ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

অপকর্ম থামছে না ॥ সহস্রাধিক অবৈধ বিদেশীর

প্রকাশিত: ২২:৪৭, ২৪ নভেম্বর ২০২০

অপকর্ম থামছে না ॥ সহস্রাধিক অবৈধ বিদেশীর

শংকর কুমার দে ॥ দেশে বর্তমানে ১০ দেশের ১১ হাজার অবৈধ বিদেশী নাগরিক অবস্থান করছে। এর মধ্যে প্রায় এক হাজার বিদেশী নাগরিক নানা ধরনের অপরাধের সঙ্গে জড়িত। অপরাধের মূল ক্ষেত্র তথ্য ও প্রযুক্তি। অবৈধভাবে বসবাসকারী এসব বিদেশী নাগরিকের বেশিরভাগই আফ্রিকান। গত দুই মাসে এই ধরনের বিদেশী অপরাধী চক্রের শতাধিক লোককে গ্রেফতার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়ে পাচার করে দিয়েছে বিদেশী অপরাধী চক্রটি। বিদেশী নাগরিকদের অপরাধে সহায়তা করছে দেশীয় অপরাধী চক্রের সদস্যরা। পুলিশ জানিয়েছে, বিদেশী নাগরিকদের অপরাধের বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করা হচ্ছে। অবৈধ বিদেশীদের একটি ডাটাবেজ তৈরির কাজ করছে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি)। ডাটাবেজ তৈরির কাজ শেষ হলে অবৈধ বিদেশীদের অপরাধ তদন্ত আরও সহজ হবে। পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীতে সহস্রাধিক অবৈধ বিদেশী নাগরিক প্রতারণা, ক্রেডিটকার্ড জালিয়াতি, জঙ্গী তৎপরতা, আদম পাচার, জাল ডলার ব্যবসা, মাদক পাচারের মতো অপরাধে জড়িত। বিদেশী অপরাধীরা ইন্টারনেট, ফেসবুক, ই-মেইল, হোয়াটসএ্যাপ, মেসেঞ্জারসহ নানা ধরনের পদ্ধতিতে প্রতারণার ফাঁদ পেতে থাকে। প্রতারণার ফাঁদে পড়ে অনেকেই লোভের বশে রিক্ত নিঃস্ব হচ্ছেন। ওসব বিদেশী নাগরিককে সহায়তা করছে অপরাধের সঙ্গে জড়িত এদেশের কিছু নাগরিক, যারা অপরাধী চক্রের সঙ্গে জড়িত। প্রতি বছরই কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে আন্তর্জাতিক এই অপরাধী চক্র। স্পেশাল ব্রাঞ্চের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে অবৈধভাবে বসবাসকারী ১১ হাজার বিদেশীকে চিহ্নিত করেছে সরকার। তাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব নাগরিকের ভিসার মেয়াদ শেষ হলেও তারা নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার কোন উদ্যোগ নেয়নি। কিছু দেশের দূতাবাসও বাংলাদেশে নেই। তাই তাদের ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেয়া জটিল হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন সময়ে আফ্রিকাসহ নানা দেশের নাগরিক ভিসা নিয়ে বৈধভাবে বাংলাদেশে এসেছেন এখন যাদের ভিসা এবং পাসপোর্ট কোনটিরই মেয়াদ নেই। এদের কিছু সংখ্যক অপরাধে জড়িয়ে কারাগারে বন্দী রয়েছেন আবার কিছু সংখ্যক অবৈধভাবে বসবাস করছেন। তাদের আবার কেউ কেউ অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। করোনাভাইরাসের সুযোগ নিয়ে অনলাইনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া অবৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশী চক্রের তৎপরতা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবি। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, একজন মার্কিন নারী সেনা অফিসার পরিচয় দিয়ে সম্প্রতি কয়েকজন নাইজিরিয়ার নাগরিক প্রতারণা করে বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে এমন এক অভিযোগের ভিত্তিতে ১৫ জনকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। রাজধানীর পল্লবীসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে ওই চক্রের ১৫ জনকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে তারা মিথ্যা তথ্যে ও অসদুপায়ে ভিসা ছাড়া বাংলাদেশে অবস্থান করে ডলার বা গিফট দেয়ার নামে প্রতারণা করে আসছিল। গিফট দেয়ার নামে এ পর্যন্ত তারা বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাত করেছে। গ্রেফতারের পর রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারকৃত নাইজিরিয়ান নাগরিকরা সিআইডিকে বলেছে, আমেরিকান নারী সেনা অফিসারের ভুয়া ফেসবুক আইডি ও হোয়াট্স এ্যাপ ব্যবহার করে গ্রেফতারকৃতরা বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের মানুষের সঙ্গে তাদের ব্যবহৃত ল্যাপটপ ও মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে ব্যক্তিগত আকর্ষণীয় ছবি পাঠিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করে। পরবর্তীতে মেসেজের মাধ্যমে বলে, সে ইয়েমেন, আফগানিস্তানে বা সিরিয়াতে আছে। তার কাছে কয়েক মিলিয়ন ডলার রয়েছে কিন্তু ওই দেশে যুদ্ধ চলমান থাকায় যেকোন সময় সেগুলো নষ্ট হতে পারে। তাই নতুন বন্ধুকে ডলার বা এই মূল্যমান সম্পদ গিফট করতে চায়। যদি বেঁচে থাকে তাহলে এগুলো পরে ফেরত নেবে বলেও জানায়। এই ধরনের প্রলোভন দিয়ে প্রথমে বন্ধুদের ঠিকানাসহ মোবাইল নম্বর নেয় এবং ওই ঠিকানায় বন্ধুদের মেসেঞ্জারে/ হোয়াট্স এ্যাপে গিফট প্যাকেটের ছবি পাঠায়। পরবর্তী মেসেজে যেকোন একটি এয়ারলাইনসে গিফট প্যাকেটটি বুকিং দেয়া হয়েছে এরকম রশিদের ছবি পাঠায়। ঠিক দুই দিন পর বন্ধুর (ভুক্তভোগীর) মোবাইলে ফোন করে ভিডিওকলে এয়ারপোর্ট কাস্টমস অফিসে থাকা গিফট প্যাকেট দেখায় এবং কাস্টমসের ভ্যাট বাবদ বিভিন্ন ধাপে টাকা নিতে থাকে। এভাবে অসংখ্য লোকের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, এর আগে রাজধানীর পল্লবী থানা এলাকা থেকে এক বাংলাদেশী নারীসহ ১২ নাইজিরিয়ানকে গ্রেফতার করেছে পুলিশের অপরাধ বিভাগ-সিআইডি। তাদের গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদে পেয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য। সিআইডি বলছে, ফেসবুকে বন্ধুত্বের পর দামি উপহার দেয়ার নামে প্রতারণা করে গত কয়েক মাসে পাঁচ থেকে ছয় কোটি টাকা আত্মসাত করেছে এই চক্র। তারা অভিনব কায়দায় বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তিদের সঙ্গে ফেসবুকে বন্ধুত্ব তৈরি করে। বন্ধুত্বের এক পর্যায়ে তারা একটি মেসেঞ্জার থেকে একটি উপহার পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। পরে মেসেঞ্জারে এইসব মূল্যবান সামগ্রীর এয়ার লাইন বুকিংয়ে ডকুমেন্ট পাঠায়। এরপর এসব উপহারের বক্সে কয়েক মিলিয়ন ডলারের মূল্যবান সামগ্রী রয়েছে বলেও ভুক্তভোগীকে জানায়। সিআইডির একজন কর্মকর্তা বলেন, গ্রেফতারকৃত বিদেশী অপরাধী চক্রের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, নানা কায়দায় দেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে আফ্রিকান প্রতারক চক্র। কখনও চাকরি দেয়ার নাম করে, কখনও লটারি পেয়েছেন এমন এসএমএস বা মেইল পাঠিয়ে, আবার বিদেশ থেকে দামী উপহার পাওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে প্রতারণা করছে চক্রটি। এই চক্রের সঙ্গে রয়েছে দেশী এক শ্রেণীর প্রতারক। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে প্রায়ই বিদেশী এই চক্রের সদস্যরা আটক হলেও ছাড়া পেয়ে আবার একই কাজ করছে। এসব অপরাধীদের মধ্যে রয়েছে নাইজিরিয়া, ক্যামেরুন, কঙ্গোসহ অন্যান্য দেশের নাগরিক। এদের বেশিরভাগ প্রতারণা, মাদক ব্যবসা, জাল টাকা তৈরি ও বিক্রিসহ নানা অপরাধের সঙ্গে জড়িত। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আফ্রিকান এসব প্রতারকরা বায়িং হাউসের ব্যবসার নামে এবং বিভিন্ন ক্লাবে চুক্তিভিক্তিক খেলোয়াড় হিসেবে বাংলাদেশে আসেন। এরপর তারা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। তাদের অপরাধমূলক কাজে দেশের বাইরে থেকেও অন্য বিদেশীরাও সহায়তা করছে। একইসঙ্গে দেশীয় কিছু লোক টাকার বিনিময়ে তাদের সঙ্গে কাজ করছে। এসব প্রতারকদের গ্রেফতার করে আদালতে তোলার পর জামিন নিয়ে বেরিয়ে যায় তারা। একবার জামিনের পর তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। স্পেশাল ব্রাঞ্চের একজন কর্মকর্তা বলেন, অবৈধভাবে বা বৈধভাবে বসবাসকারী বিদেশী প্রতারক চক্রের প্রতারণার অভিযোগে গ্রেফতারের পর বিদেশী নাগরিকের ডাটাবেজ তৈরির কাজ করছে পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি)। স্পেশাল ব্রাঞ্চের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন মাসে প্রায় ১ হাজার বিদেশীর ওপর অনুসন্ধান ও নজরদারি করেন তারা। এসব বিদেশী নাগরিকের নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার তথ্য ও তালিকা পেয়েছেন তদন্তকারীরা। তাদের ওপর যথাযথ নজরদারি নেই। অবৈধ বিদেশীরা কোথায়, কী ধরনের কাজ করছে, অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে কি না সেই বিষয়ে নিয়মিত নজরদারি বা আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণপূর্বক পদক্ষেপ নেয়ার উদ্যোগ নেই। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশে যেসব বিদেশী বসবাস বা অবস্থান করছে তাদের মধ্যে কালো আফ্রিকান নাগরিক যারা তারাই বেশিরভাগ নানা ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর আফ্রিকা অঞ্চলের কিছু মানুষ তাদের পাসপোর্ট ফেলে দিচ্ছে। এরপর তাদের অবস্থানে সহযোগিতা করছে স্থানীয় কিছু অর্থলোভী নারী-পুরুষ। শুধু তাই নয়, অপরাধেও মদদ জোগানো হচ্ছে। ধরা যদি কেউ পড়েও জামিনে বেরিয়ে ফের অপরাধে জড়াচ্ছে। বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশী অপরাধীদের শনাক্ত করার পর তালিকা তৈরি করে ফেরত পাঠানোসহ আইনানুগ ব্যাবস্থা গ্রহণের বিষয়ে কী করণীয় তা নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর সঙ্গে কাজ শুরু করার উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবি।
×