ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

আগুন সন্ত্রাস এবং অগ্নিদগ্ধ বস্তি

প্রকাশিত: ২১:১৪, ১ ডিসেম্বর ২০২০

আগুন সন্ত্রাস এবং অগ্নিদগ্ধ বস্তি

বাংলাদেশ উন্নয়নের অভিগামিতার প্রতিনিয়তই এগিয়ে যাওয়ার মহাপরিকল্পনায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। প্রবৃদ্ধির সফলতায় তা দৃশ্যমান হতেও সময় লাগছে না। গত মার্চ মাস থেকে করোনার চরম সঙ্কটে বাংলাদেশের উন্নয়নের খাতগুলো দুঃসহ ক্রান্তিকাল অতিক্রম করতে করতে বর্তমানে এক স্থিতি অবস্থায় সামনের দিকে এগিয়ে যেতে সর্বশক্তি ব্যয় করছে। যদিও করোনা আকালকে এখনও বয়ে বেড়ানোর বিপন্নতাও আমাদের তাড়িত করছে। মাঝখানে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার কমলেও বর্তমানে তা বাড়ার দৃশ্য সবাইকে আরও সাবধান হওয়ার বার্তা জানাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্ব্যর্থ কণ্ঠে আবারও সতর্ক করেছেন মাস্ক ছাড়া কোন ধরনের কাজকর্মকে আমলে নেয়া যাবে না। কারণ করোনার দ্বিতীয় ঢেউ পুনরায় বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বকে তার আগমন বার্তা জানান দিচ্ছে। ফলে ইউরোপ, আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে করোনা দুর্ভোগ আবারও নতুন মাত্রায় সবাইকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। আর আমরা শুধু যে করোনা আকালে হতচকিত তা কিন্তু নয়, তার চেয়েও বেশি দেশীয় বিভিন্ন অরাজক পরিস্থিতিও বর্তমান দুঃসময়কে নিয়তই আরও দুরবস্থার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অগ্রগতির সুবর্ণ সময়ে হরেক রকম অসঙ্গতিও দেশকে চরম অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে, যা সামলাতে সংশ্লিষ্টরা হিমশিম খাচ্ছে। নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় অপরাধীদের নতুন আইনী প্রক্রিয়ায় শাস্তির বিধান এসেছে। প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা সত্ত্বেও অনৈতিক কর্মযোগ সবাইকে হতভম্ব এবং স্তম্ভিত করে দিচ্ছে। স্বল্প পরিসরে সার্বিক দুর্দশার চিত্র আসলেই বলা মুশকিল। এমন সব বিপাকে ১২ নবেম্বর অনুষ্ঠিত উত্তর সিটি কর্পোরেশনের শূন্য আসনে নির্বাচনের সময় নতুন করে আগুন সন্ত্রাসের সহিংসতায় সবাই স্তব্ধ হয়ে যায়। আমরা জানি অপরাজনীতি আর পেশী শক্তির হরেক রকম অপকৌশলের মধ্যে আগুন দিয়ে মানুষ আর যন্ত্রযান পুুড়িয়ে দেয়ার কুমনোবৃত্তিও বিভিন্ন সময় সংবাদমাধ্যমের খবর হয়ে আসে। সেই ২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আগুনের লেলিহান শিখা যে মাত্রায় সারাদেশকে দগ্ধ করে দেয় তেমন ন্যক্কারজনক সহিংসতা এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়ার কথা নয়। গণপরিবহনে আগুন লাগিয়ে শুধু যে গাড়িটি পোড়ানো হয়েছে তা কিন্তু নয় যাত্রীরাও জ্বলন্ত শিখায় মৃত কিংবা দগ্ধ অবস্থায় নিজেদের সর্বনাশ দেখেছে। এর আগে গণজাগরণ মঞ্চে পাক হানাদার বাহিনীর দালাল ও যুদ্ধপরাধীর বিচার প্রক্রিয়ায় সারাদেশে যে অগ্নিস্নাত প্রদাহের উৎপত্তি হয় তাও সে সময়ের এক জ্বলন্ত স্ফুলিঙ্গ। ঘৃণ্য অপরাজনীতির চরম নৈরাজ্যবাদের অশনি সঙ্কেতে বাংলাদেশ ক্ষতবিক্ষত আর বিপর্যস্ত হয়ে যে দুঃসময়কে আলিঙ্গন করেছিল তাকে কোনভাবেই ক্ষমা করা যায় না। জনগণের কাছ থেকে বিদায় নিতে হয়েছে সে সব ঘৃণ্য অপরাধীর। ইতিহাসের চূড়ান্ত রায়ে তারা নিজেরাই তাদের কবর খুঁড়েছে। প্রতিবারই নির্বাচনের সময় এলে হঠকারী পদক্ষেপে দুর্ধর্ষ নেতারা নড়ে-চড়ে বসে। স্থির সিদ্ধান্তে, সুপরিকল্পিতভাবে নতুন অপকৌশল তৈরির পাঁয়তারা করে। সেখানে আগুনই হলো তাদের ব্রহ্মাস্ত্র। এবারের প্রয়াত সাহারা খাতুনের শূন্য আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে পেশীশক্তি তাদের দুর্বৃত্তায়নের ফন্দি-ফিকিরে আবারও আগুন সন্ত্রাসের দুঃসহ খেলায় নামে। রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি স্থানে ১০টি বাস পুড়িয়ে তাদের তাণ্ডবলীলা চালায়। ফোনালাপ ফাঁস হয়ে যাওয়া থেকে শুরু করে আটক হওয়া আসামিরা যে বয়ান দেয় তাতে কারও বুঝতে অসুবিধা হয়নি এমন ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের মূল হোতা কারা। যাদের সন্দেহ করা হয়েছে, যারা অপরাধীর কাতারে বিবেচনায় ছিল মূলত তারাই বাস্তব প্রেক্ষাপটে জনসমক্ষে হাজির হতে বাধ্য হয়েছে। আগুনের লেলিহান শিখা থেকে কত মানুষের যাপিতজীবন মুহূর্তের ঝড়ে তছনছ হয়ে যায় তাও এক ধরনের বিভীষিকা। হতদরিদ্র, ছিন্নমূলদের ন্যূনতম আস্তানা বস্তি এলাকায়ও পড়ে পেশীশক্তির কু দৃষ্টি। ফলে বস্তিতে আগুন লাগাও এক প্রকার জবর দখলকারীদের দৌরাত্ম্য হিসেবে ভাবা হলেও তেমন সামাজিক অভিশাপকে প্রতিরোধ করা যায় না। সেখানেও এক অশনি সঙ্কেত এবং অপশক্তির নির্মম বেষ্টনীকে ধারণা করতে কারও অসুবিধা হয় না। শীতের মৌসুমে শুষ্ক আবহাওয়ায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা প্রতিবছরই নানামাত্রিকে সংশ্লিষ্টদের জীবনকে বিপন্ন করে দেয়। নিয়মিত ঘটে যাওয়া এমন সব অগ্নিদুর্বিপাককে অনেকেই পরিকল্পিত এবং পেশীশক্তির নাশকতাকেই আমলে নেন। কিন্তু যথাযথ প্রমাণ উন্মোচিত না হওয়ায় সঙ্কট যে গভীরে সেই তিমিরেই থেকে যায়। সম্প্রতি পর পর তিন দিনের মধ্যে রাজধানীতে তিনটি বস্তি পুড়ে যাওয়ার ভয়ঙ্কর অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটে। সেটা কি নিছক দুর্ঘটনা না কি পরিকল্পিত নাশকতা? এমন প্রশ্ন অগ্নিসংযোগের পর পরই উঠতে থাকে। কিন্তু তার যথাযথ প্রতিকার কখনও হয় না। মঙ্গলবার রাজধানীর পল্লবীর কালশীর বাউনিয়াবাদের বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বস্তিতে ভয়ঙ্কর অগ্নিদুর্বিপাকে প্রায় ৫৫টি ঘর-বাড়ি ভস্মীভূত হয়ে যায়। তার মধ্যে ৪৩টি বসতবাড়ি এবং ১২টি দোকানঘর। গত বছরের ডিসেম্বরেও নাকি ঠিক এই বস্তিতেই আগুন লাগে। মাত্র ১১ মাসের মাথায় আবারও অগ্নি দুর্ঘটনা ঘটল। তবে স্থানীয়দের অভিযোগ পরিকল্পনামাফিক আগুন ধরিয়ে দেয়া হয় দুই দলের মধ্যে দখলদারিত্ব আর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে। কারণ নতুন করে যখন বস্তি পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয় সেখানে আগের তুলনায় জমির সীমানা তো কমেই হরেক রকম জটিলতায় বস্তিবাসীদেরও নাজেহাল হতে হয়। গত মঙ্গলবার বিকেলেই আগুন লাগে মোহাম্মদপুরের বিহারিপট্টিতে। তার আগে মহাখালীর সাততলা ভবনের বস্তিতেও আগুন ধরে যায়। হতাহতের খবর না থাকলেও নিত্যপ্রয়োজনীয় বেশ কিছু মাল পুড়ে ছাই হয়ে যায়। অভিযোগ ওঠে এসব বস্তির বিদ্যুত এবং গ্যাস লাইনও নাকি অবৈধ। অপরিকল্পিত এসব অনৈতিক তার ও লাইন থেকেও অগ্নিসংযোগ হওয়ার আশঙ্কাকে উড়িয়ে দিতে চায় না ভুক্তভোগীরা। তাদের মতে স্থানীয় দখলদার আর দুর্বৃত্তের কারসাজিতে অবৈধ বিদ্যুত, গ্যাস লাইনে সংযোগ দেয়া হয়। সেখান থেকে জবর দখলকারীরা কোটি কোটি অর্থ নিজেদের পকেটে নিয়ে আসে। আগুন যে আসলে কিভাবে লাগে আর কোন্ গতিতে ছড়ায় তাও বস্তিবাসীর চিন্তার অতীত। সন্দেহের তীর থাকে সব সময় আধিপত্য বিস্তারকারীদের দিকে। কিছু সুবিধাভোগীর দৌরাত্ম্যে বস্তিবাসীর প্রতিদিনের জীবন এমনিতেই সঙ্কাটাপন্ন হয়। ঘরের শিশু-কিশোরীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। শুধু তাই নয় শ্রমঘন, অসচেতন এবং শিক্ষার বলয় থেকে দূরে থাকা অল্প বয়স্ক বস্তিবাসী কিশোররাও তাদের মূল্যবান সময় ও জীবনকে বলি দিতে হয় এমন সব গডফাদারের পেশীশক্তির দাপটে। এখানে মূলত থাকে রিক্সা চালক, দিনমজুর, পোশাক শ্রমিক নামে মাত্র টাকার বিনিময়ে। যারা নিজেরাই তাদের অধিকার এবং স্বাধীনতা নিয়ে ভাবতেও পারে না। কোন মতে সামান্য কর্মের বিনিময়ে পাওয়া অল্প আয়ে সংসার চালায়। না আছে অর্থ, শিক্ষা, সচেতনতা, স্বাস্থ্যসেবা কিংবা নিজের বলে কিছু দাবি করা। নিরাপত্তার অপর্যাপ্ততায় তারা মেয়েদের নিয়েও পড়ে চরম বিপদে। বলা হচ্ছে এসব শ্রমঘন বস্তি এলাকার শিশু আর কিশোরী কন্যারাই ধর্ষণের শিকার হয় বেশি। স্থানীয় প্রভাবশালী এমনকি মস্তানদের চরম দাপটে বস্তিবাসীর নাভিশ্বাস হওয়ার উপক্রম। দুই দলের আধিপত্য নিয়ে শুধু যে তারাই নৃশংস কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয় তা কিন্তু নয়, তার চেয়েও বেশি দাম দিতে হয় বস্তিবাসীকে। পেশীশক্তির দৌরাত্ম্যের প্রতিযোগিতায় এলাকাবাসী নাজেহালই নয় তাদের সর্বস্ব হারাতেও সময় লাগে না। যথাযথ অপরাধ প্রমাণ করাও এক দুঃসহ যাত্রাপথ। ধরাছোঁয়ার বাইরে এসব দুর্বৃত্তকে আইনের আওতায় আনাও এক অসম সাহসিক কাজ। তেমন দুঃসাহস দেখার মতো মানসিক কিংবা বৈষয়িক শক্তিও বস্তিবাসীর থাকে না বললেই চলে। তবে নগর পরিকল্পনাবিদরা সমস্ত অভাব-অভিযোগের প্রেক্ষাপটে পরামর্শ দিয়েছেন জোর এবং যথাযথ তদন্তের ব্যাপারে আরও কঠোর নজরদারি বাড়ানো সময়ের দাবি। শুধু তাই নয় কতিপয় অশুভ শক্তির দাপটে নিরীহ, অসহায়, সাধারণ মানুষ নিজেদের মান-অপমান, বসতবাড়ি খুইয়ে বসবে তেমন দুঃসহ ঘটনা দিনের পর দিন মেনে নেয়াও কঠিন। তদন্ত ব্যাপারটি ছাড়াও এমন অগ্নি দুর্ঘটনায় বিশেষ করে বস্তি এলাকায় পুলিশের কাছে মামলা পর্যন্ত আসে না। যখন আসে সে সময় অপরাধের অনেক চিহ্ন ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায়। সমাজের আনচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বস্তিবাসীর অবস্থান যেমন দৃশ্যমান পাশাপাশি স্থানীয় অপরাজনীতি, দুর্নীতিবাজ এবং জবরদখলকারীদের দাপটও বেশ শক্তিশালী। তাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোই অদৃশ্য এক যাঁতাকলে পিষ্ট। যার কারণে তদন্ত যতই হোক না কেন নাশকতার প্রমাণ একেবারেই মেলে না। করোনার চরম আকালেও দুষ্টচক্র তার অপরাধপ্রবণতা থেকে সামান্যতম সরে যায়নি। ষড়যন্ত্রের আভাস থাকলেও তা কখনও জনসমক্ষে উঠে আসে না। বস্তির নিয়ন্ত্রণে যুক্ত থাকে অসাধু ব্যবসায়ী, নীতি-নৈতিকতাহীন অপরাজনীতির নেতা ছাড়াও স্থানীয় ক্ষমতাবান ষড়যন্ত্রকারীরা। যারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে মরণের খেলায় মেতে ওঠে। জ্বালিয়ে পুড়িয়ে সব ছারখার করে দেয়। মানুষের মূল্যবান জীবন নিয়ে অপশক্তির রাজত্ব কায়েম করে। অগ্রসরমান বাংলাদেশের সমৃদ্ধির জোয়ারে এখনও যে প্রবল প্রতিবন্ধকতা সমাজের বিভিন্ন জায়গায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তাকে সমূলে উৎখাত করতে ব্যর্থ হলে বিপন্ন পরিস্থিতি বার বার মাথা চাড়া দেবে। সকলের সচেতন দায়বদ্ধতা এবং সার্বিক সহযোগিতায় অপরাধী চক্রকে চিহ্নিত করাও অপরিহার্য কর্মযোগ। আভাস মিলছে, সন্দেহ করা হচ্ছে কারা অভিযুক্ত, অথচ এমন এক ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার সেখান থেকে সংশ্লিষ্টদের বের করে আনা কেন সম্ভব হচ্ছে না তা প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই যায়। কারণ অপরাধীরা ধরা পড়লে আরও কোন রাঘব বোয়াল রঙ্গমঞ্চে অবতীর্ণ হবে কিনা তাও বিবেচনার দাবি রাখে। অসহায় এবং নিম্নবিত্ত মানুষদের নিয়ে এমন অশুভ কারসাজি থামানোও জনস্বার্থে জরুরী। লেখক : সাংবাদিক
×