ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জসীমউদ্দীনের আখ্যান কাব্য

প্রকাশিত: ২৩:৫০, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

জসীমউদ্দীনের আখ্যান কাব্য

জসীমউদ্দীনের আখ্যানমূলক কাব্য চারটি হচ্ছে- নকশীকাঁথার মাঠ (১৯২৯), সোজন বাদিয়ার ঘাট (১৯৩৩), সকিনা (১৯৫৯), ও মা যে জননী কান্দে (১৯৬৩)। আখ্যানমূলক কাব্যগুলোর শব্দাবলী বা উপাদানগুলো আশপাশের; সবুজ বাংলায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু মাইকেল, নজরুল বা রবীন্দ্রনাথ প্রমুখ কবি আখ্যান বা কবিতায় রামায়ণ-মহাভারত, লোকপুরাণ বা ধর্মীয় ঐতিহ্যের কাছে হাত পেতেছেন। এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম জসীমউদ্দীন ব্যতিক্রম ও অনন্য। তার আখ্যান কাব্য জনপ্রিয়তা ও নির্মাণশৈলীতে অনন্য। জসীমউদ্দীনের অন্তমিলের কবিতাগুলো কানে সুমধুর ঝংকার তোলে। নকশীকাঁথার মাঠ সর্বাধিক জনপ্রিয় কাব্য। সোজন বাদিয়ার ঘাট-ও জনপ্রিয় কাব্য। এ দুটি আখ্যান কাব্যে হিন্দু-মুসলিমদের সহাবস্থান, দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও তৎকালীন পরিবেশ ও ঘটনা পরিক্রমায় লিখিত। নকশীকাঁথার মাঠ কাব্য ঞযব ঋরবষফ ড়ভ ঊসনৎড়রফবৎবফ ছঁরষঃ নামে ইংরেজীতে অনুবাদক করেছেন ঊ.গ. গরষভড়ৎফ। সে সময়ে বাঙালী সাহিত্যিক ও সাহিত্য নিয়ে এমন উপস্থাপন খুব কমই দেখা গেছে। তার মূল্যায়ন- ‘ঔধংরসঁফফরহ ঠরষষধমবৎ’ং ৎবলড়রপব ধহফ ংঁভভবৎ, ফবংরৎব ধহফ ঁহফবংরৎবফ, যধঃব ধহফ ফবংঢ়ধরৎ ভৎড়স ঃযব াবৎু ফবঢ়ঃয ড়ভ ঃযবরৎ ংড়ঁষ, ঞযবৎব রং হড়ঃযরহম ঃৎরাধষ ধনড়ঁঃ ঃযবস, হড়ঃযরহম ংঁঢ়বৎভরপরধষ, ঃযবু ধৎব ৎবধষ’। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিশিষ্ট লোক-সাহিত্যিক উৎ. ঠবৎৎরৎ ঊষরিহ নকণীকাঁথার মাঠ পড়ে মন্তব্য করেন- ‘ও ৎবধফ ঃযব ঢ়ড়বস রিঃয মৎড়রিহম বীপরঃবসবহঃ ধহফ যধাব ৎবঃঁৎহবফ ঃড় রঃ ধমধরহ ধহফ ধমধরহ ঃড় নব ফবষরমযঃবফ নু রঃং ংরসঢ়ষরপরঃু, রঃং ফববঢ় যঁসধহরঃু’. উল্লেখিত দুজন প-িতের মন্তব্যেই বোঝা যায় কবি জসীমউদ্দীনের কাব্য প্রতিভায় লোকজ উপাদানের ব্যবহারের দক্ষতা। সমকালীন কবিরা যেখানে প্রায় সকলেই নগর-চেতনাসম্পন্ন, নাগরিক জীবন-স্বভাব ও আচার-আচরণে অভ্যস্ত এবং সাহিত্য-চর্চার ক্ষেত্রেও তার প্রতিফলন ঘটাতে সচেষ্ট, জসীমউদ্দীন সেখানে এক উজ্জ্বল, ব্যতিক্রম। তার কবিতায় তিনি আবহমান বাংলার প্রকৃতি, সমাজ ও সাধারণ মানুষের জীবন-চিত্রকেই আন্তরিক নিষ্ঠা, অকৃত্রিম ভালবাসা ও দরদ দিয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন। বলে রাখি, কবির কবিতা পড়লে বুঝা যাবে, লোকজ উপাদানের ব্যবহার থাকলেও আঞ্চলিক শব্দের ব্যবহার কম; প্রায় নেই বললেই চলে। এখানেও জসীমের মুন্সিয়ানার পরিচয় পাওয়া যায়। সোজন বাদিয়ার ঘাট কবি জসীমউদ্দীনের দ্বিতীয় আখ্যান কাব্য। নকশীকাঁথার মাঠ কাব্যের মতো এটাও জনপ্রিয়তা পেয়েছে। টঘঊঝঈঙ কর্তৃক ‘এুঢ়ংু যিধৎভ’ নামে অনূদিত হয়ে আন্তর্জাতিক পাঠক-সমাজে পরিচিতিলাভ করেছে। দুটি আখ্যান কাব্যই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশচন্দ্র সেন, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরসহ বিদেশী অনেক মনীষী কর্তৃক প্রশংসিত হয়েছে। দুটো কাব্যেই অসাম্প্রদায়িকতা দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। আবহমানকাল থেকেই বাংলাদেশের অনেক অঞ্চল/গ্রামে হিন্দু-মুসলমানদের একত্রে বসবাস। সম্প্রীতির পরিচয় আছে। বিভিন্ন কারণে দুই ধর্মের মধ্যে মারামারী ও দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে যায়। কবি এরূপ বর্ণনায় অসাম্প্রদায়িক হিসাবে চরম নিরপেক্ষতার বর্ণনা দিয়েছেন। অন্য আখ্যান-কাব্যেও তাই। এটাও কিন্তু আধুনিকতা ও উদারনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হিন্দু কিশোরী দুলালী বা দুলী ও মুসলমান কিশোর সুজনের প্রেম নিয়ে মুসলমান ও হিন্দুদের মধ্যে দাঙ্গা লেগে যায়। নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে জসীমউদ্দীন লিখলেন, ‘এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে/মাথার ওপর একই আকাশ ভাসছে রঙের নীলে/এক মাঠেতে লাঙল ঠেলি, বৃষ্টিতে নাই, রৌদ্রে পুড়ি/সুখের বেলায় দুখের বেলায় ওরাই মোদের জোড়ের জুড়ি।’-(সোজন বাদিয়ার ঘাট) কবি জসীমউদ্দীনের নকশীকাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, সখিনা ইত্যাদি কাহিনী কাব্য এদিক হিসাবে স¤পূর্ণ নতুন। আধুনিক বাংলা কাব্যে যারা আখ্যান-কাব্যের রচয়িতা তারা কেউই জসীমউদ্দীনের মতো এভাবে মৌলিক কাহিনী নির্মাণ করেননি। এসব আখ্যান কাব্যের মূল উপাদান লোকজ থেকে নেয়া। অন্যেরা বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ বা ধর্মীয় স¤পর্কিত কাহিনী থেকে নিয়েছেন। কিন্তু কবি জসীমউদ্দীন নিয়েছেন ঘর থেকে, গ্রাম থেকে, পল্লী গ্রাম-বাংলা থেকে। এখানে তিনি মৌলিক ও অনন্য। তবে কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে এবং উপমা-চিত্রকল্পে তার রচনায় লোক-কাব্য, পুঁথি-সাহিত্য, লোক-সঙ্গীতের কিছু প্রভাব রয়েছে। কবি জসীমউদ্দীন বেশ কিছু জনপ্রিয় গানের গীতিকার। এমন সব গান কে না শুনেছেন! গান নিয়ে সঙ্গীত গ্রন্থগুলো- রঙিলা নায়ের মাঝি (১৯৩৫), গাঙের পাড় (১৯৬৪), জারি গান (১৯৬৮), মুর্শিদী গান (১৯৭৭)। বোবা কাহিনী (১৯৬৪) নামে একটি উপন্যাস লিখেছেন। তার ভ্রমণকাহিনীগুলো চমৎকার। চলে মুসাফির (১৯৫২), হলদে পরির দেশ (১৯৬৭), যে দেশে মানুষ বড় (১৯৬৮) ও জার্মানির শহরে বন্দরে (১৯৭৫)। নাটক ও আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও আছে। রাখালী (১৯২৭) কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। এছাড়া বালুচর (১৯৩০), ধানখেত (১৯৩৩), হাসু (১৯৩৮), মাটির কান্না (১৯৫১), এক পয়সার বাঁশি (১৯৫৬), হলুদ বরণী (১৯৬৬), জলে লেখন (১৯৬৯), পদ্মা নদীর দেশে (১৯৬৯), দুমুখো চাঁদ পাহাড়ি (১৯৮৭) উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ। আধুনিক কবিতায় অলঙ্কারের প্রয়োগ লক্ষণীয়। কবি জসীমউদ্দীন কবিতায় উপমা-উৎপ্রেক্ষা, সমাসোক্তি ও অন্যান্য অলঙ্কারের যুতসই ব্যবহার ও প্রয়োগ দেখা যায়। তার অলঙ্কারের বেশিরভাগ উপাদানই লোকজ। যুতসই উপমা ও অনুপ্রাসের ব্যবহার কবিতার শিল্পগুণকে উন্নীত করেছে। প্রতিনিধি হিসাবে কিছু উল্লেখ করছি। প্রথমেই ‘নকশীকাঁথার মাঠ’ থেকে কিছু অলঙ্কারিক (উপমা ও অনুপ্রাস) প্রয়োগ দেখে নিই- ‘কাঁচা ধানের পাতার মতো কচি মুখের মায়া’, ‘লাল মোরগের পাখার মতো ওড়ে তাহার শাড়ি’, ‘কচি কচি হাত-পা সাজুর সোনার সোনার খেলা, (যমক)/তুলসী তলার প্রদীপ যেন জ্বলছে সাঝের বেলা’, ‘তুলসী ফুলের মঞ্জুরি কি দেব দেউলেত ধূপ’, ‘কালো মেঘা নামো নামো, ফুল তোলা মেঘ নামো’, ‘বাজে বাঁশি বাজে, রাতের আঁধারে, সুদূর নদীর চরে,/উদাসী বাতাস ডানা ভেঙে পড়ে বালুর কাফন পরে’-(সমাসোক্তিসহ), ‘হেমন্ত চাঁদ অর্ধেক হেলি জ্যোৎ¯œায় জাল পাতি,/টেনে টেনে তবে হয়রান হয়ে, ডুবে যায় সারারাতি।’-(সমাসোক্তির প্রয়োগ, নকশীকাঁথার মাঠ), ‘উদয় তারা আকাশ-প্রদীপ দুলিছে পূবের পথে,/ভোরের সারথী এখনও আসেনি রক্ত-ঘোড়ার রথে’।-(সোজন বাদিয়ার ঘাট) রূপক, উপমা, প্রতীক, রূপকল্পের বিচিত্র, নৈপুণ্যপূর্ণ ব্যবহার আধুনিক কবিতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য। আগের যুগেও এর ব্যবহার ছিল। চিরচেনা পরিবেশ নিয়ে জসীমউদ্দীনের কবিতার চিত্রায়ণ খুব স্বাভাবিক বিষয় বলেই মনে হয়। আশপাশের লোকজ উপাদানের এমন কিছু কবিতাংশ তুলে ধরছি- (১) ‘মাঠের যতনা ফুল লয়ে দুলী পরিল সারাটি গায়,/খোঁপায় জড়ালো কলমীর লতা, গাঁদা ফুল হাতে পায়।’-(সোজন বাদিয়ার ঘাট) (২) ‘এই গাঁয়ের এক চাষার ছেলে লম্বা মাথার চুল,/কালো মুখেই কালো ভ্রমর, কিসের রঙিন ফুল!/কাঁচা ধানের পাতার মতো কচি-মুখের মায়া, /তার সঙ্গে কে মাখিয়ে দেছে নবীন তৃণের ছায়া।/জালি লাউয়ের ডগার মতো বাহু দুখান সরু,/গা খানি তার শাওন মাসের যেমন তমাল তরু।/বাদল ধোয়া মেঘে কেগো মাখিয়ে দেছে তেল,/বিজলী মেয়ে পিছে পড়ে ছড়িয়ে আলোর খেল।’-(নকশীকাঁথার মাঠ) বলে রাখি এমন সাধারণ উপাদানে অসাধারণ বুননের কবিতা অনেক। উল্লেখিত কবিতাংশ তার কবিতার প্রতিনিধি হিসাবেই ধরে নেয়া শ্রেয় হবে। চরিত্র নির্মাণে (বিশেষত নায়ক-নায়িকা) কবি জসীমউদ্দীন মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। উপমার প্রয়োগে মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন। আর অন্ত্যানুপ্রাস তো কবির স্বভাবজাত। (১)‘সোজন যেন বা তটিনীর কূল, দুলালী নদীর পানি/জোয়ারে ফুলিয়া ঢেউ আছড়িয়া কূল করে টানাটানি/নামেও সোজন, কামেও তেমনি, শান্ত স্বভাব তার/কূল ভেঙে নদী যতই বহুক, সে তারি গলার হার।’- (সোজন বাদিয়ার ঘাট) (২) সকিনা আখ্যান কাব্যে নায়িকা সকিনাকে নিয়ে নায়ক আদিলের স্বপ্ন; জসীমউদ্দীনের কবিতায়, ‘সকিনারে লয়ে আদিল এবার পাতিল সুখের ঘর,/বাবুই পাখিরা নীড় বাঁধে যথা তালের গাছের পর।/স্রোতের শেহলা ভাসিতে ভাসিতে একবার পাইল কূল,/আদিল বলিল, ‘গাঙের পানিতে কুড়ায়ে পেয়েছি ফুল’।/এই ফুল আমি মালায় মালায় গাঁথিয়া গলায় পরিয়া নেব,/এই ফুল আমি আতর করিয়া বাতাসে ছড়ায়ে দেব।/এই ফুল আমি লিখন লিখিব, ভালবাসা দুটি কথা,/এই ফুলে আমি হাসিখুশি করে জড়াব জীবনলতা।’ প্রেমিক-প্রেমিকার বিরহ-বেদনার বর্ণনাতেও নিখুঁত। এ যেন মধ্যযুগের কবি বিদ্যাপতির ‘এ সখী হামারি দুখের নাহি ওর।/এ ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর’ কবিতাংশের মতো জসীমউদ্দীনের স্বর: ‘আজকে দুলীর বুক ভরা ব্যথা, কহিয়া জুড়াবে/এমন দোসর কেহ নাই হায় তার,/শুধু নিশাকালে, গহন কাননে, থাকিয়া থাকিয়া/কার বাঁশি যেন বেজে মরে বারবার।/..কে বাঁশি বাজায়! কোন দূর পথে গভীর রাতের/গোপন বেদনা ছাড়িয়া উদাস সুরে,/দুলীর বুকের কান্দনখানি সে কি জানিয়াছে,/তাহার বুকেরে দেখেছে সে বুকে পুরে?’(সোজন বাদিয়ার ঘাট) জসীমউদ্দীন সংকীর্ণ অর্থে পল্লীকবি নন। নকশীকাঁথার মাঠ, সোজন বাদিয়ার ঘাট, সকিনা ইত্যাদির উপাদান-উপকরণ পল্লীতে পাওয়া গেলেও কাহিনীবুনন, কবিতায় শব্দচয়ন, উপমা-উৎপ্রেক্ষা, চিত্রকল্প, প্রতীক ও রূপক নির্মাণ শিল্পসম্মত ও আধুনিক। কবি হিসাবে তিনি শুধু পল্লীর নন, আবার শহরেরও নন। বরং এই দুয়ের মধ্যে সংযোগ সেতু। রবীন্দ্রনাথের মতে, জসীমউদ্দীনের কবিতার ভাব, ভাষা ও রস স¤পূর্ণ নতুন ধরনের। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল কিংবা তার সমসাময়িক কবিদের কাব্যরীতির অনুসরণ-অনুকরণ না করে লোক-ঐতিহ্যের ধারা নিয়েই সাহিত্যরচনা করেছেন। তাঁর কবিতায় যেমন আছে প্রেম, মৃত্যু, তেমনি আছে চর দখলের লড়াই, আবার আছে অধিকার আদায়েরও লড়াই। জসীমউদ্দীনের চরিত্র ও নায়ক-নায়িকা আমাদের খুব চেনা ও আপন। ঘটনাবলিও চিরচেনা। চেনা-পরিবেশের শব্দাবলী নিয়ে খেলা করেছেন এবং আমাদের মনে গেঁথে গেছেন। আমাদের মনের প্রতিনিধি হয়ে তিনিই কথা বলেছেন; কবিতার মাধ্যমে। সে বিচারে তিনি আমাদের মানস-কবিও বটে।
×