ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

৪০ বছর পর আধুনিক লাগেজ ভ্যান কেনা হচ্ছে

পণ্য পরিবহনে নতুন করে গতি আনছে রেলওয়ে

প্রকাশিত: ২৩:০৭, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২০

পণ্য পরিবহনে নতুন করে গতি আনছে রেলওয়ে

মশিউর রহমান খান ॥ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বগিতে আনা হবে সাধারণ ও পচনশীল তথা বিশেষায়িত মালামাল। প্রথমবারের মতো মাছ, মাংস, ফল, শাক-সবজি মালবাহী ট্রেনে পরিবহন করার পরও থাকবে সম্পূর্ণ সতেজ। রেফ্রিজারেটর তথা ফ্রিজিং সিস্টেম থাকবে মালবাহী ট্রেনে। সময়মতো ছাড়বে এসব মালবাহী ট্রেন। একইসঙ্গে নির্ধারিত সময়েই গন্তব্যে এসে পৌঁছবে মিটার গেজ ও ব্রডগেজ উভয় পথে চলবে এসব ট্রেন। মালবাহী পণ্য পরিবহনের বগিগুলোও হবে কয়েকগুণ বেশি গতিসম্পন্ন। এছাড়া যে কোন সময় মালবাহী ট্রেন থামাতে চাইলেই মাত্র ২০ সেকেন্ডের মধ্যেই থামানো যাবে এসব মালবাহী ট্রেন। ট্রেনের গতি হবে সাধারণ যাত্রীবাহী ট্রেনের মতোই। অন্য ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই দ্রুতগতিতে ছুটে চলবে এসব মালবাহী ট্রেন। পণ্য পরিবহনে কোন অভিযোগ থাকলে দ্রুতই তা সমাধান করা হবে। কৃষক বা ব্যবসায়ীর দেরিতে মালামাল পৌঁছলে উপযুক্ত কারণ বর্ণনা করতে হবে। এ জন্য আনা হচ্ছে আধুনিক সুবিধাসমৃদ্ধ লাগেজ ভ্যান। এভাবেই যাত্রী পরিবহনের পাশপাশি পণ্য পরিবহনে নতুন করে গতি আনতে চায় বাংলাদেশ রেলওয়ে। রেল সূত্র জানায়, সর্বোচ্চ গুরুত্বের সঙ্গে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে সাধারণ ও বিশেষায়িত সকল প্রকার পণ্য রেলওয়ের মাধ্যমে পরিবহন করতে নাগরিকদের উদ্ধুদ্ধ করতে চায় সংস্থাটি। কম সময়ে ও নির্ধারিত মূল্যেই গন্তব্যে পৌঁছবে সকল প্রকার পণ্য এমন উদ্যোগ বাস্তবায়নে এবার মনোযোগ দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। এরই অংশ হিসেবে স্টেইনলেস স্টিলের তৈরি আধুনিক সুবিধাসমৃদ্ধ ও উচ্চ গতিসম্পন্ন অটোমেটিক এয়ার ব্রেক সিস্টেম সম্বলিত ১২৫টি লাগেজ ভ্যান কিনছে রেলওয়ে। তাই যাত্রী পরিবহনের পাশাপাশি মালামাল ও বিশেষায়িত পণ্য পরিবহনের লক্ষ্যে দীর্ঘ ৪০ বছর পর এ সকল লাগেজ ভ্যান সংগ্রহ করা হচ্ছে। রেল সূত্র জানায়, নতুন আনা এসব ভ্যানে রেফ্রিজারেটর সিস্টেম থাকায় বিভিন্ন প্রকার খাদ্যদ্রব্য, মাছ, মাংস, দুধ, শাক-সবজি, ফলমূল ও অন্যান্য পচনশীল দ্রব্য কম খরচে ও কম সময়ের মধ্যে নিরাপদে গন্তব্য স্থলে পৌঁছাতে সক্ষম হবে। যার ফলে কৃষক ও কৃষি পণ্য পরিবহনের সঙ্গে জড়িতরা বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি লাভবান হবেন। ভবিষ্যতে কৃষকের পণ্য সরাসরি ভোক্তার নিকট পৌঁছানোর উদ্যোগ হিসেবে লাগেজ ভ্যান ক্রয় করা হচ্ছে। এতে করে কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবে। সর্বশেষ ১৯৮০ সালের দিকে মালবাহী ট্রেন আনে বাংলাদেশ রেলওয়ে। তবে এসব ট্রেনে যে কোন ফ্রিজিং সিস্টেম ছিল না। ফলে শুকনো খাবার ও পণ্য আনাই সম্ভব হতো। তাই দীর্ঘ বছর পর রেল কর্তৃপক্ষ আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে টেম্পারেচার কন্ট্রোলিং সিস্টেম সম্পন্ন আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন মালবাহী ট্রেন আনছে রেল কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে যেসব মালবাহী ট্রেন রয়েছে সেসব ট্রেনের বগির মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। বর্তমানে অনেকটা ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে চলছে পণ্যবাহী ট্রেন। ফলে পণ্য পরিবহনে অনেকটা পিছিয়ে রয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। বর্তমানে মেয়াদোত্তীর্ণ বগি থাকায় ও ধীর গতিসম্পন্ন মালবাহী ট্রেন চলাচল করায় অনেক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তাদের পণ্য রেলপথে পরিবহন করতে আগ্রহী হচ্ছে না। ফলে প্রতিবছর লক্ষ্যমাত্রার অনেক কম পণ্য পরিবহন করছে রেলওয়ে। এর মধ্যে নাগরিকদের ও ব্যবসায়ীদের পণ্য পরিবহনে রেলের চেয়ে সড়ক পথকেই বেছে নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। রোলিং স্টক ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের মাধ্যমে আনা ১২৫টি ল্যাগেজ ভ্যান কিনতে সিডি-ভ্যাট ছাড়া প্রায় ৩৫৮ কোটি ৩৯ লাখ টাকার ব্যয় হবে। চীনের অর্থায়নে চলমান চলমান লাগেজ ভ্যান ক্রয়ের সিডি ভ্যাটের অর্থ দেবে সরকার। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের অধীনে নতুন আরও ৪০টি লোকোমেটিভ আমেরিকা থেকে আনার জন্য চুক্তি ইতোমধ্যেই সম্পন্ন হয়েছে। করোনার প্রভাব না পড়লে আগামী ২০২১ সালের মার্চ নাগাদ এসব লোকোমেটিভ বাংলাদেশে আনা হবে বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে। সম্প্রতি এসব লাগেজ ভ্যান কিনতে চুক্তি স্বাক্ষর হয়। এ সময় বাংলাদেশের পক্ষে প্রকল্প পরিচালক মোঃ মিজানুর রহমান এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান চীনের সিএনটিক-রেলটেকো-জিনসি, যৌথ কোম্পানির ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার ইয়াং বিং স্বাক্ষর করেন। প্রকল্প সূত্র জানায়, চুক্তির পর থেকে পরবর্তী ২০ মাসের মধ্যেই এসব লাগেজ কেনা হবে। এরপর পরবর্তীতে মোট ২৭ মাসের মধ্যে এসব ভ্যান সরবরাহ করবে। জানা গেছে, স্টেইনলেস স্টিলেল তৈরি এসব লাগেজে তুলনামূলক কম ক্ষয় হবে ও পানি পড়লেও মরিচা ধরবে না বিধায় বেশি দিন স্থায়ী হবে। বর্তমানে মালবাহী ট্রেনগুলোর গতি সর্বোচ্চ ৪৫ কিলোমিটার হলেও এসব লাগেজ ভ্যানের গতি হবে ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার। এসব লাগেজের বগিও হবে অত্যন্ত শক্তিশালী। যা পণ্য নিয়েও স্বাভাবিক ট্রেনের মতোই একই গতি নিয়ে চলবে। ফলে মালবাহী ট্রেনের এক নতুন যুগে পদার্পণ করবে। প্রতিটি মালবাহী ট্রেনের স্থায়িত্বকাল ৩৫ বছর ধরা হলেও চলমান বগিগুলো চলছে সর্বনি¤œ ৪০ বছর থেকে ৫০ বছর ধরে। নতুন এসব লাগেজ ভ্যান আনার পর মালবাহী ট্রেন চালু করা হলে পণ্য পরিবহনে এক নতুন গতির সঞ্চার হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রোলিং স্টক ইমপ্রুভমেন্ট প্রকল্পের পরিচালক মোঃ মিজানুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ২০১৭ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পে দেশে এই প্রথমবারের মতো আমরা আধুনিক সুবিধাসম্পন্ন লাগেজ ভ্যান ক্রয় করার চুক্তি সম্পন্ন করেছি। এসব লাগেজ ভ্যানে মালামাল পরিবহন করা হবে। আগে পণ্যবাহী ট্রেনে মাছ মাংস শাক সবজি ফ্রিজিং আকারে ও টেম্পারেচার সিস্টেম না থাকায় কৃষকগণ ও এ সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের বাজার সম্প্রসারণ করতে পারতেন না। ফলে নিজেরা আর্থিকভাবে বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতো। এসব লাগেজ ভ্যানে কোন পণ্য আনা হলে তা সম্পূর্ণ সতেজ থাকবে। যার ফল ক্রেতারাও সরাসরি পাবেন। এছাড়া এ প্রকল্পের অধীনে নতুন আরও ৪০টি লোকোমেটিভ আমেরিকা থেকে আনার জন্য চুক্তি করা হয়েছে। আশা করি আগামী ২০২১ সালের মার্চ নাগাদ এসব লোকোমেটিভ বাংলাদেশে আনা হবে। ফলে রেলওয়েতে গতি সঞ্চার হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ রেলওয়েকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে রেলওয়ের উন্নয়নের জন্য ব্যাপক কর্মসূচী গ্রহণ করেছেন। আমরা রেলওয়েতে পণ্য পরিবহনে গতি আনতে বদ্ধপরিকর। এরই অংশ হিসেবে ভবিষ্যতে কৃষকের পণ্য সরাসরি ভোক্তার নিকট পৌঁছানোর উদ্যোগ হিসেবে আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন টেম্পারেচার কন্ট্রোল সিস্টেমের মিটারগেজ ও ব্রডগেজ লাইনে চলার জন্য ১২৫টি লাগেজ ভ্যান ক্রয় করা হচ্ছে। বর্র্তমানে মালবাহী ট্রেনগুলোর গতি সর্বোচ্চ ৪৫ কিলোমিটার হলেও ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১২০ কিলোমিটার গতির নতুন আনা এসব লাগেজ ভ্যান সময়মতো ও অনেক কম সময়ে গন্তব্যস্থলে এসে পৌঁছাবে। এতে করে কৃষক তার পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবে একই সঙ্গে নাগরিকগণ তৃণমূলে উৎপাদিত তাজা মাছ মাংস খেতে পারবেন। মন্ত্রী বলেন, এখন থেকে মালামাল পরিবহনে গতি আনতে পণ্য পরিবহন সংক্রান্ত কোন অভিযোগ থাকলে দ্রুতই তা সমাধান করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া কৃষক বা ব্যবসায়ীর দেরিতে মালামাল পৌঁছালে উপযুক্ত কারণ বর্ণনা করতে হবে। রেলপথমন্ত্রী বলেন, আমরা রেলবহরে নতুন এসব লাগেজ ভ্যান যুক্ত করতে দীর্ঘ ৪০ বছর নতুন বগি আনতে চীনের সঙ্গে সম্প্রতি চুক্তি সম্পন্ন করেছি। লাগেজ ভ্যানের স্থায়িত্বকাল ৩৫ বছর ধরা হলেও চলমান বগিগুলো চলছে সর্বনিম্ন ৪০ বছর থেকে ৫০ বছর ধরে। যার ফলে তুলণামূলক অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। নতুন বগিযুক্ত মালবাহী ট্রেন যে কোন সময় থামাতে চাইলেই মাত্র ২০ সেকেন্ডের মধ্যেই থামানো যাবে। এসব পণ্যবাহী ট্রেনের গতি হবে সাধারণ যাত্রীবাহী ট্রেনের মতোই। অন্য ট্রেনের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই দ্রুতগতিতে ছুটে চলবে এসব মালবাহী ট্রেন।
×