ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বিচার বিভাগীয় তদন্ত দলের ঘটনাস্থল পরিদর্শন

প্রকাশিত: ২৩:১০, ২ অক্টোবর ২০২০

বিচার বিভাগীয় তদন্ত দলের ঘটনাস্থল পরিদর্শন

স্টাফ রিপোর্টার, সিলেট অফিস ॥ এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ৮ জনের মধ্যে ৬ আসামির ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুর সাড়ে ১২টায় পুলিশের পাহারায় আসামি শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেক আহমদ, অর্জুন লঙ্কর, রবিউল ইসলাম ও আইনুল ও রাজনকে ওসমানী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে নমুনা সংগ্রহ করার পর তাদের পুলিশের হেফাজতে নিয়ে আসা হয়। এমসি কলেজ ছাত্রাবাস এলাকায় গৃহবধূ ধর্ষণের ঘটনায় সিলেট বিভাগজুড়ে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে প্রতিবাদ বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। সিলেট এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত দল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। বৃহস্পতিবার দুপুরে তদন্ত কমিটির ৪ সদস্য এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে এসে পৌঁছেন। এ সময় ছাত্রাবাসের নবনির্মিত ভবনসহ বিভিন্ন হল পরিদর্শন করেন তারা। কমিটির সদস্য ধর্ষণ ঘটনার বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। এর আগে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। এরপর ছাত্রাবাসে যান তদন্ত কমিটির সদস্যরা। তদন্ত কমিটির প্রধান হিসেবে রয়েছেন সিলেটের জেলা ও দায়রা জজ মোঃ বজললুর রহমান, অন্য সদস্যরা হলেন মহানগর মুখ্য হাকিম মোঃ আবুল কাশেম, অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মমিনুন নেছা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক শারমিন নেছা। এই কমিটিকে ১৫ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছে উচ্চ আদালত। ১৪৪একরের বিশাল এলাকা জুড়ে সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজ। আয়তন ও অবস্থান বিবেচনায় কোন নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেই। এই বিষয়টি কখনও আমলে নেয়ারও প্রয়োজন মনে করা হয়নি। ধর্ষণের পর গঠিত তদন্ত কমিটিও নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমসি কলেজের পেছন দিকে মন্দিরের টিলা। নির্জন টিলাটি। যারা এমসির ক্যাম্পাসে ঘুরতে যান তারা এক সময় ঘুরে ঘুরে টিলার কাছে চলে যান। আর ওখানে গেলেই ঘটত বিপত্তি। ছাত্রলীগের সাইফুরের নেতৃত্বে ওই চক্রের সদস্যরা মন্দিরের টিলায় বসে আড্ডা দিত, ইয়াবা সেবন করত। আর কেউ গেলেই ‘ব্ল্যাকমেইল’ করা হতো। প্রেমিক-প্রেমিকা হলে তাকে ছবি তুলে আদায় করা হতো মুক্তিপণ। স্বামী-স্ত্রী গেলে কখনও কখনও স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করা হতো। এমন ঘটনা ওই টিলায় ঘটেছে অহরহ। কিন্তু কেউ কোন প্রতিকার পেতেন না। অনেক সময় লোকলজ্জা ও প্রাণনাশের ভয়ে সম্ভ্রম, টাকা-স্বর্ণালঙ্কার বিলিয়ে দিয়ে শেষ রক্ষা পেয়ে ফিরেছেন। দীর্ঘ সময়ে এখানে অপরাধীদের অভয়ারণ্য তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দলীয় ক্যাডারদের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে সংঘর্ষ ও হাঙ্গামার কারণে এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা এমনিতেই ছিল নাজুক। অপরাধীরা অছাত্র হলেও এলাকার ছাত্র নামধারীদের সংস্পর্শে থেকে অবাধে পার পেয়ে গেছে। সম্প্রতি একদিন বিকালে জগন্নাথপুরের এক তরুণ তার তালতো বোনকে নিয়ে এমসি কলেজের বাংলোর পেছনে গিয়ে বসেন। এমন সময় সাইফুর চক্রের সদস্যরা তাদের পায়। এক পর্যায়ে অসামাজিক কাজের অভিযোগ তুলে তারা ওই তরুণ-তরুণীর ছবি তুলে। এরপর ছেলেটিকে বেঁধে তরুণীকে গণধর্ষণ করে। টাকাও চায় তরুণীর কাছে। শুধু এ ঘটনাই নয়, খোদ এমসি কলেজের ভেতরে এ ধরনের বহু ঘটনা ঘটেছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। এক তরুণীকে ধর্ষণের অভিযোগে এমসি কলেজের গার্ড মাইকেলকে ক্যাম্পাসেই গণধোলাই দেয়া হয়েছিল। স্থানীয়রা বিক্ষুব্ধ হয়ে তাকে গণধোলাই দেয়। সাইফুর-রনি সিন্ডিকেটের হয়ে কাজ করত মাইকেল। কেউ ক্যাম্পাসে গেলেই মাইকেল খবর দিত ওই সিন্ডিকেটকে। মন্দিরের টিলার ঢালু জায়গাতে আড্ডাস্থল সাইফুর, রনি, রবিউলদের। স্থানীয়রা জানান, বিকেল হলেই ধান্ধায় বের হতো তারা। চলে আসত ওখানে। প্রতিদিনই মন্দিরের টিলায় ঘুরতে যায় তরুণ-তরুণীরা। আর তাদেরই টার্গেট করে ওরা। তাদের হাতে সম্ভ্রমহারানো অনেক নারী বিচার না দিয়েই চলে যান। কখনও কখনও কেউ বিচার প্রার্থী হলেও তাদের খোঁজ মিলে না। নাম-পরিচয় পাওয়া যায় না। ফলে ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির শিকার হলেও নীরবে সহ্য করতেন সবাই। এমসি কলেজের ক্যাম্পাস ছিল ছিনতাইকারী ও মাদকসেবীদের নিরাপদ আস্তানা। তাদের কাছে অসহায় ছিল কলেজ প্রশাসনও। গত ৫ বছরে ক্যাম্পাসের পেছনের টিলায় অন্তত ১০টির মতো ধর্ষণ ও শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনা কলেজ প্রশাসন জানলেও কিন্তু তারা কার্যকর কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারতেন না। ওদের কাছে জিম্মিই ছিল কলেজ প্রশাসন। প্রায় সময়ই সাইফুর-রনি প্রাইভেটকার, সিএনজি অটোরিক্সায় মহিলাদের নিয়ে এসে ঢুকত। এবং তারা শিক্ষক বাংলোতে চলে যেত। এসব ঘটনা দেখলেও কেউ কোন প্রতিবাদ করতে সাহস পেত না। হোস্টেলে সুপার থাকতেন না। ফলে হোস্টেলের নিয়ন্ত্রণ করত তারাই। এমসি কলেজের পাশেই রয়েছে আলুর তল এলাকা। একই এলাকায় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইঞ্জিনিয়ার কলেজ অবস্থিত। বিকেল হলেই অনেক পর্যটক স্ত্রী ও বান্ধবীকে নিয়ে সেখানে ঘুরতে যান। তারা নির্জন, নিরিবিলি টিলায় গেলেই ওই এলাকায় একটি চক্র তাদের একইভাবে ব্ল্যাকমেইল ও ধর্ষণ করত। এ ধরনের অনেক ঘটনা এখন স্থানীয়দের মুখে মুখে রটছে। প্রতিবাদ বিক্ষোভ ॥ এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদ ও জড়িতদের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবিতে নগরীর টিলাগড় পয়েন্টে মানববন্ধন কর্মসূচী পালিত হয়েছে। বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার দিকে শাহপরাণ (রহ.) ব্লক এই মানববন্ধন কর্মসূচী পালন করে। মানববন্ধন কর্মসূচী পালনকালে বক্তারা বলেন, ঘৃণ্য এ ঘটনা হযরত শাহজালাল (রহ.) ও শাহপরাণ (রহ.) এর পুণ্যভূমিকে কলঙ্কিত করেছে। অল্পসংখ্যক বিপথগামী ও সন্ত্রাসীদের দ্বারা সৃষ্ট ঘটনার কারণে টিলাগড় তথা সিলেটের ঐতিহ্য মলিন হতে দেয়া যাবে না। বক্তারা এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণ মামলার সকল আসামিকে দ্রুততম সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ধন্যবাদ জানান এবং এ ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের সর্বোচ্চ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান। মানববন্ধন কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করেন জকিগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা লোকমান উদ্দিন আহমদ চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা এটিএম বদরুল ইসলাম, সিসিক কাউন্সিলর নাজনীন আকতার কনা, যুবলীগ নেতা আসাদুজ্জামান আসাদ, কালাম আহমদ, এ এস মুন্না, কবিরুল ইসলাম কবির, আজির উদ্দিন, তুহিন আহমদ, রশিদুল ইসলাম রাশেদ, শাহ জুনেদ আহমদ, তাজুল ইসলাম লস্কর, শাহীনুর রহমান শাহিন, ইঞ্জিনিয়ার আলী আশরাফ মামুন, লিটন চৌধুরী, ফারুক আহমদ, মোহাম্মদ ফয়জুল্লাহ, সিলেট জেলা ছাত্রলীগ নেতা মশাহিদ আলী, জয়নুল আবেদীন জয়, আব্দুল বাতিন, ফাহিম আহমদ রুকন, মারুফ আহমদ, তানভির হাসান, ফয়সল আহমদ, ফাহিম আহমদ, আলম, দুলাল আহমদ, আবুল হাসান, পিন্টু, শাকিল আহমদ, সামি, আবির, সরফ উদ্দিন সৌরভ, জুবের, রাকিব, মাহবুব, আব্দুল্লাহ, সৈয়দ মস্তফা আহমদ, আহমেদ রিয়াজ, সামাদ, এম ডি জাহিদ প্রমুখ। মৌলভীবাজার ॥ সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে গৃহবধূকে গণধর্ষণ ও দেশব্যাপী ঘটিত সকল প্রকার যৌন সহিংসতার বিচারের দাবিতে মৌলভীবাজারে প্রতীকী অনশন পালন করা হয়েছে। বৃহস্পতিবার বিকেলে মৌলভীবাজার শহীদ মিনারে ঘণ্টাব্যাপী অনশন পালন করেন শেখ বোরহান উদ্দিন সোসাইটি। এ সময় তারা সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে স্বামীকে আটকে রেখে গৃহবধূকে গণধর্ষণের প্রতিবাদ জানান। এ ঘটনায় জড়িত সকল ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি ফাঁসির দাবি করেন তারা। একই সঙ্গে দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া সকল যৌন সহিংসতা ও ধর্ষণের সুষ্ঠু বিচারেরও দাবি জানানো হয়। সুনামগঞ্জে আইনজীবীদের মানববন্ধন ॥ সুনামগঞ্জে আইনজীবীদের ব্যানারে বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলা আইনজীবী সমিতির সামনে এক মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়। মানববন্ধনে ধর্ষণের ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়ে বক্তারা বলেন, শতবছরের এই ঐতিহ্যের একটি প্রতিষ্ঠানে কলঙ্কের দাগ লাগিয়েছে ছাত্রলীগ নামদারী নরপশুরা। সিলেটের পবিত্র মাটিতে এমন ন্যক্কারজনক কাজের বিরুদ্ধে সুনামগঞ্জসহ সিলেটের সব আইনজীবী সোচ্চার। ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন তারা। দ্রুত সময়ের মধ্যে ধর্ষকদের গ্রেফতার করতে সক্ষম হওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ জানান তারা। উই আর ন্যাশনালিস্ট ॥ সিলেটের এমসি কলেজে সংঘটিত দেশব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টিকারী গণধর্ষণ মামলার আসামিদের দ্রুত দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করার এবং নিরাপদ শিক্ষাঙ্গন ও নারীর জন্য নিরাপদ সিলেটের দাবিতে উই আর ন্যাশনালিস্টের আয়োজনে সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে বৃহস্পতিবার এক মানববন্ধন কর্মসূচীর আয়োজন করা হয়। উই আর ন্যাশনালিস্টের সভাপতি আবু সালেহ মোঃ তাহেরের সভাপতিত্বে ও সেক্রেটারি মিজানুর রহমান পাবেলের পরিচালনায় উপস্থিত বক্তারা বলেন, গত কয়েক বছর থেকে শান্তির শহর সিলেটে সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা একের পর এক নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনা ঘটিয়ে চলেছে। তাদের কারণে শিক্ষাঙ্গনে নারীদের রক্তাক্ত হতে হয়েছে, হতে হয়েছে ধর্ষিত। যা সিলেটের মাটিকে কলঙ্কিত করেছে।
×