ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আজ শহীদ শেখ রাসেলের জন্মদিন

প্রকাশিত: ২৩:০২, ১৮ অক্টোবর ২০২০

আজ শহীদ শেখ রাসেলের জন্মদিন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ‘তুইতো গল্পের বই, খেলা নিয়ে সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন বয়সেতে ছিলি! তবুও পৃথিবী আজ এমন পিশাচি হলো শিশুরক্তপানে তার গ্লানি নেই? সর্বনাশী, আমার ধিক্কার নে! যত নামহীন শিশু যেখানেই ঝরে যায় আমি ক্ষমা চাই, আমি সভ্যতার নামে ক্ষমা চাই।’ ভয়াল ১৫ আগস্ট পৃথিবীর ইতিহাসে নির্মম-জঘন্যতম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ শিশুপুত্র শেখ রাসেল হত্যাকাণ্ডকে নিয়ে লেখা দুই বাংলার বিখ্যাত কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ‘শিশুরক্ত’ কবিতায় এমনভাবে ক্ষেদোক্তি প্রকাশ করেছেন। আজ শহীদ শেখ রাসেলের ৫৭তম জন্মদিন। ১৯৬৪ সালের এই দিনে ধানম-ির বঙ্গবন্ধু ভবনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কনিষ্ঠ পুত্র শেখ রাসেল জন্মগ্রহণ করেন। ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর দুরন্তপ্রাণ এই শিশু তার পিতার রাজনৈতিক জীবনকে দেখতে শুরু করেছিল মাত্র। বাবার বুকের গভীরে মুখ রেখে সাহস আর বীরত্বের উষ্ণতা নেবার যখনই ছিল শ্রেষ্ঠ সময়, ঠিক তখনই নরঘাতকদের দল তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। যেন শেখ রাসেল স্বাধীনতার মহান স্থপতি শেখ মুজিবের ছেলে, এটাই হয়তো ছিল তার একমাত্র এবং সবচেয়ে বড় অপরাধ। দশ বছরের শিশু রাসেল প্রতিদিনের মতো সেদিনও ঘুমিয়ে ছিল। আকস্মিক গুলির বিভৎস্যতায় তার ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘুম ভাঙ্গা চোখ নিয়ে সে আতঙ্কিত হয়, চমকে ওঠে। অবস্থা বুঝে বেগম মুজিব আদরের দুলাল রাসেলকে রক্ষায় কাজের লোকসহ পেছনের দরজা দিয়ে চলে যেতে বলেন। গেট দিয়ে বাইরে যাবার সময় ঘাতকরা তাকে আটক করে। এ সময় বাড়ির ভেতরে মুহুর্মুহু বুলেটের শব্দ আর বীভৎস্য আর্তচিৎকার শুনে অবুঝ শিশু রাসেল কান্নাজড়িত কণ্ঠে ঘাতকদের বলেছিল, ‘আমি মায়ের কাছে যাব।’ কিন্তু এতটুকু মন গলেনি পরাজিত স্বাধীনতা বিরোধী ঘৃণ্য নরপিশাচদের। আগেই বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের সকল সদস্যকে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করেছে। মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে ঠা-া মাথায় একটি সুন্দর ও অবুঝ শিশু শেখ রাসেলকেও গুলি করে হত্যা করে। সময়টা ছিল লড়াই আর যুদ্ধের উত্তেজনায় মুখর। ১৯৬৪ সাল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে চলেছে ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ওই সময় সমগ্র পাকিস্তানজুড়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডামাডোল। একদিকে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, অন্যদিকে সম্মিলিত বিরোধীদলের প্রার্থী কায়েদে আযম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর বোন ফাতেমা জিন্নাহ। অনিশ্চয়তা আর অন্ধকারের মাঝেও এ অঞ্চলের মানুষ স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখছে। যিনি এই স্বপ্নের বাস্তবায়ন ঘটিয়ে বাঙালী জাতিকে এনে দেবেন মুক্তির স্বাদ, তারই (বঙ্গবন্ধু) ঘর আলো করে জন্ম নিল এক ছোট্ট শিশু। ১৯৬৪ সালের ১৮ অক্টোবরে ধানম-ির বিখ্যাত ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বাড়িটি আলোকিত করে এলো শেখ রাসেল। রাসেলের যেদিন জন্ম হয় বঙ্গবন্ধু সেদিন ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে প্রচারে অংশগ্রহণের জন্য চট্টগ্রামে অবস্থান করছিলেন। সেইদিনের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিখেছেন- ‘রাসেলের জন্মের আগের মুহূর্তগুলো ছিলো ভীষণ উৎকণ্ঠার। আমি, কামাল, জামাল, রেহানা ও খোকা চাচা বাসায়। বড় ফুফু ও মেঝ ফুফু মার সঙ্গে। একজন ডাক্তার ও নার্সও এসেছেন। সময় যেন আর কাটে না। জামাল আর রেহানা কিছুক্ষণ ঘুমায় আবার জেগে ওঠে। আমরা ঘুমে ঢুলুঢুলু চোখে জেগে আছি নতুন অতিথির আগমন বার্তা শোনার অপেক্ষায়। মেঝ ফুফু ঘর থেকে বের হয়ে এসে খবর দিলেন আমাদের ভাই হয়েছে। খুশিতে আমরা আত্মহারা। কতক্ষণে দেখব। ফুফু বললেন, তিনি ডাকবেন। কিছুক্ষণ পর ডাক এলো। বড় ফুফু আমার কোলে তুলে দিলেন রাসেলকে। মাথাভরা ঘন কালোচুল। তুলতুলে নরম গাল। বেশ বড়সড়ো হয়েছিল রাসেল।’ রাসেল নামটি রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই। তাঁর প্রিয় লেখক ছিলেন বার্ট্রাল্ড রাসেল। পৃথিবী বিখ্যাত ব্রিটিশ দার্শনিক সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত বার্ট্রাল্ড রাসেলের নামের সঙ্গে মিলিয়ে তিনি পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ সদস্যের নাম রাখলেন রাসেল, শেখ রাসেল। এই নামটিকে ঘিরে নিশ্চয়ই তাঁর মহৎ কোন স্বপ্ন বা আকাক্সক্ষা ছিল। বঙ্গবন্ধু নিজেও ছিলেন বিশ্ব মানবতার উজ্জ্বল দ্যুতি, নিপীড়িত মানুষের বন্ধু, বাঙালী জাতির জনক, মুক্তিকামী মানুষের মহান নেতা এবং গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও শান্তি আন্দোলনের পুরোধা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মাত্র ১১ বছর বয়সে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে ঘাতকদের হাতে নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হন শিশুপুত্র শেখ রাসেলও। পৃথিবীতে যুগে যুগে রাজনৈতিক হত্যাকা- ঘটেছে, কিন্তু এমন নির্মম, নিষ্ঠুর এবং পৈশাচিক হত্যাকা- কোথাও ঘটেনি। হত্যাকা-ের সময় আতঙ্কিত হয়ে শিশু রাসেল কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, ‘আমি মায়ের কাছে যাব।’ মা, বাবা, দুই ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী, চাচা সবার লাশের পাশ দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে সবার শেষে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল শেখ রাসেলকে। শিশু রাসেলকে হত্যা করার মধ্য দিয়ে ঘাতকরা মানব সভ্যতার ইতিহাসে জঘন্যতম অপরাধ করেছে। এ ধরনের নিষ্ঠুর ‘মার্সি কিলিং’ শুধু রাসেলের জীবনকেই কেড়ে নেয়নি, সেই সঙ্গে ধ্বংস করেছে তার সব অবিকশিত সম্ভাবনাও। বাবার বুকের গভীরে মুখ রেখে সাহস আর বীরত্বের উষ্ণতা নেয়ার যখনই ছিল শ্রেষ্ঠ সময়, ঠিক তখনই নরঘাতকদের দল তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে আওয়ামী লীগসহ তাদের সকল সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন, বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন বিস্তারিত কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগ আজ রবিবার সকাল ৯টায় বনানী কবরস্থানে চিরনিন্দ্রায় শায়িত শেখ রাসেলসহ ১৫ আগস্ট নিহত সকল শহীদের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ফাতেহা পাঠ, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে। একইভাবে ঢাকা মহানগর উত্তর-দক্ষিণ আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য সংগঠনগুলোও ব্যাপক কর্মসূচী পালন করবে। শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে আজ সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউল্যাব স্কুল এ্যান্ড কলেজ চত্বরে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে শেখ রাসেলের ম্যুরাল উন্মোচন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। হাসুমনির পাঠশালা নামক সংগঠনের উদ্যোগে আজ সকাল ১১টায় জাতীয় জাদুঘরের নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রচিত ‘আমার ছোট রাসেল সোনা’ অবলম্বনে গোলটেবিল আলোচনা এবং শিশুতোষ আর্ট প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী ও প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক বিবৃতিতে শেখ রাসেলের জন্মদিন উপলক্ষে আয়োজিত কর্মসূচীতে যথাযথভাবে স্বাস্থ্য বিধি মেনে অংশগ্রহণের জন্য দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক ও সর্বস্তরের জনগণের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। একইসঙ্গে তিনি সারাদেশে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনসমূহের সকল স্তরের নেতাকর্মীদের অনুরূপ কর্মসূচী পালনের আহ্বান জানিয়েছেন।
×