ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল তুঙ্গে

প্রকাশিত: ২২:২২, ২০ ডিসেম্বর ২০২০

বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল তুঙ্গে

শরীফুল ইসলাম ॥ দলের নেতৃত্বকে কেন্দ্র করে বিএনপিতে অভ্যন্তরীণ কোন্দল এখন তুঙ্গে। চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া রাজনীতি থেকে দূরে থাকায় দলে এখন দুটি বলয় নিজ নিজ অবস্থানে থেকে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। একটি বলয় লন্ডন থেকে তারেক রহমানের নির্দেশে অন্য সিনিয়র নেতাদের আড়াল করেই কর্মকা- চালিয়ে যাচ্ছে। আর অপর বলয়টি দলে নিজেদের সাধ্যমতো কোন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারলেও অনেক সিদ্ধান্তের বেলায়ই আগাম কিছু জানেন না। এ নিয়ে দলের মধ্যে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। সূত্র জানায়, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপি মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করলেও অনেক সিদ্ধান্তের বিষয়ে তিনি কিছু জানেন না। সিদ্ধান্ত হওয়ার পর তাকে জানানো হয়। সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী লন্ডনে সরাসরি যোগাযোগ রেখে বিভিন্ন বিষয়ে প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেন। তারেক রহমান বলয়ের বাইরে থাকা কোন নেতাই আগে তা জানতে পারেন না। আর যারা তারেক রহমান বলয়ের বাইরে এমন অনেক সিনিয়র নেতা প্রেসবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর বিভিন্ন সিদ্ধান্তের কথা জেনে ক্ষুব্ধ হলেও দলে পদ হারানোর ভয়ে কিছুই বলেন না। সর্বশেষ ১৪ ডিসেম্বর কাউকে কিছু না জানিয়েই হঠাৎ করে বিএনপির দুই ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব) হাফিজউদ্দিন আহমদ ও শওকত মাহমুদকে কারণ দর্শাও নোটিস দেন দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তারেক রহমানের নির্দেশ পেয়ে নিজের স্বাক্ষরে কারণ দর্শাও নোটিস দেন তিনি। কিন্তু তার নিজের পদ ভাইস চেয়ারম্যানের নিচে হলেও কি করে মহাসচিবের সঙ্গে কোন কথা না বলে তিনি এই নোটিস দেন এ নিয়ে বিএনপির অভ্যন্তরে এখন তোলপাড় চলছে। যে কোন দিন ক্ষোভের বহির্প্রকাশ ঘটাতে পারেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। সূত্রমতে, তারেক রহমান বলয়ের বাইরে থাকা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের কিছু নেতাকে কোণঠাসা করতে রুহুল কবির রিজভীসহ কিছু নেতা উঠেপড়ে লেগেছেন। তারা চাচ্ছেন পরবর্তী জাতীয় কাউন্সিলের আগেই বিএনপির নিয়ন্ত্রণ তাদের হাতে নিতে। এর পর জাতীয় কাউন্সিল করে মহাসচিব পদসহ শীর্ষ পর্যায়ের অধিকাংশ পদ দখলে নিতে। আর দলের এ বলয়ের কারণেই এখন বিএনপির জাতীয় কাউন্সিল হচ্ছে না। যখনই তারা নিজেদের জন্য সার্বিক পরিস্থিতি অনুকূল মনে করবেন তখনই জাতীয় কাউন্সিল করবেন বলে জানা গেছে। ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে নাজেহাল করতে দলের তারেক রহমান বলয় দলের কিছু নেতাকর্মীকে ইন্ধন দেন। এই প্রভাবশালী বলয়ের ইন্ধন পেয়ে দলের উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মীরা বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের উত্তরার বাসায় হামলা করেন। কিন্তু মির্জা ফখরুল দলীয় হাইকমান্ডের হস্তক্ষেপ কামনা করেও এ বিষয়ে কোন সুরাহা পাননি। যদিও তৃণমূল পর্যায়ের ক’জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয় কিন্তু এ ঘটনার হোতাদের বিরুদ্ধে কিছুই করা হয়নি। এই কারণে মির্জা ফখরুল চরম ক্ষুব্দ হলেও রাজনীতিতে নিজের ক্লিন ইমেজ বজায় রাখতে এ নিয়ে আর কোন কথা বলেননি। দলের বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে কোন কোন নেতা নিজেদের ক্ষোভ সামাল দিতে না পেরে বিভিন্ন সময়ে অপ্রিয় কিছু সত্য কথাও বলে ফেলেছেন। সম্প্রতি একটি বেসরকারী টিভি চ্যানেলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও ব্যারিস্টার মেজর (অব) শাহজাহান ওমর বীর উত্তমের দেয়া বক্তব্য দেশব্যাপী বিএনপির তৃণমূল পর্যায়ে নানামুখী জল্পনা-কল্পনার জন্ম দেয়। এরই মধ্যে অতি সম্প্রতি বিএনপির আরেক ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে পল্টনে সরকার পতনের দাবিতে এক বিক্ষোভ কর্মসূচীতে যোগ দেন। এ নিয়ে দলের ভেতর নানামুখী আলোচনার সৃষ্টি হয়। টিভি টকশোতে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন মন্তব্য করেন খালেদা জিয়া কিসের আপোসহীন? আপোস না করলে উনি জেল থেকে বের হলেন ক্যামনে? আর মেজর (অব) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমরা, নেতাকর্মীরা সরকারের সঙ্গে আপোস করে ফেলেছি। এ কারণে খালেদা জিয়া জেল থেকে মুক্তি পেয়েছেন। তিনি আরও বলেন, তারেক রহমান কতটুকু দল চালাতে পারবেন, লন্ডনে বসে কথাবার্তা, ভাব আদান-প্রদান করা তার পক্ষে কঠিন। আরেক ভাইস চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমর বলেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে এখন যারা আছেন, তাদের বয়স হয়েছে, অনেকেই অসুস্থ। ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না। তাই স্থায়ী কমিটিতে যে শূন্য পদগুলো রয়েছে সেখানে যোগ্য নেতাদের বসিয়ে নতুন পরিকল্পনায় দল পরিচালনা করলে ভাল হবে। তিনি আরও বলেন, তারেককে নেতা মানার প্রশ্নই ওঠে না। আর আরেক ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদ নিজের নেতৃত্ব জাহির করার জন্য রুহুল কবির রিজভীদের না জানিয়ে সমমনা কিছু দলের নেতাকর্মীকে নিয়ে পল্টনে সরকার পতনের আন্দোলন করেন। এর পরপরই মেজর হাফিজ উদ্দিন আহমেদ ও শওকত মাহমুদের বিরুদ্ধে কারণ দর্শানোর নোটিস দেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী। তারেক রহমান তাদের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন বলেই রিজভীকে দিয়ে কারণ দর্শাও নোটিস দিয়েছেন বলে জানা যায়। এদিকে দলের দুই সিনিয়র নেতাকে কারণ দর্শাও নোটিস দেয়ার পর সাংবাদিকসহ বিভিন্ন মহল থেকে জানতে চাওয়া হলে এ বিষয়ে কিছুই বলতে পারেনি বিএনপি মহাসচিবসহ দলের অধিকাংশ সিনিয়র নেতা। বরং তারা এ নিয়ে বিব্রত হন বলে জানা যায়। আর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে দলের সিনিয়র নেতারা গোপনে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করে তারেক রহমান ও রুহুল কবির রিজভীর কর্মকান্ডে চরম ক্ষুব্ধ হয়েছেন বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়। দলের তারেক রহমানের নেতৃত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন আগে থেকে সিনিয়র নেতাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ ছিল। তবে তারা আশা করেছিলেন খালেদা জিয়ার সাময়িক মুক্তির পর এ সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়ে গুলশানের বাসায় অবস্থান করলেও রাজনৈতিক কর্মসূচী থেকে দূরে রয়েছেন। তাই তারেক রহমান লন্ডন থেকেই দলে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রাখেন। ইদানিং তিনি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে ভার্চুয়ালি সংযুক্ত হয়ে নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন। দলে অবস্থান খর্ব হওয়ার ভয়ে অন্য নেতারা মাথা নেড়ে সবকিছুতে সায় দেন। সূত্র মতে, দল পুনর্গঠনের ক্ষেত্রে তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্তই কার্যকর হচ্ছে। রুহুল কবির রিজভীসহ তার বলয়ে থাকা কিছু নেতাই কেবল নিজেদের স্বার্থে কোন বিষয়ে সুবিধা আদায় করে নিচ্ছেন। সিনিয়র নেতাদের একপাশে সরিয়ে রেখে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র নেতাদের সামনে নিয়ে আনতে চান তারেক রহমান। ভবিষ্যতে দলের মধ্যে তার নেতৃত্ব নিয়ে যাতে কেউ চ্যালেঞ্জ করতে না পারেন, সেজন্য নিজস্ব একটি বলয় তৈরি করেছেন তিনি। জানা যায়, দেশে যে সকল স্থানীয় সরকার নির্বাচন হচ্ছে তাতে প্রার্থী মনোনয়ন দেন লন্ডনে বসে তারেক রহমান। রুহুল কবির রিজভীসহ তারেক বলয়ের কিছু নেতা নিজেদের কোন কোন পছন্দের প্রার্থীকে মনোনয়ন পাইয়ে দিতে পারলেও বিএনপি মহাসচিব বা অন্য কোন সিনিয়র নেতা এ বিষয়ে কোন মতামতই দিতে পারেন না। যদিও মনোনয়ন বোর্ডে দলের সকল স্থায়ী কমিটির সদস্যই উপস্থিত থাকেন। স্থানীয় সরকার নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়েও তারেক রহমান বলয়ের সঙ্গে অন্য বলয়য়ের নেতাদের চরম দ্বন্দ্ব চলছে বলে জানা যায়। দলের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ক্ষোভের বহির্প্রকাশ হিসেবে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, জিয়াউর রহমানের রেখে যাওয়া বিএনপি ৪২ বছর পরে মানসিকভাবে খন্ডবিখন্ড, সাংগঠনিকভাবেও খন্ডবিখন্ড। তিনি বলেন, দল আছে, কারও সঙ্গে কারও মিল নেই। আমরা ওপেন মাঠে খেলতে পছন্দ করি না, ঘরোয়া খেলতে পছন্দ করি। এ কারণে বিগত ১২ বছরে বিএনপি আন্দোলনে সফল হতে পারেনি। বিএনপির অভ্যন্তরে ঘরোয়া খেলা বন্ধ না হলে সরকার হটানোর আন্দোলনে সফলতা আসবে না। ঘরোয়া খেলা মানে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে লাগা, একজন আরেকজনকে খাটো করা, একজন আরেকজনকে ব্যর্থ করা। সর্বশেষ শনিবার মেজর হাফিজের দেয়া বক্তব্য থেকেও বিএনপির অভ্যন্তরে কোন্দলের চিত্র ফুটে উঠেছে। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে বিএনপির কারণ দর্শানোর নোটিসের জবাব দিয়ে নিজ বাসায় আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে তিনি দল থেকে তাকে কারণ দর্শাও নোটিস দেয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বিএনপির কিছু নেতা দলে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের কোণঠাসা করতে চাচ্ছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, দলে আমার চেয়ে নিচের পদে থাকা রুহুল কবির রিজভীর দেয়া কারণ দর্শাও নোটিস পেয়ে হতবাক ও অপমানিত বোধ করে পদত্যাগের কথা ভেবেছিলাম। তবে নোটিসের জবাব দেয়ার পর বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব কি সিদ্ধান্ত নেয়, তা দেখে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব। দলের নেতাদের উদ্দেশে মেজর হাফিজ বলেন, দেশের জনপ্রিয় দল বিএনপি কেন আজকে ক্ষমতার বাইরে? কারা এর জন্য দায়ী?
×