ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মহামারীতে সংবিধান চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনীয়তা

প্রকাশিত: ২১:০৭, ৩১ জুলাই ২০২০

মহামারীতে সংবিধান চর্চার প্রাতিষ্ঠানিক প্রয়োজনীয়তা

সংবিধান একটি রাষ্ট্রের নিয়ামক আইনী দলিল। এর সঙ্গে আমাদের সংবিধানের বাড়তি বৈশিষ্ট্য হলো, এটি মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে নতুন রাষ্ট্রের স্বপ্নের রূপরেখা। এটি সংসদ কর্তৃক প্রণীত কোন সাধারণ আইন নয়, বরং সংসদের সকল আইন সংবিধানের আলোকে প্রণীত হয়। সংবিধানের সঙ্গে জনগণের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। মূলত সংবিধানের আলোকেই রাষ্ট্র তার কার্যক্রম ও জনগণের সঙ্গে আন্তঃসম্পর্ক সৃষ্টি করে। এ কথা নিশ্চিত যে, রাষ্ট্রে রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা ও বিশ^াসবোধ যত দৃঢ় হবে, সংবিধান ততই কার্যকর বৈশিষ্ট্য অর্জন করবে। পৃথিবীর বহু রাষ্ট্রে সংবিধান অবশ্যপাঠ্য হিসেবে বিবেচিত। অস্ট্রেলিয়ায় রাষ্ট্রকে বোঝার জন্য এবং কীভাবে জীবনব্যবস্থা পরিবর্তনের জন্য সংবিধানকে ব্যবহার করতে হয়, তা শেখাতে সংবিধানকে সাধারণ শিক্ষার পাঠ্যক্রমে যুক্ত করা হয়। ভারতে সংবিধানের মৌলিক বিষয়গুলোর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার জন্য সংবিধানের মূল্যবোধগুলো শেখানোর ব্যাপারে স্কুলগুলোতে পাঠ্যক্রম রয়েছে। ইতালীতে শিক্ষা কার্যক্রমের সঙ্গে সংবিধান গভীরভাবে যুক্ত করা হয়। এছাড়াও চীন, ভিয়েতনামসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই শিক্ষাক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সংবিধান চর্চা দেশ ও রাষ্ট্র সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান সম্পর্কে জর্জ ওয়াশিংটন বলেছেন, জনগণই কেবলমাত্র সংবিধানের রক্ষাকবজ। মার্কিন নাগরিকত্ব অর্জনের জন্য সেদেশে সংবিধানের ওপর জ্ঞানের পরীক্ষা দিতে হয়। প্রতিটি দেশে রাষ্ট্রীয় কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে কর্তৃপক্ষের কাছে নিজ রাষ্ট্রের সংবিধান জ্ঞান আছে কিনা তা নিশ্চিত করতে হয়। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমাদের দেশে সেই নজির বিরল। আমাদের শিক্ষিত সমাজের সংবিধান চর্চা খুব বেশি একটা দৃষ্টিতে আসে না। আমি শিক্ষক নিয়োগ দিতে গিয়ে দেখেছি, বিশ^বিদ্যালয় থেকে পিএইচডি নিয়ে আসা অনেক প্রার্থী দেশের সংবিধানের চার মূলনীতির বিষয়ে রীতিমতো অজ্ঞ! রাজনৈতিক অঙ্গনেও একই রকমের চিত্র আমাদের হতাশ করে। ফলে দেশে রাজনৈতিক বিশ^াস ও চেতনাবোধ যেন কাটাঘুড়িতে পরিণত হয়েছে। অথচ বাংলাদেশ নামক এই রাষ্ট্রটির অনন্য অভ্যুদয়ের সঙ্গে এই সংবিধান অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় লাভের পর ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে আমাদের এই সংবিধান কার্যকর হয়। যে চেতনা নিয়ে এই রাষ্ট্রের জন্ম, তার পথচলাকে কল্যাণমুখী করে তোলার ক্ষেত্রে এই সংবিধান-পাঠ ও পরিচর্যার কোন বিকল্প নেই। লক্ষণীয় যে, বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নে সময় লেগেছিল ৯ মাস। ২১টি অধিবেশনে এটি আলোচিত ও গৃহীত হয়। সংবিধান বিষয়ে সাধারণ আলোচনায় সেই সময় বিভিন্ন বিষয়ে সবিস্তার বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু। তাঁর এই গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য শেষ হয়, একটি অতি তাৎপর্যপূর্ণ ইঙ্গিতের মধ্য দিয়ে। সেটি ছিল, ‘(আমাদের) ভবিষ্যত বংশধররা, যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তাহলে আমার জীবন সার্থক হবে, শহীদের রক্তদান সার্থক হবে।’ সংবিধানের বিলের ওপর সাধারণ আলোচনার সময় সংবিধান প্রসঙ্গের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, ‘আমাদের মূলনীতি, মৌলিক অধিকার এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিÑ এভাবে (তিনটি অংশে বিন্যস্ত করে) সংবিধান (প্রণয়ন) করতে হয়েছে।’ দেশের জনগণের মৌলিক অধিকার আইনের দ্বারা সংরক্ষিত বলে তিনি উল্লেখ করেন। কাজেই এই রাষ্ট্রের যে কোন সঙ্কটকালে সংবিধানের পুনঃপাঠ ও সেই আলোকে পুনঃযাত্রার পথ তৈরি করার কোন বিকল্প নেই। বাংলাদেশ এখন একটি মহামারীর গভীর সঙ্কটে নিমজ্জিত। আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে, স্বাস্থ্য ও অর্থনীতি দুটোই প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে। স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি বিশ^ রেকর্ডে পরিণত হয়েছে। আমাদের দেশের করোনা রিপোর্ট বহির্বিশ্বে বিশ^াসযোগ্যতা হারিয়েছে। মহামারীর এই ধাক্কায় দ্রারিদ্র্য হার জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশ অতিক্রম করেছে। দুর্নীতির প্লাবন, অর্থপাচার এখন আর কোন বাঁধ দিয়ে প্রতিরোধ করা যাচ্ছে না। আমাদের সংবিধান যেখানে সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে এক সমতাভিত্তিক সমাজ ও একটা রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেয়, তখন বাস্তবে তার বিপরীত চিত্র আমরা দেখতে পাই। দ্রুত ধনীরা দ্রুততম গতিতে অতিধনীতে পরিণত হচ্ছে। এর নৈতিকতার হিসাব নিতে সংবিধান সচেতনতা অপরিহার্য। আমাদের পাটশিল্প, যা রক্ষার জন্য পূর্ব বাংলার মানুষ দীর্ঘ সংগ্রাম করেছে, যে পাট শিল্পকে কেন্দ্র করে যে সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত, সেই পাটশিল্প বন্ধ করে, প্রায় ৪০ হাজার শ্রমজীবীকে কিছু টাকা হাতে দিয়ে, পেশা পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত কতটা যৌক্তিক ও মানবিকÑ তা বিবেচনা করার দাবি রাখে। লকডাউন ও কাঠোরভাবে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের দোদুল্যমানতা কাজ করছে। পাশাপাশি কাজ করেছে দীর্ঘদিন ধরে স্বাস্থ্যখাতকে চরম অবহেলা। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মস্তিষ্কপ্রসূত একটি অসাধারণ উদ্যোগ কমিউনিটি ক্লিনিক সম্ভাবনার জন্ম দিলেও আর বিকশিত হতে পারেনি। সেটা হলেও হয়তো তৃণমূলে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটা ভিত্তি গড়ে উঠতো। অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলে হতাশার চিত্র আরও স্পষ্ট হয়। যেমন, শ্রীলঙ্কায় স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ জিডিপির ২ দশমিক ৫ শতাংশ, ভিয়েতনাম ২ দশমিক ৫৫, থাইল্যান্ড প্রায় ২ দশমিক ৫ শতাংশ। অথচ আমাদের স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বরাদ্দ শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ, যা ভারতের (০.৮%) চেয়ে কম, এমনকি পাকিস্তানকেও (০.৭%) অতিক্রম করতে পারেনি। এটা কি ন্যায্যতা? দেশের এই স্বাস্থ্য খাতে সঙ্কটময় মুহূর্তেও ব্যয় বরাদ্দ অপ্রতুল থেকে গেছে। এখানে দুটো কারণে শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, নিউজিল্যান্ড, কিউবা এবং ভারতের একটি রাজ্য কেরালার দিকে গভীর মনোযোগের দাবি করব। কারণ দুটির মধ্যে একটি হলো, জনস্বাস্থ্য রক্ষার ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি এবং দ্বিতীয়টি, আর্থিক বরাদ্দ ও সম্পদের যথাযথ ব্যবহার। আমাদের দেশের সাধারণ প্রচলন হচ্ছে, যাদের চিকিৎসা নেয়ার সক্ষমতা নেই, তারা সরকারী হাসপাতালে যান। যার কিছু সক্ষমতা আছে এবং মধ্যবিত্ত, তারা মূলত ভারতের স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা বাণিজ্যের খোরাক। আর যারা বিত্তবান তাদের জন্য এয়ার এ্যাম্বুলেন্স আছে। সিঙ্গাপুর-থাইল্যান্ড অথবা পৃথিবীর যে কোন স্থানেই তারা চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারেন। জনগণ যখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটছেন, এমন কি দেশে বহু বরেণ্য ব্যক্তি ও জনপ্রতিনিধিদেরও মৃত্যুকে বরণ করে নিতে হচ্ছে, এই সময় কিছু মন্ত্রীর সপরিবারে চিকিৎসার জন্য বিদেশযাত্রা দেশকে অবাক করে। এই সময় জনস্বাস্থ্য নিয়ে রাষ্ট্রের যে দৃষ্টিভঙ্গি, তার নাগরিকদের যে অপ্রাপ্তি, সেটিকে দূর করতে হলে এই করোনাকালেই আমাদের সংবিধানটির পুনঃপাঠ জরুরী। আমাদের সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ দুটি অংশের একটি হলো, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি আর অন্যটি হলো, মৌলিক অধিকার। সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগে রয়েছে মূলনীতি আর তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার। আমাদের আলোচ্য পুনর্পাঠে এই দুটি অংশকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা জরুরী। মৌলিক অধিকার ভুক্ত বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে সংবিধানের ২৬ (২) ধারায় স্পষ্ট করা হয়েছে, এই বিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন কোন আইন রাষ্ট্র প্রণয়ন করতে পারবে না এবং করলে তা বাতিল হবে। অর্থাৎ, এই রক্ষাকবচ আমাদের মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন রোধে আইনী ভিত্তি দেয়। অন্যদিকে, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি সম্পর্কে সংবিধানের ৮ (১) ও (২) অনুচ্ছেদ স্পষ্ট করে যে, মূলনীতিতে ভুক্ত বিষয়গুলো রাষ্ট্র ও নাগরিকের কাজের ভিত্তি গঠন করলেও ‘বিচারিকভাবে প্রয়োগযোগ্য’ হবে না। এখন লক্ষণীয় যে, দেশের সংবিধানে স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে মৌলিক অধিকারে যুক্ত না করলেও, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে দুটোই অন্তর্ভুক্ত। সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগ, যেখানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিগুলো উল্লেখ করা আছে, তার ১৮ (১) অনুচ্ছেদে স্পষ্ট বলা হয়েছে, ‘জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন।’ আবার ‘চিকিৎসা’ শব্দটিকে সংবিধানের দ্বিতীয়ভাগেই রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতির ১৫ (ক) অনুচ্ছেদে খাদ্য, পোশাক, আশ্রয় ও শিক্ষার সঙ্গে ‘জীবনধারণের মৌলিক উপকরণ’ হিসেবে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এখন যে সমস্যাটি দাঁড়িয়েছে, সেটি হলো, যেহেতু সংবিধানের তৃতীয় ভাগে অর্থাৎ মৌলিক অধিকারের মধ্যে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা নেই, রয়েছে দ্বিতীয়ভাগে অর্থাৎ মূলনীতির মধ্যে, কাজেই এই দুটো ক্ষেত্রে যথাযথ প্রাপ্যতা থেকে বঞ্চিত হলে সরাসরি আইনের আশ্রয় নেয়ার সুযোগ থাকছে না। কাজেই করোনাকালের এই সঙ্কট এবং ভবিষ্যতে এমন অনাগত আরও সঙ্কট মোকাবেলার প্রশ্নে আমাদের রাষ্ট্রটিকে যথাযথভাবে প্রস্তুত করতে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতকে সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকারে অন্তর্ভুক্ত করা একটি প্রাসঙ্গিক ও জরুরী বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রের মূলনীতিগুলো দেশের সকল জনগণের দৃষ্টিতে নিয়ে আসা জরুরী। এ কারণেই মনে করি, ¯œাতক ডিগ্রী অর্জনের পূর্বেই মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে সকলকে সংবিধানের ওপর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা অর্জন করার ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে নতুন প্রজন্ম বাংলাদেশে স্বাধীনতার দর্শনজাত দৃষ্টিভঙ্গি অর্জন করতে পারে। প্রয়োজনকালে যেন তারা নিজেদের দায়িত্ব ও অধিকার সম্পর্কে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে। আক্ষেপের বিষয় হলো, বহু ডিগ্রিধারীকেও দেখেছি আমাদের রাষ্ট্রের চার মূলনীতি সম্পর্কে কোন ধারণা নেই। প্রধানমন্ত্রীকেই শুধু বলতে শুনেছি, এমনকি সংসদেও তিনি বলেছেন, ‘আমাদের দেশটি হবে জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র।’ যার ব্যাখ্যাও সংবিধানে আছে। সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা নিশ্চিত করার কথা সংবিধানেই উল্লেখ আছে। সংবিধানই জনগণের মৌলিক ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করবে। শুধু পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমাদের কল্যাণমুখী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলে তার আলোকে সংবিধানের পুনঃপাঠ ও পুনঃমূল্যায়নকে গুরুত্ব দিতে হবে। লেখক : রাজনীতিক ও সংসদ সদস্য
×