ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মানুষের মনে ঝুঁকিপূর্ণ আস্থা স্বাস্থ্যবিধি মানার কোন বালাই নেই

সবই যেন স্বাভাবিক ॥ করোনার অস্তিত্ব থেকেও নেই

প্রকাশিত: ২১:৫৪, ১৪ আগস্ট ২০২০

সবই যেন স্বাভাবিক ॥ করোনার অস্তিত্ব থেকেও নেই

নিখিল মানখিন ॥ দেশে বিরাজ করছে করোনাময় স্বাভাবিকতা। সরকারী বিধি-নিষেধ থাকলেও স্বাভাবিক সময়ের মতোই মানুষের চলাফেরা। স্বাস্থ্যবিধি মানার বালাই নেই। মানুষের আচরণে মনেই হয়না করোনার মতো ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি বিরাজমান। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের ধারণা, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু এলোপাতাড়ি সিদ্ধান্তে করোনা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক ভাবতে শুরু করেছে মানুষ। করোনাভাইরাস থেকেও যেন নেই। এক ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ আস্থা তৈরি হয়েছে মানুষের মনে। এর ফলে করোনা সংক্রমণ যেমন কমছে না তেমনি পরিস্থিতি এগিয়ে চলেছে ভয়াবহ গন্তব্যে। দেশের করোনা পরিস্থিতি এখনও ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি আইইডিসিআর ও আইসিডিডিআরবির এক যৌথ জরিপে বলা হয়েছে, রাজধানীর অন্তত ৯ শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত। এই হিসেবে রাজধানীতে আক্রান্ত অন্তত ১৮ লাখ মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিভিন্ন জরিপ এবং দৈনিক রোগী শনাক্তের হার দেখিয়ে দিচ্ছে বাংলাদেশ এখনও করোনার প্রবল থাবা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। বর্তমান অবস্থা থেকে হঠাৎ করেই দেশের করোনা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। করোনাভাইরাসের সংক্রমণরোধে মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত বিধি-নিষেধসহ বিভিন্ন কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল সরকার। পরবর্তীতে দেশের মানুষের জীবনযাত্রার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে একে একে প্রায় সব ক’টি বিধি-নিষেধ উঠিয়ে দেয়া হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু করা ছাড়া দেশের মানুষের জীবনযাত্রা যেন স্বাভাবিক হয়ে পড়ছে। বিধি-নিষেধ উঠিয়ে দিয়ে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা, মাস্ক পরিধান, অপ্রয়োজনে বাসার বাইরে না যাওয়াসহ বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দিয়েছিল সরকার। শিথিল করা মানে স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা নয়- এই নির্দেশনাটি সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে সরকার। বাস্তবে ওই সব নির্দেশনা পালন না করার কারণে দেশে যেন করোনাময় স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। অর্থাৎ প্রতিদিনের কয়েক হাজার নতুন রোগী শনাক্ত এবং দৈনিক গড়ে ত্রিশজনের মৃত্যুর খবরও মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার ক্ষেত্রে সচেতন করে তুলতে পারছে না। করোনাময় স্বাভাবিক অবস্থা ॥ করোনার মহামারীতেও যেন করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আগের পরিবেশ ফিরে এসেছে বাংলাদেশে। উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার মানসিকতা ও সচেতনতা অনেক আগেই উঠে গেছে। গত জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতেও একই চিত্র বেশ লক্ষণীয়। খোদ রাজধানীতেই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা তো দূরের কথা, মুখে মাস্ক ব্যবহারকারীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাজধানীর সর্বত্র করোনাপূর্ব পরিবেশ বিরাজ করছে। ফুটপাথে জমে উঠেছে ভাসমান চা দোকানের ব্যবসা। চা দোকানগুলোর সামনে ছোট্ট জায়গায় গাদাগাদি করে বসে চা খাওয়ার ভিড়। বসার জায়গা না পেয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন অনেকে। চা খাওয়ার অজুহাতে চলছে আড্ডা। নামমাত্র সামান্য পানিতে ধোয়া একই কাপ মিশে যাচ্ছে অসংখ্য মানুষের ঠোঁটে। চায়ের সঙ্গে চলছে সিগারেট। একই খোলা সিগারেটের প্যাকেটে হাত লাগাচ্ছে অনেক ক্রেতা। সিগারেট জ¦ালাতে ব্যবহার করা হচ্ছে একই লাইটার। একই সিগারেট কয়েকজনের মধ্যে ভাগাভাগি করে খাওয়ার দৃশ্যও ফিরে এসেছে। মগবাজার নিউ ইস্কাটন রোডের মুক্তিযোদ্ধা সংসদের গলির মাথায় সাজানো হয়েছে তিনটি চা দোকান। তাদের একজন হলেন মোঃ জাহাঙ্গীর। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, মানুষ এখন করোনাভাইরাসে ভয় পায় না। সারাদিন চা-সিগারেট বিক্রি হয়। চা-সিগারেট খাওয়া মানুষের অভাব নেই। আমাদের মধ্যেও করোনা ভয় কেটে গেছে। কেউ স্মরণ করিয়ে না দিলে করোনার কথা মনে পড়ে না। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে ঝুঁকি নিয়েও দোকান চালাতে হচ্ছে বলে জানান মোঃ জাহাঙ্গীর। স্বাস্থ্যবিধি না মেনেই অপ্রয়োজনে বাইরে দলবদ্ধভাবে আড্ডা শুরু হয়ে গেছে। মাস্ক ছাড়াই কাছাকাছি, মুখোমুখি বসে যেখানে সেখানে আড্ডা জমিয়ে তোলা হচ্ছে। জেলা ও উপজেলা শহরগুলোতে এই চিত্র আরও সুস্পষ্ট। কারও কিছু বলার নেই। স্বাস্থ্যবিধির বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিতে গিয়ে নাজেহাল হওয়ার ঘটনাও ঘটছে। অতিরিক্ত যাত্রী বহন, এক সিটে একাধিক যাত্রী নেয়া, ড্রাইভার, কন্ডাক্টর, হেলপার স্বাস্থ্যবিধি না মেনে মাস্ক গলায় ঝুলিয়ে রাখা, গাড়িতে হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার না করে বা হ্যান্ড গ্লাভস না পরে ভাড়া আদায় করা হচ্ছে রাজধানীর অনেক গণপরিবহনে। অনেক সময় স্বাস্থ্যবিধিহীন পরিবেশ দেখেও যাত্রীরাও পরিবহনে তুলতে হেলপারদের বাধ্য করান। রিক্সাচালকদের কারও মুখে মাস্ক নেই। যাত্রী সতর্ক না থাকলে চলন্ত অবস্থায় রিক্সাচালকের শ^াস-প্রশ^াস ও হাঁচি-কাশি অতি সহজেই যাত্রীকে আক্রান্ত করতে পারে। সরেজমিন ঘুরে আরও দেখা গেছে, কাঁচাবাজারসহ অলিগলির নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর দোকানগুলোতেও দেদার স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করা হচ্ছে। দোকানদার ও ক্রেতাদের অধিকাংশই মাস্ক পরে না। ক্রেতাদের মধ্যেও করোনা ভীতি আর নেই। অপেক্ষায় না থেকে আগে জিনিস কেনার জন্য এক ক্রেতা আরেক ক্রেতার মুখের কাছে হেলে গিয়ে পণ্য বাছাই করার দৃশ্য আজ যেন স্বাভাবিক ঘটনা। শাক-সবজির দোকানগুলোতে এই দৃশ্য বেশি দেখা যায়। আর এলাকার কাঁচাবাজার ও মাছের বাজারগুলোর অবস্থা তো অনেকটা ভীতিকর। ঠেলাঠেলি ছাড়া বাজারের ভেতরে যাওয়া অসম্ভব। তার ওপর আবার অধিকাংশের মুখে মাস্ক নেই। এসব জায়গায় সামাজিক দূরত্ব কার্যকর করা তো ভাবাই যায় না। মন্ত্রণালয়ের কিছু বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত পরিস্থিতি হালকা করে তুলছে ॥ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু বক্তব্য ও সিদ্ধান্ত করোনা পরিস্থিতি হালকা করে তুলছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। করোনা মোকাবেলা কার্যক্রম ঢেলে সাজাতে গিয়ে আবার আলোচনায় উঠে এসেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অকার্যকর হয়ে পড়ছে করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে গঠিত বিভিন্ন কমিটির কার্যক্রম। মাঠ পর্যায়ের কমিটিগুলোর সঙ্গে কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পর্ক ও যোগাযোগ না থাকার অভিযোগ উঠেছে। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার ক্ষেত্রেও বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছে। জোনভিত্তিক লকডাউন নিয়ে আলোচনা নেই। হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলোতে অভিযান না চালানোর মনোভাবের বিষয়টিও সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। সর্বশেষ উঠিয়ে দেয়া হয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা বিষয়ক অনলাইন ব্রিফিং ‘হেলথ বুলেটিন’। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এই ব্রিফিং বন্ধ করে দেয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, এতে গণমানুষের মনে শৈথিল্য বাড়বে। সৃষ্টি হবে গুজবের ডালপালা। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বেশ কিছু নতুন সিদ্ধান্তে অনাস্থা প্রকাশ করেছে চিকিৎসক সম্প্রদায়। জনবল পুনর্গঠনের বিষয়টি প্রশংসিত হলেও গত কয়েক সপ্তাহে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন বক্তব্য ও গৃহীত পদক্ষেপগুলো সমালোচনায় পড়েছে। করোনা মোকাবেলায় স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে প্রধান করে গঠিত হয় জাতীয় করোনা প্রতিরোধ কমিটি। এই কেন্দ্রীয় কমিটির আওতায় পরবর্তীতে জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে করোনা কমিটি গঠিত হয়। বর্তমানে ওই সব কমিটির দৃশ্যমান কর্মতৎপরতা নেই। বিষয়টি নিয়ে আলোচনাও হয় না। এপ্রিলের শেষ দিকে বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এবং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ১৭ বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে ‘জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি’ গঠন করে সরকার। কমিটির সভাপতি করা হয়েছে, বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ও শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহকে। সদস্য সচিব হিসেবে আছেন রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা। আর গত ২৮ মার্চ ৮ জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘জনস্বাস্থ্য বিষয়ক বিশেষজ্ঞ কমিটি।’ এই কমিটিরও কর্মতৎপরতা নেই। জনবল রদবদল ছাড়াও স্বাস্থ্য সেক্টরে বেশ কিছু নতুন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। নতুন সিদ্ধান্তসমূহ গ্রহণ করতে গিয়ে করোনা মোকাবেলায় গঠিত বিভিন্ন কমিটিসহ ইতোমধ্যে ঘোষিত কর্মসূচী সমূহ আলোচনার বাইরে চলে যাচ্ছে। বন্ধ হয়ে গেছে স্বাস্থ্য অধিদফতরের করোনা পরিস্থিতি বিষয়ক নিয়মিত অনলাইন স্বাস্থ্য বুলেটিন। দেশের করোনা পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এই অনলাইন করোনা বুলেটিনের মঙ্গলবার ছিল শেষ দিন। বুধবার থেকে দুপুর আড়াইটায় নিয়মিত এই বুলেটিন আর হচ্ছে না। বুধবার থেকে গণমাধ্যমের কাছে প্রেস রিলিজ আকারে করোনা বিষয়ক আপডেট পাঠানো হবে বলে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে। মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্ত দেশের করোনা পরিস্থিতি ও মোকাবেলার বিষয়টি হালকা করে দিয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মিডিয়ায় সাক্ষাতকার দেয়ার সুযোগ সঙ্কুচিত করেছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অধিদফতরের পক্ষে বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সাক্ষাতকার প্রদান ও টকশোতে অংশগ্রহণের আগে স্বাস্থ্য মহাপরিচালকের অনুমতি লাগবে। বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে ব্রিফিং ও সাক্ষাতকার প্রদান বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের বিষয়ে অংশগ্রহণকারীকে ন্যূনতম পরিচালক পদমর্যাদার কর্মকর্তা হতে হবে। গত ৬ আগস্ট স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের যুগ্ম-সচিব (প্রশাসন অধিশাখা) মোঃ জিল্লুর রহমান চৌধুরী স্বাক্ষরিত চিঠিতে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। চিকিৎসকদের করোনাকালীন কর্মঘণ্টা ও কোয়ারেন্টাইনে থাকার বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রটি প্রত্যাখ্যান করে তা প্রত্যাহারের অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ মেডিক্যাল এ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)। পরিপত্রটি অবৈজ্ঞানিক অভিহিত করে বিএমএ নেতৃবৃন্দ বলেন, একটি মহল কৌশলে চিকিৎসকদের সরকার ও জণগণের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। অথচ স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদফতরের ভুলের কারণে ইতোমধ্যে প্রায় তিন হাজার চিকিৎসক করোনায় সংক্রমিত এবং ৭০ জন চিকিৎসক শাহাদাতবরণ করেছেন। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর কাছে দেয়া সংগঠনটির সভাপতি ডাঃ মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ও মহাসচিব ডাঃ মোঃ ইহতেশামুল হক চৌধুরী স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে এমন অভিযোগ তোলা হয়েছে। দেশে করোনাভাইরাসের বাস্তব চিত্র ॥ মানুষ আমলে না নিলেও বাংলাদেশ এখনও করোনাভাইরাসের প্রবল ঝুঁকিতে রয়েছে বলে সরকারী প্রতিষ্ঠানের গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশ পেয়েছে। করোনায় জর্জরিত একের পর এক দেশকে টপকিয়ে সামনের স্থান দখল করে নেয়া এবং দৈনিক করোনা রোগী শনাক্তের উচ্চ হার দেখিয়ে দিচ্ছে যে, বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি প্রবল ঝুঁকিতেই রয়েছে। কয়েক দিন আগে প্রকাশিত করোনা পরিস্থিতি নিয়ে সরকারের জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এবং আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) এক যৌথ গবেষণা বলছে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকার ৯ শতাংশ মানুষ করোনায় আক্রান্ত। তাদের মধ্যে ৭৮ শতাংশই উপসর্গহীন। গত ১৮ এপ্রিল থেকে ৭ জুলাই পর্যন্ত রাজধানী ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এলাকায় জরিপ করে এ দুটি প্রতিষ্ঠান। দুই সিটির তিন হাজার ২৭৭ পরিবারের ওপর এ জরিপ পরিচালনা করা হয়। এর মধ্যে ২১১ লক্ষণযুক্ত পরিবার পাওয়া যায়। এসব লক্ষণযুক্ত পরিবারের মধ্যে থেকে ৪৩৫ উপসর্গহীন ব্যক্তি শনাক্ত হন। এর মধ্যে ২০১ জনের পরীক্ষা করা হয়। আর উপসর্গহীন পরিবারের মধ্য থেকে ৮২৭ জন উপসর্গহীন ব্যক্তি শনাক্ত হন। তাদের মধ্য থেকে ৫৩৮ জনের পরীক্ষা করা হয়। এ জরিপে ঢাকার ছয়টি বস্তিও অন্তর্ভুক্ত ছিল। এখানে পরিবারের সংখ্যা ছিল ৭২০টি। এ বিষয়ে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডাঃ এএসএম আলমগীর বলেন, দুটি কারণে এ জরিপ হয়েছে। প্রথমটি হলো- নিজ উদ্যোগে পরীক্ষা করাতে এসেছে এবং তাদের মধ্যে পজিটিভ পাওয়া গেছে- এমন ব্যক্তিদের মাধ্যমে সমাজে রোগটি কি অবস্থায় আছে তা আমরা দেখতে চেয়েছি। আর দ্বিতীয় কারণ হলো- উপসর্গহীন মানুষও যে আছে, সেটি তুলে ধরা। আর উপসর্গ থাকুক আর না থাকুক, উভয়ের কাছে থেকে দূরত্ব বজায় রাখতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিকে দেখে সবাই ভয় পায়। কিন্তু উপসর্গহীন ব্যক্তিদের দেখে কেউ ভয় পায় না। মাস্ক পরাসহ সামাজিক দূরত্ব ও অন্যান্য নিয়ম মেনে চলার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করার জন্যই উপসর্গহীন ব্যক্তিদের বেছে নেয়া হয়েছে। এখন সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা ও মাস্ক পরার বিষয়টি আরও জোরদার করতে হবে বলে মনে করেন তিনি। করোনা বিষয়ক দৈনিক অন লাইন ব্রিফিংয়ে প্রতিদিন করোনা টেস্ট করানোর জন্য অনুরোধ জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু অধিদফতরের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না অধিকাংশ মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদ-ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনুযায়ী দৈনিক ২৪ থেকে ২৫ হাজার নমুনা পরীক্ষা হওয়া দরকার। বর্তমানে বাংলাদেশের দৈনিক নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা ১০ থেকে ১৩ হাজারে উঠানামা করছে। সীমিত নমুনা পরীক্ষার কারণে দেশে করোনাভাইরাসের নীরব সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, নমুনা পরীক্ষার জটিলতা কাটছে না। ল্যাবরেটরির সংখ্যা যতই বাড়ছে, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা ততই হ্রাস পেয়ে চলেছে। নমুনা পরীক্ষায় মানুষের আগ্রহ অনেকগুণ হ্রাস পেয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি পালন সন্তোষজনক না হওয়ায় সংক্রমণের অনুকূল পরিবেশ পেয়ে বসেছে করোনাভাইরাস। সম্প্রতি স্বাস্থ্য সেক্টরে সৃষ্ট নানা কেলেঙ্কারি ও সমন্বয়হীনতার কারণেও করোনা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কার্যক্রমের গতি হ্রাস পেয়েছে। উচ্চ রোগী শনাক্তের হার ॥ দৈনিক নতুন রোগী শনাক্তের দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। আর মোট পরীক্ষিত নমুনার ভিত্তিতে মোট শনাক্তের হার বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। তবে এশিয়ায় প্রথম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। মোট পরীক্ষিত নমুনার ভিত্তিতে মোট শনাক্তের হার মেক্সিকোতে ৪৪ শতাংশ, আর্জেন্টিয়ায় ২৮ শতাংশ, ব্রাজিলে ২১ শতাংশ , চিলিতে ২১ শতাংশ, বাংলাদেশে ২০ শতাংশ, কলম্বিয়ায় ১৯ শতাংশ, পেরুতে ১৮ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৭ শতাংশ পাকিস্তানে ১৪ শতাংশ , ইরানে ১২ শতাংশ, ভারতে ৯ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৮ শতাংশ, সৌদি আরবে ৮ শতাংশ, ফ্রান্সে ৬ শতাংশ, স্পেনে ৫ শতাংশ, তুরস্কে ৫ শতাংশ, ইতালিতে ৪ শতাংশ, জার্মানিতে ৩ শতাংশ, রাশিয়ায় ৩ শতাংশ ও যুক্তরাজ্যে ২ শতাংশ। নমুনা সংখ্যার অবস্থা ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের বুলেটিনে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১ জুন থেকে দৈনিক পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা ১১ হাজারে উঠে আসে এবং তা জুন মাসজুড়ে ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। দৈনিক পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ১৫ জুন ১৪ হাজারে এবং ২০ জুনের মধ্যে ১৫ হাজারে পৌঁছে যায়। এভাবে ২৫ জুন থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত দৈনিক পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা ছিল ১৬ থেকে ১৮ হাজারের মধ্যে। গত ৪ জুলাই হঠাৎ করে দৈনিক পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা হ্রাস পেয়ে নেমে আসে ১৪ হাজারে এবং ৫ জুলাই থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত দৈনিক পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ থেকে ১৪ হাজারের মধ্যে।
×