ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এক দশকেই দেড় হাজার কোটি টাকার মালিক

প্রকাশিত: ২২:৫৩, ২২ নভেম্বর ২০২০

এক দশকেই দেড় হাজার কোটি টাকার মালিক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ মাত্র এক দশকেই দেড় হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়াটা যেমন ছিল বিস্ময়কর তেমনি তার গ্রেফতারটাও অবিশ্বাস্য। শনিবার ভোরে র‌্যাব ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত পরিচিতজনরা বিশ্বাস করত- গোল্ডেন মনির থাকবে ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু র‌্যাব দীর্ঘ নজরদারিতে রেখেই তাকে টানা আট ঘণ্টার অভিযান চালিয়ে আটক করে। শনিবার রাজধানীর বাড্ডা এলাকার গডফাদার হিসেবে পরিচিত এই গোল্ডেন মনিরকে গ্রেফতার করার পর র‌্যাব জানিয়েছে- তার উত্থান ছিল রীতিমতো বিস্ময়কর। এভাবে এত স্বল্প সময়ে হাজার কোটি টাকার মালিক হতে পারে, সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। গোল্ডেন মনিরের পাশাপাশি তিনি জমজম টাওয়ারের মালিক হিসেবেও পরিচিত। কয়েক বন্ধুর সহযোগিতায় তিনি উত্তরায় সবচেয়ে বিলাসবহুল শপিং টাওয়ার হিসেবে আলোচিত জমজম টাওয়ার নির্মাণ করেন। র‌্যাবের মতে- নব্বইর দশকে রাজধানীর গাউছিয়ায় একটি কাপড়ের দোকানে সেলসম্যান হিসেবে কাজ করতেন মোঃ মনির হোসেন। এর পর শুরু করেন ক্রোকারিজের ব্যবসা। তারপর লাগেজ ব্যবসা অর্থাৎ ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে তিনি বিভিন্ন দেশ থেকে মালামাল আনতেন। একপর্যায়ে জড়িয়ে পড়েন সোনা চোরাকারবারে। এরপর তাকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। অবৈধভাবে সোনা চোরাচালান, জালিয়াতির মাধ্যমে ভূমি দখল করে এখন তিনি হাজার কোটি টাকার মালিক। অবৈধ অস্ত্র ও মাদকসহ রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় গাড়ি ও সোনা ব্যবসায়ী মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরকে গ্রেফতারের পর এ তথ্য জানিয়েছে র‌্যাব। রাতভর অভিযানের পর শনিবার বেলা সাড়ে ১১টায় ঘটনাস্থলে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব সদর দফতরের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ অবৈধপথে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে নিয়ে এসেছেন গোল্ডেন মনির। আমাদের কাছে তথ্য রয়েছেÑ তার সোনা চোরাকারবারের রুট ছিল ঢাকা-সিঙ্গাপুর-ভারত। এসবই তিনি করেছেন ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে। যেখানে তার নাম হয়ে যায় গোল্ডেন মনির। সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব-৩ এর একটি দল শুক্রবার রাত ১১টায় মেরুল বাড্ডা ডিআইটি প্রজেক্ট এলাকায় অবস্থান নেয়। অভিযানের মূল কারণ ছিল অবৈধ অস্ত্র ও মাদক। মনির হোসেন ওরফে গোল্ডেন মনিরকে গ্রেফতারের পর তার হেফাজত থেকে একটি বিদেশী পিস্তল, কয়েক রাউন্ড গুলি, বিদেশী মদ এবং প্রায় ৯ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা পাওয়া যায়। তার বাসা থেকে আট কেজি স্বর্ণ ও নগদ এক কোটি ৯ লাখ টাকা জব্দ করা হয়েছে। গোল্ডেন মনির ওরফে মোঃ মনির হোসেন সম্পর্কে তথ্য তুলে ধরে লেফটেন্যান্ট কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, তিনি মূলত একজন হুন্ডি ব্যবসায়ী, স্বর্ণ চোরাকারবারি এবং ভূমির দালাল। তার একটি অটোকার সিলেকশন শো রুম আছে। পাশাপাশি রাজধানীর গাউছিয়ায় একটি স্বর্ণের দোকানের সঙ্গে তার সম্পৃক্ততা রয়েছে। আমরা তার বাসা থেকে অনুমোদনবিহীন বিলাসবহুল দুটি বিদেশী গাড়ি জব্দ করেছি, যার প্রত্যেকটির দাম প্রায় তিন কোটি টাকা। এর পাশাপাশি কার সিলেকশন শো রুম থেকেও আমরা তিনটি বিলাসবহুল অনুমোদনবিহীন গাড়ি জব্দ করেছি। গ্রেফতারকৃত মনির নব্বইর দশকে রাজধানীর গাউছিয়ায় একটি কাপড়ের দোকানের কর্মচারী ছিলেন। সেটা ছেড়ে তিনি ক্রোকারিজের ব্যবসা শুরু করেন। এরপর লাগেজ ব্যবসা অর্থাৎ ট্যাক্স ফাঁকি দিয়ে তিনি বিভিন্ন মাল দেশে আনতেন। একপর্যায়ে তিনি সোনা চোরাকারবারিতে জড়িয়ে বিপুল পরিমাণ সোনা অবৈধপথে বিদেশ থেকে বাংলাদেশে আনেন। তার নাম হয়ে যায় গোল্ডেন মনির। সোনা চোরাকারবারে জড়ানোয় ২০০৭ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হয়। সেই মামলা ছিল ধামাচাপায়। গোল্ডেন মনিরের আরেকটি পরিচয় তিনি ভূমিদস্যু। রাজউকের কিছু অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। ঢাকা শহরে ডিআইটি প্রজেক্টের পাশাপাশি বাড্ডা, নিকুঞ্জ, উত্তরা ও কেরানীগঞ্জ এলাকায় তার দুই শতাধিক প্লট আছে। ইতোমধ্যে তিনি তার ৩০টি প্লটের কথা র‌্যাবের কাছে স্বীকার করেছেন। রাজউকের কাগজপত্র জালিয়াতি করে তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ-সম্পদ করেছেন এবং স্বর্ণ চোরাচালানের মাধ্যমে তার সম্পদের পরিমাণ প্রায় এক হাজার ৫০ কোটি টাকা। আমরা প্রাথমিকভাবে তার বিরদ্ধে আরও কিছু অভিযোগ পেয়েছি। তার বিরদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্তের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন, বিআরটিএ, মানি লন্ডারিংয়ের জন্য সিআইডি এবং ট্যাক্স ফাঁকি ও এ সংক্রান্ত বিষয়ে এনবিআরকে অনুরোধ জানাব। মূলত তার বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধ অর্থাৎ অনুমোদনবিহীন বিদেশী মুদ্রা রাখায় বাড্ডা থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা দায়ের করবে র‌্যাব। পাশাপাশি অস্ত্র ও মাদক আইনে পৃথক দুটি মামলা করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে আশিক বিল্লাহ বলেন, মূলত ফৌজদারি অপরাধের কারণে অর্থাৎ অনুমোদনবিহীন বিদেশী অস্ত্র ও মাদক রাখার অপরাধে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তার এই আইনবহির্ভূত আয়-উপার্জন, অর্থসম্পদ গড়াসহ কারা জড়িত, যোগসাজশ এবং সহযোগিতা করেছে সেটি তদন্ত করতে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানাবে র‌্যাব। তার অর্থ-সম্পদ গড়ার পেছনে এনবিআর, বিআরটিএ, রাজউকের কোন কোন কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতা বা যোগসাজশ রয়েছে তা খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে অনুরোধ জানাব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, গোল্ডেন মনিরের সঙ্গে প্রাথমিকভাবে আমরা একটি রাজনৈতিক দল ওতপ্রোতভাবে জড়িত বলে জানতে পেরেছি। সেই দলটিতে তিনি অর্থের জোগান দিতেন। মোঃ মনিরের বিরুদ্ধে দুটি মামলা ইতোমধ্যে চলমান- একটি মামলা হচ্ছে রাজউক সংক্রান্ত। রাজউকের ভুয়া সিল-স্বাক্ষর জাল, ভূমিদস্যুতা এবং আরেকটি হচ্ছে দুদকের একটি মামলা চলমান। গোল্ডেন মনিরকে এখন র‌্যাব-৩ কার্যালয়ে নেয়া হয়েছে। সেখানে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে যতটুকু জানা যায়- অবৈধভাবে স্বর্ণ আমদানি এবং ভূমি দখল বাণিজ্য করে মনিরুল ইসলাম ওরফে গোল্ডেন মনির হাজার কোটি টাকার অধিক মূল্যের সম্পদ গড়েছেন। রাজউকের কিছু অসাধু কর্মকর্তার সহায়তায় শুধু সিল নকল করে রাজধানীতেই ২০০টির বেশি প্লট কব্জা করেছেন তিনি। উত্তরায় যে জমিতে বহুল আলোচিত জমজম টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে সেই জমিরও কাগজপত্র সম্পর্কে খোঁজখবর নিচ্ছে র‌্যাব। এ বিষয়ে রাজ্উককে চিঠি দিয়ে জানতে চাইবে র‌্যাব। গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধানে নেমে ঘটনার সত্যতা পেয়েছে র‌্যাব। গোল্ডেন মনিরের অটোকার সিলেকশনের শোরুম রয়েছে। তবে আমদানি নিষিদ্ধ পাঁচটি বিলাসবহুল গাড়ি রয়েছে তার। যার প্রতিটির মূল্য তিন কোটি টাকা করে। গাড়িগুলো দুটি বাসায় রাখেন ও তিনটি শোরুমে রাখেন। পাশাপাশি গাউছিয়াতে একটি স্বর্ণের দোকান রয়েছে। র‌্যাব গোল্ডেন মনিরের বিরুদ্ধে আরও কিছু অভিযোগ পেয়েছে। এগুলো আনুষ্ঠানিক তদন্তের জন্য দুদক, বিআরটিএ, মানি লন্ডারিংয়ের জন্য সিআইডি এবং ট্যাক্স ফাঁকি দেয়ার বিষয়ে এনবিআরকে তদন্তের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানাবে র‌্যাব। একটি গেয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে তারা জানতে পেরেছে মনির ১০-১৫ বছর ধরে একটি রাজনৈতিক দলকে সহযোগিতা করে আসছিল। ওই দলের যেসব নেতা আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন তার কাছ থেকে তাদেরও খোঁজ করা হচ্ছে।
×