ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

তাঁর কবিতায় প্রেম

প্রকাশিত: ২৩:২৩, ২৩ অক্টোবর ২০২০

তাঁর কবিতায় প্রেম

পঞ্চাশের কবি শামসুর রাহমানের নামের সঙ্গে ‘স্বাধীনতার কবি’ উপমাটি লেপ্টে আছে ঘনিষ্ঠভাবে। মুক্তিযুদ্ধের কবিতার প্রভাব, বিস্তার, প্রসার আর জনপ্রিয়তাই এর পেছনের কারণ হয়তো। হয়তো কবিতায় রাষ্ট্র সংগ্রামের, আন্দোলনের, স্বাধীনতার ভাব-বিন্যাসের উপর্যুপরিতার কারণেও। এ নামাঙ্কিত বৃত্ত যে শামসুর রাহমান ভাঙ্গেননি তার প্রমাণ মেলে না। এর মধ্যেই যে তার চর্চা সীমাবদ্ধ তা’ও তাকে পাঠে পাওয়া যায় না। একনিষ্ঠ পাঠে তার প্রেমমনস্কতা যে উজান বারিবাণ হয়ে প্লাবিত করে অমল প্রেমরাজ্য, ভালোবাসার অমিত মহল তা চাইলেই অস্বীকার বা ছাড়িয়ে যাওয়া যায় না। সমগ্র পাঠে তা দেখা যায় নক্ষত্রালোর মতো সুস্পষ্ট। প্রেম শাসমুর রাহমানের কাব্যে প্রধান উপজীব্য। প্রেমের মখমলে মোড়ানো তার কবিতার পঙ্ক্তি। দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ, সংস্কার, আন্দোলন, বিদ্রুপ, প্রতিবাদের অন্য পাশে তার হাতে প্রসবিত হয়েছে কোমল মনাঙ্কের একান্ত ব্যক্তিগত বা সমগ্র মনের নিভৃতে পুষে থাকা প্রেমপয়ারের উক্তি। তিনি প্রেমকে দেখেছেন সার্বজনীন দৃষ্টিতে, সকলের চোখে। কখনো কখনো মনে হয় এ- কবির নিজস্ব দুঃখ বেদনা, কখনো কখনো মনে হয় ফেলে আসা স্মৃতি, আক্ষেপ আর বর্তমানে বয়ে যাওয়া হওয়া। কখনো ধরা যায় বিশ্বসংসারের সে আকাক্সক্ষার আশালতা। নিবিড় বুননে তা তিনি এঁকেছেন আপন সূত্রে, বৈশিষ্ট্যে; তাতে জড়িয়ে থেকেছেন শীতে বালিকারা যেমন পশমী চাদর জড়িয়ে রাখে নরম গায়ে। ধরে রাখে যত্ন করে। ‘যখন প্রথম দেখি অপরাহ্নে পুরনো বাড়িতে,/ তোমার পরনে ছিল প্রিন্টের কামিজ সেলোয়ার।/ ক্রমশ সন্ধ্যার ঠোঁট শহরকে ছুঁলো,/ এক ফাঁকে দুলিয়ে ডাগর বেণী পড়লে তুমি নিজের কবিতা।/ তোমার শরীরে কৈশোরের কুমারীর ঘ্রাণ খেলা করছিল/ ঠোঁট থেকে ঝরে গেল অজ¯্র রঙিন প্রজাপতি/ ভালো লেগেছিল অনাবিল আচরণ/ কবিতার কিছু ছেলেমানুষি, হাতের নড়া, কথা।’ (সেদিন তোমাকে)। প্রেম শামসুর রাহমানকে মুগ্ধ করেছে বহু আঙ্গিকে। বিস্ময়ে ভরিয়েছে বহু মাত্রিকতায়। তিনি ভালোবাসতে চেয়েছেন, ভালোবেসেছেন, ভালোবাসার মধ্যে থাকতে চেয়েছেন, থেকেছেন। ক্রোধে ফেটে পড়েছেন, ফের ফিরে এসেছেন প্রেমের কাছে। প্রতিবাদে তেতে উঠেছেন, আবার ফিরেছেন প্রেমের কাছে। সংগ্রামে শামিল হয়েছেন, শেষে আশ্রয় নিয়েছেন প্রেমের কাছে। কবি মাত্রই তো প্রেমিক। কোনো কোনো হাতে কোনো কোনো কবিতা মিশে যায় চিহ্নিত সময়ে, সময় তাকে লুফে নেয়; তাতে কবি খাঁচায় বন্দী হয়ে যায় না। কবি সে তকমার ভেতর সেঁধিয়ে যায় না। কিন্তু কবিকে সেঁধিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে। কবি, কবিই। সে দিনের কবি, রাতের কবি, উত্তরের কবি, দক্ষিণের কবি, সামনের কবি, পেছনের কবি- এ হীনম্মন্যতা। ঠেসে রাখার অপকৌশল। আলাদা করার অপয়া চেষ্টা। শামসুর রাহমান গ্রামেরও কবি, নগরের কবি, শহরেরও কবি। তিনি প্রেমের কবি, স্বাধীনতার কবি, মুক্তির কবি, সংগ্রামের কবি, চিন্তার কবি, চেতনার কবি। একজন কবি সে কেবল মাত্র কবি। ‘তোমার-না আসাগুলো ক্রুশবিদ্ধ যীশুর যন্ত্রণা হয়ে ঝরে মনে নিশিদিন।/ এ-ও জানি, অনেকেই নানা যন্ত্রণায় ভোগে দিনরাত আর/ নিজের ভাগ্যকে অভিসম্পাতে করে জর্জরিত/ কেউ অসুখে ভুগে ভুগে হতাশার নিশিডাকে অন্ধ বিলে ডোবে/ অনেকেই জঠর-জ্বালায় বকে প্রায়শ প্রলাপ,/ কেউ কেউ ক্ষোভে মাথা ঠোকে বধির দেয়ালে,/ কেউ কেউ, কী জানি কিসের ঘোরে করে বিষ পান,/ ঝোলে ফাঁসির দড়িতে।’ (তোমার-না আসাগুলো)। অসখ্য প্রেমের কবিতা শামসুর রাহমানের কাব্যজীবনের রচনায় দেখা যায়। এ সংখ্যাটা হাতে গুনে দশ, বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ বা একশো না। তারর অধিক। সে কবিতাগুলোয় চিরায়ত প্রেমের কথা যেমন বলা আছে, মানব-মানবীর চিরকালীন রসক্রিয়ার কথাও বলা আছে। চাওয়া পাওয়ার কথা আছে, না চাওয়ার, না পাওয়ার বেদনা আছে। এই আছে- নাই নিয়ে শামসুর রাহমান খেলেছেন। দশদিক ঘুরিয়ে উড়িয়ে দেখেছেন- নির্মাণ করেছেন আত্মঅভ্যন্তরে উদ্ভূত রঙে। কারো সঙ্গে মিললো কি মিললো না সে প্রশ্ন না। কাল থেকে মহাকালে পৌঁছলো কি পৌঁছলো না সেও প্রশ্ন না। কবি, তার সাধনায় সাধ মিটিয়েছেন সে’ই প্রশ্ন। সে স্বাদ অমৃত হলে বার বার চাখবে পাঠক। না হলে ভুলে যাবে আপনা থেকে। তাতে কার কি আসে যায়। তার চরনায়? ‘কেন এ রকম হয়? হবে?/ কেন তুমি অভিমানে স্তব্ধ হয়ে যাবে?/ কেন এতক্ষণ করবে না ফোন?/ আমার অসুবিধে নেই, টেলিফোনও কিছু বিগড়ে আছে।/ এই যে মুহূর্তগুলো, ঘন্টাগুলো আমাকে চিবিয়ে খাচ্ছে/ হিং¯্র বিড়ালের মতো, তুমি কি বোঝো না?/ হায়, এ বয়সে আমি আর কত কষ্ট পাব?/ কী আমার অপরাধ, বুঝতে অক্ষম।/ গাছ হয়ে জন্মানোই ছিল ঢের ভালো,/ বিষাদের লেশমাত্র থাকত না।’ (কেন এ রকম হয়?)। ‘পাথর ভাঙার মতো নিজেকে ভেঙেছি বারবার/ পুড়িয়েছি দিনরাত, জোয়ারের জলে/ ভেসে গেছি ঢেউয়ের আঘাতে বুকে পেতে নিতে।/ কেউ জানে না, কী করে গানে পাওয়া একটি মানুষ ইটকণা, জলগুঁড়ো হতে পারে।’ (পাথর ভাঙার মতো)। দুর্ভাগ্যক্রম হলে কবির ভাগ্যে উপমা যোগে। শামসুর রাহমানের ভাগ্যের সে দোষের কারণে তার প্রেমের, প্রেমনিসর্গের, প্রেমবোধের কবিতাগুলো আড়ালেই আছে আলমিরায় তুলে রাখা অচল পোশাকের মতো। অভিশাপ দিচ্ছি,/ তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা/ স্বাধীনতা তুমি/ শহীদ জননীকে নিবেদিত/ তোমারই পদধ্বনি/ বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা/ আসাদের শার্ট/ বুক তার বাংলাদেশের হৃদয়/ এই কবিতাগুলো ব্যতিরেকে শামসুর রাহমানের অন্য আর কবিতাগুলো কতটা উচ্চারিত হচ্ছে, পড়া হচ্ছে তা জানবার বিষয়। অথচ যদি তুমি ফিরে না আসো, ভালোবাসার অর্থ, আমার কাছ থেকে সরিয়ে নাও, কোকিল, যেখানেই হাত রাখি, হঠাৎ পাওয়া, শুধু একা একা, আমি ছাড়া কে জানে, তুমি আমার সুরে, কেউ কি এখন, তুমি চলে গেলে. প্রেমরসে উদ্ভূত কবিতাগুলো শামসুর রাহমানের নামে কাব্যমলাটে মসৃণ সকলকালের সৌন্দর্যে।
×