ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বিজয়ের মাস

প্রকাশিত: ২২:২৪, ১ ডিসেম্বর ২০২০

বিজয়ের মাস

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত / ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে/ নতুন নিশান উড়িয়ে/ দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/ এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে হে স্বাধীনতা।’ বছর ঘুরে আবার এসেছে বাঙালীর অহঙ্কার বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালী তার আত্মপরিচয়, স্বাধীনতা ও স্বাধীন পতাকা পেয়েছিল যে মাসে, তার নাম ডিসেম্বর। বিজয়ের ৪৯ বছর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে দেশজুড়ে চলমান ‘মুজিববর্ষ’-এর মধ্যেই শুরু হলো বাঙালীর কাক্সিক্ষত মুক্তিসংগ্রামে বিজয় অর্জনের মাস ডিসেম্বর। আগামী বছরের ২৬ মার্চ স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর দিনটিকে সামনে রেখে এবারের বিজয়ের মাস বিশেষ তাৎপর্য বয়ে এনেছে পুরো জাতির জীবনে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের এ বিজয় শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এর পেছনে রয়েছে লাখ লাখ মানুষের রক্ত ও মহান আত্মত্যাগ। তবে এবার এক ভিন্ন আবহে এসেছে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। বিশ্ব মহামারী করোনাভাইরাসে বিপর্যস্ত পুরো পৃথিবী। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। সারাবিশ্বের মতো আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের মানুষের জীবনেও উৎসবমুখরতা অনেকটাই স্থবির। এরপরও বাঙালীর দুটি সুমহান অর্জন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী এবং মুজিব জন্মশর্তর্ষকে ঘিরে বিজয়ের মাস এই ডিসেম্বরে বাঙালী জাতি নতুন করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্দীপ্ত হবে, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের অসাম্প্রদায়িক ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত সোনার বাংলা বিনির্মাণে নতুন করে শপথ নেবে। মুক্তিপাগল বাঙালী জাতি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এই ডিসেম্বরেই ছিনিয়ে আনে হাজার বছরের লালিত স্বপ্ন প্রিয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান বিজয়। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায় লাল-সবুজের রক্তস্নাত স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাই ডিসেম্বর হচ্ছে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন জাতি ও ভূখণ্ডের স্বীকৃতি আদায়ের মাস। ২৪ বছরের পাকিস্তানী শাসন-শোষণকে পদানত করে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলার দামাল সন্তানরা ছিনিয়ে আনা বীরত্বগাঁথা বিজয় অর্জনের মাস। এমন প্রেক্ষাপটে আবারও ফিরে এলো বিজয়ের মাস। আজ ১ ডিসেম্বর। ৪৯ বছর আগে ১৯৭১ সালের এই ডিসেম্বরেই বাঙালীর নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর দু’লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এই ডিসেম্বরের ১৬ তারিখেই আমরা পেয়েছিলাম দেশের স্বাধীনতা। স্বাধীনতার স্থপতি, মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক ও বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পেয়েছিলাম একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, একটি লাল-সবুজের পতাকা। তাই ডিসেম্বর মাস বাঙালী জাতিসত্তা আর নিজস্ব ভূমির গৌরবদৃপ্ত বিজয় ও অহঙ্কারের মাস। গত কয়েক বছরের মতো এবারের বিজয়ের মাসও শুরু হয়েছে সব যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকর করার সুদৃঢ় দাবির মধ্য দিয়ে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পরপরই নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের এই বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে আরও দু’দফায় ক্ষমতাসীন হয়ে সরকার সেই বিচার কার্যক্রম আরও এগিয়ে নিচ্ছে। মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন টানা তিন মেয়াদের সরকারের সময়ে জাতির বহু কাক্সিক্ষত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম অনেকটা চূড়ান্ত রূপ পেয়েছে। ইতোমধ্যে ৪২টি মামলায় ৯৯ জন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় হয়েছে, যাদের অধিকাংশের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে। আপীল বিভাগে ১০ জনের সাজা নিষ্পত্তি হয়েছে। আর আটজনের ফাঁসির রায় কার্যকরও হয়েছে। পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী একটি অশুভ গোষ্ঠী নতুন করে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টির পাঁয়তারা চালাচ্ছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতার নামে এই অপশক্তি ধর্মের অপব্যাখ্যা ও উস্কানিমূলক বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে সংঘাত সৃষ্টির ষড়যন্ত্রে মেতেছে। এর আগে কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি জঙ্গী হামলার ঘটনাও বিশ^জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। যদিও সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কঠোর জঙ্গীবিরোধী অবস্থান ও সময়োচিত পদক্ষেপের কারণে ওই অশুভ জঙ্গীবাদী গোষ্ঠীর অপতৎপরতা অনেকটাই স্তিমিত। তারপরও ভাস্কর্যকে ইস্যু করে মৌলবাদী অপশক্তির নতুন ষড়যন্ত্র নিয়ে দেশবাসীও সজাগ ও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। এবারের বিজয়ের মাস জুড়ে স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশের পাশাপাশি মৌলবাদী অপশক্তির বিরুদ্ধে সেই ঐক্যের আহ্বানও থাকবে সারাদেশে। প্রতি বছরের মতো এবারও বিজয়ের মাসে দেশবাসী বিজয়ের আনন্দে উচ্ছ্বসিত হবে। শ্রদ্ধা, ভালবাসা ও শোকে মুহ্যমান হয়ে মাথা নোয়াবে অগণিত বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রতি। তবে করোনার কারণে এবার মহান বিজয়ের মাসের কর্মসূচী অনেকটাই সীমিত থাকবে। তারপরও নানা আয়োজনে সবার চেতনায় ধ্বনিত হবে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গাঁথার স্মৃতিচারণ আর বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালবাসা। আর বিজয়ের স্মারক ডিসেম্বরের প্রথম দিনটিতে বিভিন্ন দল ও সংগঠন আজ দেশজুড়ে পালন করবে ‘মুক্তিযোদ্ধা দিবস’। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় জাতীয় পুনর্জাগরণ, মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয়-সামাজিক-আর্থিক মর্যাদা ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মানবোধ জাগানোর লক্ষ্যে প্রতি বছরের মতো এবারও দিবসটি পালিত হবে। এ উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচী পালন করবে। সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, মুক্তিযোদ্ধা ঐক্য পরিষদ, মুক্তিযোদ্ধা ঐক্যজোট, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ ও মুক্তিযোদ্ধা সংগ্রাম পরিষদসহ বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধা সংগঠন আজ মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টায় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শিখা চিরন্তন চত্বরে সমাবেশ, শ্রদ্ধা নিবেদন ও শপথ গ্রহণের কর্মসূচী নিয়েছে। সম্মিলিত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এদিন সকাল ১০টায় রাজধানীর সেগুনবাগিচার স্বাধীনতা ভবনে সংগঠন কার্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ^াসী প্রতিনিধিদের নিয়ে বিভিন্ন জেলা-উপজেলায়ও মুক্তিযোদ্ধা দিবস উদ্যাপন কমিটি আলোচনা অনুষ্ঠান ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ নানা কর্মসূচীর আয়োজন করবে।
×