ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

লক্ষ্য করোনাকালের শিক্ষা ঘাটতি পূরণ

করোনাপরবর্তী প্রাথমিক শিক্ষার রূপরেখা নির্ধারণ

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ২৯ অক্টোবর ২০২০

করোনাপরবর্তী প্রাথমিক শিক্ষার রূপরেখা নির্ধারণ

বিভাষ বাড়ৈ ॥ করোনাকালে সকলের জন্য সমানভাবে ডিজিটাল সুবিধাসহ এ সংক্রান্ত ‘রিসোর্স’ নিশ্চিত করা সম্ভব না হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিখন-বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে বলে মত দিয়েছে শিক্ষা নিয়ে কাজ করা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান রুম টু রিড বাংলাদেশ। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়ে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানটির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের মধ্যে শিক্ষার্থীদের শিখন-শেখানো কার্যক্রম অব্যাহত রাখার লক্ষ্যে যুগান্তকারী নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে শিখন-বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে শিখন-ঘাটতি পূরণে করোনা পরবর্তী শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনায় প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের কোটি কোটি শিশুদের জন্য দরকার কার্যাবলির নির্দিষ্ট রূপরেখা। রুম টু রিড রূপরেখা দিয়ে সরকার, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, স্কুল পরিরচালনা কমিটির ভূমিকা তুলে ধরেছে। জানা গেছে, জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের সহযোগিতায় গবেষণাটি পরিচালনা করেছে রুম টু রিড। ‘করোনা মহামারীতে শিক্ষার্থীদের শিখন-ঘাটতি পূরণ : বাংলা বিষয়ের শিখনফল পর্যালোচনা এবং বিষয়বস্তু নির্ধারণ’ শীর্ষক এ গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ৮ মার্চ। পরবর্তীতে এই ভাইরাসে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে থাকায় বাংলাদেশ সরকার ১৭ মার্চ থেকে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে, যা এখন পর্যন্ত বলবৎ রয়েছে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষার্থীদের পাঠে বিঘœ সৃষ্টি হয়েছে ও তাদের শিখন-ঘাটতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। এই গবেষণাটির মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ পরিস্থিতির জন্য দীর্ঘমেয়াদে বিদ্যালয় বন্ধ থাকার কারণে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিখন-ঘাটতি কাটাতে এবং একটি নিরাময়মূলক/রিমেডিয়াল প্যাকেজ তৈরির উদ্দেশ্যে শ্রেণিভিত্তিক অর্জন-উপযোগী যোগ্যতা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো নিরূপণ করা ও অগ্রাধিকারের ভিত্তি নির্ধারণ করা। গবেষণায় জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড, প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর ও রুম টু রিড এর প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এছাড়া মাঠপর্যায়ে কর্মরত পিটিআই ইনস্ট্রাক্টর, ইউআরসি ইনস্ট্রাক্টর, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শ্রেণিভিত্তিক বিষয়ের শিক্ষক ও অভিভাবকদের নিকট থেকে গুণগত ও সংখ্যাগত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। করোনা-প্রকোপ পরবর্তী সময়ে শ্রেণীভিত্তিক বিষয়ে অগ্রাধিকারমূলক শিখনফলের তালিকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের ‘শোনা’, ‘বলা’, ‘পড়া’ ও ‘লেখা’Ñ ভাষাদক্ষতার এই চারটি ক্ষেত্রে শুধু ‘অবশ্যই শিখনীয়’ (গঁংঃ ষবধৎহ) হিসেবে নির্ধারিত শ্রেণীভিত্তিক অর্জন-উপযোগী যোগ্যতাসমূহকে গবেষণা প্রতিবেদনে শ্রেণিভিত্তিক উপায়ে উপস্থাপন করা হয়েছে। গবেষণা প্রতিষ্ঠানটি প্রথমেই শিক্ষার্থীদের জন্য সুপারিশ তুলে ধরে বলেছে, ‘অবশিষ্ট কার্যদিবস বিবেচনা করে একটি মিশ্র-মডেল অনুসরণ করে রিমেডিয়াল পরিকল্পনা করা অপরিহার্য। মিশ্র-মডেলটি এরূপ হবে যেখানে শ্রেণীকক্ষকেন্দ্রিক পাঠদানের এবং বাড়িতে অভিভাবকের সহায়তায় শিক্ষার্থীর কাজের পরিকল্পনা থাকবে। এক্ষেত্রে বিদ্যালয় এবং বাড়িতে শেখার বিষয়সমূহ নির্ধারণ করা এবং সে অনুযায়ী সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করা জরুরী। বিদ্যালয়ে শিখন-শেখানোর পাশাপাশি বাড়িতে শিখন চর্চায় সহায়তা করার জন্য সহায়ক শিক্ষা-উপকরণ (ওয়ার্কশিট) সরবরাহ করা প্রয়োজন। শুরুতে শিক্ষার্থীদের বর্তমান শিখন স্তর নির্ধারণের লক্ষ্যে ভাষার মৌলিক দক্ষতা যাচাই করা এবং প্রতিদিনের পাঠে চলমান মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখা দরকার। শিক্ষা-কার্যক্রম পরিকল্পনা ও পরিচালনা সংক্রান্ত করণীয় ॥ বলা হয়েছে, বাংলা বিষয় পাঠের ক্ষেত্রে ভাষা দক্ষতাকে অধিক গুরুত্ব দিতে হবে। প্রাপ্ত সময়ের ভিত্তিতে নির্বাচিত পাঠের বাইরে থাকা আবশ্যকীয় ভাষা দক্ষতা (যেমন-যুক্তবর্ণ, ব্যাকরণ ইত্যাদি) সমন্বয় করে একটি রিমেডিয়াল পরিকল্পনা করা জরুরী। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সীমিত সময়ে নির্বাচিত বিষয়বস্তু থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ পাঠগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শেখানো। প্রথম শ্রেণীর অপরিহার্য দক্ষতা বর্ণ এবং কারচিহ্নের জন্য প্রস্তাবিত পিরিয়ডে শিক্ষার্থীর শিখন নিশ্চিত করতে সুনির্দিষ্ট পাঠপরিকল্পনা প্রদান করা। নিরাময়মূলক (রিমেডিয়াল) পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রধান শিক্ষক ও বিষয় শিক্ষকদের ওরিয়েন্টেশনের ব্যবস্থা করা। করোনা-পরবর্তী সময়ে শিক্ষার্থীদের মনোসামাজিক অবস্থা বিবেচনা করে বিদ্যালয়ের পাঠ আনন্দদায়ক করতে শিশুতোষ পঠন কার্যক্রমে সক্রিয় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা থাকা দরকার। শিক্ষকের করণীয় ॥ প্রত্যেক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বিদ্যালয় খোলার পূর্বেই অন্যান্য শিক্ষক, এসএমসি সদস্য, অভিভাবক, সংশ্লিষ্ট সহকারী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শক্রমে একটি কার্যকরী পরিকল্পনা (ধপঃরড়হ ঢ়ষধহ) তৈরি করা। নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করতে প্রচার চালানো। বিদ্যালয়ে অনুপস্থিত শিক্ষার্থীদের খোঁজ-খবর নেয়া এবং তাদের পুনরায় বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। করোনার কারণে বিদ্যালয় বন্ধ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত শেখা বিষয়ের ওপর পুনরালোচনার ব্যবস্থা রাখা আবশ্যক। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, এসএমসি ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং সচেতনতা বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নেয়া। শিক্ষার্থীসহ নিজেদের করোনা ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকা এবং ঝুঁকি হ্রাসে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা অত্যাবশ্যক। শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে শ্রেণী শিখন-শেখানো কার্যাবলিতে আনন্দদায়ক ও শিশুবান্ধব বহুমুখী শিখন-শেখানো কৌশলের ব্যবহার করা। গাঠনিক মূল্যায়নের ভিত্তিতে শিক্ষার্থীকে প্রদত্ত কাজ সম্পাদনে উৎসাহ প্রদান এবং যথাযথ ফিডব্যাক প্রদানের মাধ্যমে প্রত্যাশিত শিখনফল অর্জনে সহায়তা করতে সচেষ্ট থাকা। শিক্ষার্থী ও শ্রেণী পাঠের অগ্রগতি মাঠপর্যায়ের শিক্ষা-কর্মকর্তাগণকে অবহিত করা। অভিভাবকের করণীয় ॥ শিশুদের স্কুলে পুনরায় যোগদান/উপস্থিতি নিশ্চিত করা। প্রয়োজনমতো শিক্ষার্থীকে বাড়িতে শিখতে সহায়তা ও উৎসাহিত করা। স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে বিদ্যালয় আয়োজিত অভিভাবক সভায় নিয়মিত অংশগ্রহণ করা। শিক্ষকের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং শিক্ষকের পরামর্শ অনুযায়ী শিক্ষার্থীর শিখনে সহায়তা করা। বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির করণীয় ॥ শিক্ষার্থীর শিখনের অগ্রগতি সম্পর্কে অবহিত করার জন্য শিক্ষক ও অভিভাবকদের নিয়ে স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে বিশেষ সভা আয়োজন করা। বিদ্যালয়ে করোনা-পরবর্তী সময়ে শিখন-শেখানো পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে অভিভাবকগণকে সম্পৃক্ত করা। ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের খোঁজ-খবর নেয়া এবং তাদের পুনরায় বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ গ্রহণ করা। শিক্ষা-কর্মকর্তাদের করণীয় ॥ শিক্ষার্থীদের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা এবং এজন্য শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করতে প্রচার চালানো। ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের খোঁজ-খবর নেয়া এবং তাদের পুনরায় বিদ্যালয়ে ফিরিয়ে আনতে অভিভাবক ও জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করা। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকলের সঙ্গে যোগাযোগ করা। এক্ষেত্রে করোনা ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন থাকা ও ঝুঁকি হ্রাসে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বনের ব্যবস্থা করা। বিদ্যালয় পর্যায়ে পরিচালিত শিখন-শেখানো কার্যক্রম নিয়মিত একাডেমিক তত্ত্বাবধান করা এবং শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় পেশাগত সহায়তা প্রদান করা। মাঠপর্যায়ে বাস্তবায়িত শিক্ষা-কার্যক্রমের গতি-প্রকৃতি উর্ধতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা এবং প্রয়োজনীয় পরামর্শ গ্রহণ করে তা বিদ্যালয় পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা।
×