ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কালুরঘাট রেল কাম রোড দ্বিতীয় সেতু নির্মাণে সময়ক্ষেপণ

প্রকাশিত: ২১:৪১, ১৯ অক্টোবর ২০২০

কালুরঘাট রেল কাম রোড দ্বিতীয় সেতু নির্মাণে সময়ক্ষেপণ

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ কক্সবাজারসহ চট্টগ্রামের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কর্ণফুলী নদীর ওপর ব্রিটিশ আমল তথা ১৯৩১ সালে নির্মিত মিটারগেজ রেল লাইনের সেতুটিই কালুরঘাট সেতু। ১৯৬২ সালে দক্ষিণাঞ্চলের পরিবহন যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে এ সেতুতেই রেল কাম রোড সেতুতে রূপান্তর করা হয়। প্রায় শত বছরের জরাজীর্ণ এ সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে। ফলে মাত্র ১০ কিলোমিটার গতিতে ট্রেন চলাচল করে এ সেতুর ওপর দিয়ে। প্রতি বিশ মিনিট অন্তর দক্ষিণাঞ্চলের পরিবহন পারাপারের জন্য কালুরঘাট সেতুটি ব্যবহার করা হয়। যদিও দোহাজারী পর্যন্ত ট্রেন লাইন চালু রয়েছে জরাজীর্ণ এ সেতুর ওপর দিয়ে। ২০২২ সালে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল যোগাযোগ শুরু হলে এ সেতুটি কাল হয়ে দাঁড়াবে পর্যটকদের জন্য। ফলে একনেকে অনুমোদন না পেলেও প্রায় ১ হাজার ১৫২ কোটি টাকা ব্যয়ের এ সেতুটি ২০১২ সালেই ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ করেছে অস্ট্রেলিয়া, তাইওয়ান ও বাংলাদেশী কনসালটেন্ট ও প্রকৌশলীরা। কিন্তু এরপর বিআইডব্লিউটিএ’র নেভিগেশন সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের কারণে এক বছর পিছিয়ে পড়েছে এ সেতুর নির্মাণ কাজ। গত বছরের অক্টোবরে বিআইডব্লিউটিএ’র সেতু নির্মাণে তৃতীয় স্টান্ডার্ড অনুযায়ী ৭ দশমিক ৬২ মিটার উচ্চতার কথা বললেও ১৫ ডিসেম্বর এসে তা দ্বিতীয় স্টান্ডার্ড অনুযায়ী ১২ দশমিক ২ মিটার নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্সের আপত্তি দিয়ে ব্রিজ নির্মাণে সময়ক্ষেপণ করছে। অভিযোগ রয়েছে, মূলত নদীর গভীরতা অনুযায়ী বিআইডব্লিউটিএ নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স বর্তমানে অতিরিক্ত মাত্রায় দাবি করলেও তা অনেকটা অপ্রয়োজনীয়, সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ বলে মনে করছেন কর্ণফুলী তৃতীয় সেতু নির্মাণ কর্তৃপক্ষ। কারণ কালুরঘাট পর্যন্ত তেমন কোন লাইটারেজ জাহাজ চলাচল যেমন করে না, শুধু বালুবাহী ইঞ্জিন ট্রলারগুলো চলাচল করে ওই সেতুর নিচ দিয়ে। ফলে সমুদ্রে জোয়ারের সময় কর্ণফুলী নদীতে থাকা পানির হাইলেভেল থেকে প্রায় ৪০ ফুট উচ্চতায় কালুরঘাট দ্বিতীয় সেতু হিসেবে খ্যাত রেল কাম রোড সেতু নির্মাণের প্রয়োজন নেই। যদি বিআইডব্লিউটিএ’র নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স প্রায় ৪০ ফুট রেখে সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তাহলে ২০২৪ সালের মধ্যেও এ সেতু নির্মাণ সম্ভব হবে না। যা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির মুখে ফেলবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার ট্রেনে চলাচলকারীদের। সিআরবির প্রধান প্রকৌশলীর দফতরের পক্ষ থেকে এ সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ করা হবে। এ বিষয়ে প্রধান প্রকৌশলী সবুক্তগীনের সঙ্গে দফতরে গিয়ে দফায় দফায় যোগাযোগ করার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। তবে সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে কোন ধরনের মন্তব্য করার অধিকার রাখেন না। এমনকি প্রধান প্রকৌশলীকে মোবাইলে মন্তব্য নেয়ার চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং (সিআরবি) ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ার দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, রেল মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত ডেভেলপমেন্ট প্রকিউরমেন্ট প্ল্যান (ডিপিপি) অনুযায়ী কালুরঘাট রেল কাম রোড দ্বিতীয় সেতুটির প্রাক্বলিত ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ১৫১ কোটি ৮৮ লাখ টাকা। সরকারী তহবিল থেকে ব্যয় হবে ৩৭২ কোটি ২৫ লাখ টাকা। প্রকল্পের সাহায্য তহবিল থেকে ব্যয় হবে ৭৭৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা। রেলের নিজস্ব তহবিল থেকে এ পর্যন্ত কোন ধরনের ফান্ডের উৎস দেখানো হয়নি। তবে ফিজিবিলিটি স্টাডি অনুযায়ী প্রকল্পটি শুরু করার কথা ছিল ২০১৮ সালের জুলাই মাসে। ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে এ সেতুটি শেষ হওয়ার কথা থাকলেও বিআইডব্লিউটিএ’র সিদ্ধান্তহীনতার কারণে দীর্ঘ এ সময় নষ্ট হচ্ছে। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর নির্মাণ সময় ও চলনক্ষম করে তুলে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রেল লাইন প্রকল্পের সঙ্গে প্রধান প্রকৌশলীর দফতর কর্তৃক নির্মিত এ সেতুটি কার্যক্রম চালুর কথা ছিল ২০২৩ সালের জুলাই থেকে। উন্নয়ন সহযোগী দেশ হিসেবে দক্ষিণ কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কো-অপারেশন ফান্ডের পক্ষ থেকে প্রকল্পের সাহায্য সংস্থার ৭৭৯ কোটি ৬২ লাখ টাকা পাওয়ার কথা ছিল। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে ২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল অর্থ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা সংক্রান্ত বিষয়ক সভায় বাংলাদেশ সরকার ও কোরিয়ান ওই প্রতিষ্ঠানটির মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। বিদ্যমান কালুরঘাট সেতুটির পরিবর্তে নতুন রেল কাম রোড কালুরঘাট দ্বিতীয় সেতু নির্মাণ করা জরুরী হয়ে পড়েছে প্রায় শতবর্ষী ও জরাজীর্ণতার কারণে। অস্ট্রেলিয়ার এসএমইসি, তাইওয়ানের উইকন কোম্পানি লিমিটেড এবং বাংলাদেশের এসিই কনসালটেন্ট লিমিটেড ও ইঞ্জিনিয়ার কনসোর্টিয়াম লিমিটেড যৌথভাবে এ সেতুটির ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ করেছে ২০১২ সালে। দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর পর ফিজিবিলিটি স্টাডির ভিত্তিতে কোরিয়া সরকারের নিকট আর্থিক সহায়তার অনুরোধ জানানো হয়। এক্ষেত্রে ২০১৬ সালে একপোর্ট ব্যাংক অব কোরিয়া (কেক্সিম) ফাইনাল ফিজিবিলিটি শেষ করে এপ্রেজাল সম্পন্ন করার জন্য ২০১৭ সালে বাংলাদেশে এপ্রেজাল মিশন প্রেরণ করে। ঋণ চুক্তি স্বাক্ষর প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করার জন্য ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট সর্বশেষ হালনাগাদকৃত ডিপিপি অনুযায়ী খসড়া ঋণ চুক্তি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে কেক্সিমের নিকট প্রেরণ করে। ২০১৮ সালের ৭ আগস্ট একনেকে এ ব্রিজটি তৈরির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার জন্য সভায় উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু সেতুর ডিজাইন উপস্থাপন না হওয়ায় কালুরঘাটে কর্ণফুলী সেতুর ওপর দ্বিতীয় রেল কাম রোড সেতু প্রকল্পটি অনুমোদন পায়নি। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রস্তাবিত এ সেতুটিকে আলাদাভাবে সড়ক ও আলাদাভাবে রেল সেতুর ডিজাইন একনেক সভায় উত্থাপনের জন্য বলা হয়। তবে দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কোরিয়ার এক্সিম ব্যাংকে শুধু রেল সেতুর ডিজাইন করার জন্য অনুরোধ করা হয়। বিআইডব্লিউটিএ দফতর সূত্রে জানা গেছে, নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্সের জন্য ২০১৯ সালের অক্টোবরে রেলের পক্ষ থেকে কালুরঘাট সেতু নির্মাণের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জোয়ারের পানির উপরিভাগ থেকে সেতুর নিচের অংশ পর্যন্ত ফিজিবিলিটি স্টাডি করে তৃতীয় শ্রেণীর সেতু হিসেবে ৭ দশমিক ৬২ মিটার উচ্চতায় সম্পূর্ণ ডিজাইন তৈরি করতে ওই বছরের ১৫ অক্টোবর একটি পরিদর্শন রিপোর্ট দাখিল করা হয়। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ’র উর্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর সেতু হিসেবে ১২ দশমিক ২ মিটার নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স ধরে মাঝখানের স্প্যানটি ফ্ল্যাক্সিবল রাখার তথা প্রয়োজনে যেন খোলা যায় এমন ডিজাইন করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালকের দফতর থেকে। এমনকি গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংকে এ ধরনের একটি অনুলিপি দিয়ে আবার রেলপথ মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয়েছিল। কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংকের প্রতিনিধি মি. কিম এ বিষয়ে চলতি বছরের মার্চ মাসে রেল মন্ত্রণালয়ের সচিব, রেলের মহাপরিচালকের সঙ্গে একটি যৌথ আলোচনাও হয়েছে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নির্দেশনা অনুযায়ী রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন এবং রেল সচিবের সম্মতিতে গত বছরের ৪ সেপ্টেম্বর শুধু রেলসেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এক্সটা ডজ টাইপের এ সেতুটি বিআইডব্লিউটিএ’র ফিজিবিলিটি স্টাডি অনুযায়ী তৈরি হলেও ফ্রি ক্যান্টিলিভার ব্রিজ ও কেবল স্টেড ব্রিজ সুবিধাদির সম্মিলনেই হবে। ফ্রি ক্যান্টিলিভার ব্রিজ ও কেবল স্টেড ব্রিজ টাইপ সেতুতে বিদ্যমান স্প্যানের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে এক্সটা ডজ ব্রিজ টাইপ সেতুর মিডিয়াম টাইপ স্প্যান নির্ধারণ করা হয়। ফলে নতুন এ সেতুর নির্মাণ ব্যয় ফ্রি ক্যান্টিলিভার ব্রিজ ও কেবল স্টেড ব্রিজ টাইপ সেতুর তুলনায় কম। এ সেতুর মিডিয়াম টাইপ ১৪০ মিটার থেকে ২০০ মিটার পর্যন্ত স্প্যানবিশিষ্ট হওয়ায় পিয়ারের সংখ্যাও কম হবে। ফলে ফাউন্ডেশন এবং পিয়ারের ব্যয় হ্রাস পাবে। এছাড়াও কেবল স্টেড ব্রিজ টাইপের সেতুতে স্টে টাওয়ারের উচ্চতার তুলনায় এক্সটা ডজ ব্রিজ সেতুতে ব্যবহৃত স্টে আওয়ারের উচ্চতা কম হবে এবং নান্দনিকতাও অনেকটা বেশি থাকবে। কেবল স্টেড ব্রিজের মতোই যথেষ্ট পরিমাণ নেভিগেশন ক্লিয়ারেন্স রাখা যাবে এ সেতুতে।
×