ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বার বার আহ্বান সত্ত্বেও করোনা টেস্টে মানুষের সাড়া মিলছে না

প্রকাশিত: ২২:৪০, ৯ আগস্ট ২০২০

বার বার আহ্বান সত্ত্বেও করোনা টেস্টে মানুষের সাড়া মিলছে না

নিখিল মানখিন ॥ করোনা বিষয়ক দৈনিক অন লাইন ব্রিফিংয়ে প্রতিদিন করোনা টেস্ট করানোর জন্য অনুরোধ জানিয়ে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু অধিদফতরের আহ্বানে সাড়া দিচ্ছে না অধিকাংশ মানুষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদ-ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনুযায়ী দৈনিক ২৪ থেকে ২৫ হাজার নমুনা পরীক্ষা হওয়া দরকার। বর্তমানে বাংলাদেশের দৈনিক নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা ১০ থেকে ১৩ হাজারে ওঠানামা করছে। সীমিত নমুনা পরীক্ষার কারণে দেশে করোনা ভাইরাসের নীরব সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, নমুনা পরীক্ষার জটিলতা কাটছে না। ল্যাবরেটরি সংখ্যা যতই বাড়ছে, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা ততই হ্রাস পেয়ে চলেছে। নমুনা পরীক্ষায় মানুষের আগ্রহ অনেকগুণ হ্রাস পেয়েছে। স্বাস্থ্যবিধি পালন সন্তোষজনক না হওয়ায় সংক্রমণের অনুকূল পরিবেশ পেয়ে বসেছে করোনাভাইরাস। সম্প্রতি স্বাস্থ্য সেক্টরে সৃষ্ট নানা কেলেঙ্কারি ও অসমন্বয়হীনতার কারণেও করোনা নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কার্যক্রমের গতি হ্রাস পেয়েছে। শনিবারও অন লাইন বিফ্রিংয়ে করোনা মহামারীর এই সময়ে জ্বর, কাশিকে সামান্য মনে না করার আহ্বান জানিয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরক্ত মহাপরিচালক ডাঃ নাসিমা সুলতানা বলেন, বিনীতভাবে আবারও অনুরোধ জানাব, যেকোন লক্ষণ, উপসর্গ থাকলে অবশ্য নিকটস্থ নমুনা সংগ্রহ কেন্দ্রে গিয়ে নমুনা দেবেন এবং পরীক্ষা করাবেন। এই করোনাভাইরাসকে মোকাবেলা করার জন্য নমুনা পরীক্ষা করা অনেক বেশি জরুরী। যত বেশি আমরা নমুনা পরীক্ষা করতে পারব, তত বেশি এই রোগ প্রতিরোধ করা সহজ হবে। কাজেই আপনারা এই রোগ গোপন করবেন না। জ্বর, কাশিকে সামান্য মনে করবেন না। জ্বর, কাশি হলেই আপনারা নমুনা পরীক্ষা করতে দেবেন। উপজেলা, জেলাসহ সব জায়গায় নমুনা পরীক্ষা করার ব্যবস্থা আছে। স্বাস্থ্যবিধিগুলো যথাযথভাবে মেনে চলার জন্য বিনীতভাবে অনুরোধ জানান নাসিমা সুলতানা। সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদফতরের সমন্বয় কমিটির সভার কার্যবিবরণীতে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা কমে যাওয়ার সম্ভাব্য কারণগুলো উল্লেখ করা হয়েছে। অধিদফতরের পর্যালোচনায় পরীক্ষার সংখ্যা কমে যাওয়ার আট কারণের প্রথমে আছে পরীক্ষার ফি নির্ধারণ। বাকি কারণগুলো হলো হাসপাতাল ছাড়ার আগে রোগীর শরীরে করোনার অস্তিত্ব জানতে পরপর দুটি পরীক্ষা না করানো; উপসর্গ নেই, এমন রোগীরা কম আগ্রহী হচ্ছেন; সার্বিকভাবে দেশে করোনার প্রকোপ কমে গেছে; জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন হওয়ার আশঙ্কায় অনেকে পরীক্ষা করাচ্ছেন না; জীবিকাসঙ্কটের মুখে পড়েছেন বা পড়তে পারেন, এই আশঙ্কায় অনেকে পরীক্ষা করাচ্ছেন না; রোগী গুরুতর অসুস্থ না হলে স্বাস্থ্য অধিদফতর বাড়িতে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে চিকিৎসা নেয়ার জন্য উৎসাহিত করছে এবং বন্যার কারণে যোগাযোগ ব্যবস্থার অবনতি হওয়ায় কোথাও কোথাও পরীক্ষা কমে গেছে। কার্যবিবরণীতে দিনে ২৪ হাজার পরীক্ষা করার পরামর্শ দেয়া হয়েছিল, এমন কথার উল্লেখ আছে। করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা বলেন, মহামারীর সঠিক পরিস্থিতি জানতে হলে পর্যাপ্ত পরিমাণে রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা হওয়া দরকার। তিনি বলেন, যাদের দরকার, এমন কেউ যেন পরীক্ষা থেকে বাদ না পড়েন, এমন উদ্যোগ এখনই দিতে হবে বলে জানান অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা। সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ভাইরাস বিশেষজ্ঞ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, নমুনা সংগ্রহ করা জানতে হবে, সঠিকভাবে সংগ্রহ করতে হবে। এসব কাজে আরও সজাগ হতে হবে। তিনি বলেন, প্রতিটি ল্যাবরেটরি হতে হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মান অনুযায়ী। তা না হলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়বে, পরীক্ষা নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। সঠিকভাবে করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে বিশেষ করে করোনার নীরব সংক্রমণ থামাতে ব্যাপক হারে নমুনা পরীক্ষার বিকল্প নেই বলে জানান ডাঃ নজরুল ইসলাম। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষার দায়িত্বে ছিল সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) হাতে। কোন কোন দিন মাত্র একটি বা দুটি নমুনা পরীক্ষা করেছে আইইডিসিআর। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) মতো প্রতিষ্ঠানের উচ্চ মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরি থাকার পরও তাদের নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দিতে বিলম্ব করেছে। আরও একাধিক সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একই আচরণ করেছে আইইডিসিআর। কিন্তু আইইডিসিআরের কাছ থেকে পরীক্ষার নিয়ন্ত্রণ স্বাস্থ্য অধিদফতরে যাওয়ার পর সমস্যা দেখা দেয় পরীক্ষার মান নিয়ে। এখন ৮০টি ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। কিন্তু পরীক্ষার ফল নিয়ে নানা অভিযোগের কথা গণমাধ্যমে এসেছে। যেমন বিলম্বে পরীক্ষার ফল পাওয়া, পরীক্ষার ফল জানতে না পারা, এক ব্যক্তিকে একই দিনে পজিটিভ ও নেগেটিভ ফল জানানো, পরীক্ষা করাননি, এমন ব্যক্তিকে রোগী বলে শনাক্ত করা। জেকেজি বা রিজেন্টের পরীক্ষার সনদ জালিয়াতির ঘটনাও প্রকাশ পেয়েছে। ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি বা সক্ষমতা সরেজমিন যাচাই না করেই বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে করোনা পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। সংবাদপত্রে প্রতিবেদন ছাপার পর এমন পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বাতিলও করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও মহামারীর শুরু থেকে পরীক্ষার গুরুত্বের কথা বলে আসছে। সংস্থাটি বলেছে, পরীক্ষা করুন, পরীক্ষা করুন, পরীক্ষা করুন। সন্দেহভাজন প্রতিটি মানুষকে পরীক্ষা করুন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদ-ে বাংলাদেশের জনসংখ্যা অনুযায়ী দৈনিক ২৪ থেকে ২৫ হাজার নমুনা পরীক্ষা হওয়া দরকার। বাংলাদেশ এক দিনের জন্যও ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করতে পারেনি। এ ব্যাপারে কারও জবাবদিহি করতে দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরীক্ষার ফি নির্ধারণে সরকারের যুক্তি ছিল, বিনা মূল্যের সুযোগ নিয়ে প্রয়োজন নেই, এমন অনেকেই পরীক্ষা করাচ্ছেন। যদিও অপ্রয়োজনে কত মানুষ পরীক্ষা করাচ্ছেন, তার হিসাব স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদফতরে ছিল না। বুথে বা হাসপাতালে নমুনা দিলে ২০০ টাকা এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা বাড়িতে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করলে ৫০০ টাকা ফি বাধ্যতামূলক হয় জুলাই মাসের শুরু থেকে। তখন থেকেই দৈনিক পরীক্ষা কমতে দেখা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ফি নির্ধারণের কারণে পরীক্ষা কমেছে। জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষার দায়িত্বে ছিল সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) হাতে। কোন কোন দিন মাত্র একটি বা দুটি নমুনা পরীক্ষা করেছে আইইডিসিআর। আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) মতো প্রতিষ্ঠানের উচ্চ মানসম্পন্ন ল্যাবরেটরি থাকার পরও তাদের নমুনা পরীক্ষার অনুমতি দিতে বিলম্ব করেছে। আরও একাধিক সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একই আচরণ করেছে আইইডিসিআর। কিন্তু আইইডিসিআরের কাছ থেকে পরীক্ষার নিয়ন্ত্রণ স্বাস্থ্য অধিদফতরে যাওয়ার পর সমস্যা দেখা দেয় পরীক্ষার মান নিয়ে। এখন ৮০টি ল্যাবরেটরিতে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে। কিন্তু পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে নানা অভিযোগের কথা গণমাধ্যমে এসেছে। যেমন বিলম্বে পরীক্ষার ফল পাওয়া, পরীক্ষার ফল জানতে না পারা, এক ব্যক্তিকে একই দিনে পজিটিভ ও নেগেটিভ ফল জানানো, পরীক্ষা করাননি, এমন ব্যক্তিকে রোগী বলে শনাক্ত করা। জেকেজি বা রিজেন্টের পরীক্ষার সনদ জালিয়াতির ঘটনাও প্রকাশ পেয়েছে। ল্যাবরেটরির যন্ত্রপাতি বা সক্ষমতা সরেজমিন যাচাই না করেই বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানকে করোনা পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। সংবাদপত্রে প্রতিবেদন ছাপার পর এমন পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন বাতিলও করা হয়। উচ্চ রোগী শনাক্তের হার ॥ দৈনিক নতুন রোগী শনাক্তের দিক দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় স্থানে রয়েছে। আর মোট পরীক্ষিত নমুনার ভিত্তিতে মোট শনাক্তের হার বিবেচনায় বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। তবে এশিয়ায় প্রথম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। মোট পরীক্ষিত নমুনার ভিত্তিতে মোট শনাক্তের হার মেক্সিকোতে ৪৪ শতাংশ, আর্জেন্টিয়ায় ২৮ শতাংশ, ব্রাজিলে ২১ শতাংশ, চিলিতে ২১ শতাংশ, বাংলাদেশে ২০ শতাংশ, কলম্বিয়ায় ১৯ শতাংশ, পেরুতে ১৮ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৭ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৪ শতাংশ, ইরানে ১২ শতাংশ, ভারতে ৯ শতাংশ, যুক্তরাষ্ট্রে ৮ শতাংশ, আরবে ৮ শতাংশ, ফ্রান্সে ৬ শতাংশ, স্পেনে ৫ শতাংশ, তুরস্কে ৫ শতাংশ, সৌদি ইতালিতে ৪ শতাংশ, জার্মানিতে ৩ শতাংশ, রাশিয়ায় ৩ শতাংশ ও যুক্তরাজ্যে ২শতাংশ। নমুনা সংখ্যার অবস্থা ॥ স্বাস্থ্য অধিদফতরের বুলেটিনে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১ জুন থেকে দৈনিক পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা ১১ হাজারে উঠে আসে এবং তা জুন মাসজুড়ে ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। দৈনিক পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা বাড়তে বাড়তে ১৫ জুন ১৪ হাজারে এবং ২০ জুনের মধ্যে ১৫ হাজারে পৌঁছে যায়। এভাবে ২৫ জুন থেকে ৩ জুলাই পর্যন্ত দৈনিক পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা ছিল ১৬ থেকে ১৮ হাজারের মধ্যে। গত ৪ জুলাই হঠাৎ করে দৈনিক পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা হ্রাস পেয়ে নেমে আসে ১৪ হাজারে এবং ৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত দৈনিক পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১০ থেকে ১৩ হাজারের মধ্যে। বাংলাদেশের সর্বশেষ অবস্থা ॥ ৮ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদফতরের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় আরও ৩২ জনের মৃত্যু এবং শনাক্ত হয়েছেন নতুন ২৬১১ জন করোনা রোগী। এ নিয়ে এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৩৩৬৫ এবং আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ২ লাখ ৫৫ হাজার ১১৩ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় সুস্থ হওয়া ১০২০ জনসহ এখন পর্যন্ত সুস্থ হয়েছেন ১ লাখ ৪৬ হাজার ৬০৪ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় ১১ হাজার ৭৩৭টিসহ এ পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ১২ লাখ ৪৯ হাজার ৫০৭টি। ২৪ ঘণ্টায় শনাক্তের হার ২২ দশমিক ২৫ শতাংশ। শনাক্ত বিবেচনায় সুস্থতার হার ৫৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ এবং শনাক্ত বিবেচনায় মৃত্যুর হার এক দশমিক ৩২ শতাংশ।
×