনুষ্ঠানের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে বিভিন্ন আয়োজন আমরা উদযাপন করতে পারি। আর এই উদযাপনের মধ্য দিয়েও বিশ্ব পরিমণ্ডলে আমাদের আয়োজনগুলো হয়ে উঠতে পারে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরের বৃহৎ ভাবনায়। যার মাধ্যমে অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রের মতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে অনুষ্ঠান আয়োজনেও বিশ্বের রোল মডেল হতে পারে বঙ্গবন্ধুর ‘সোনার বাংলাদেশ।’ লেখক : সাংবাদিক ও নারী নেত্রী [email protected]
×