ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ট্রাম্প নির্বাচনের আগেই খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দিতে চান

প্রকাশিত: ২২:১৪, ২৭ জুলাই ২০২০

ট্রাম্প নির্বাচনের আগেই খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দিতে চান

শংকর কুমার দে ॥ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর খুনী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত রাশেদ চৌধুরীকে অনুষ্ঠিতব্য নবেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই ফিরিয়ে দিতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য দশ মাস আগে গত সেপ্টেম্বরে চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর চিঠির জের ধরেই কূটনৈতিক প্রক্রিয়া জোরদার করার সাফল্যে রাশেদকে ফিরিয়ে দিতে সম্মত হয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন। আগামী ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই এই খুনীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের বিষয়টি পর্যালোচনার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে যুক্তরাষ্ট্রের ‘বোর্ড অব ইমিগ্রেশন আপীল’। চলতি মাসের ৮ জুলাই নতুন এক আদেশে চারটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সব পক্ষকে মতামত দেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের এ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার পরেও যুক্তিযুক্ত কারণ সাপেক্ষে সেটিকে বাতিল করার ক্ষমতা আছে এ্যাটর্নি জেনারেলের। আগামী ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে রাজনৈতিক আশ্রয় চাওয়ার বিষয়টি বাতিলের পক্ষে মতামত আসা সাপেক্ষে অনুষ্ঠিতব্য নবেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগেই খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনা সম্ভবপর হবে বলে আশাবাদী বাংলাদেশ, এটা কূটনৈতিক সূত্রের দাবি। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের এ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার গত ১৭ জুন এক অন্তর্র্বর্তীকালীন আদেশে বোর্ড অব ইমিগ্রেশন আপীলকে রাশেদ চৌধুরী মামলাটি তার কাছে পুনর্বিবেচনার জন্য পাঠাতে বলেছেন। এতদসংক্রান্ত সব কাগজপত্রও চেয়েছেন তিনি। মামলাটি পুনর্বিবেচনার জন্য এর সঙ্গে জড়িত সব পক্ষ এবং অন্যান্য বিজ্ঞ আইনজীবী (এমিটাস কিউরি) এর কাছে মতামত চেয়েছেন এ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার। গত ১৭ জুন আদেশে এজন্য একটি সময়সীমা নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীতে অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে এটি বর্ধিত করেন। গত ৮ জুলাই নতুন এক আদেশে বলা হয় জড়িত পক্ষগুলোকে ১৫ হাজার শব্দের মধ্যে তাদের বক্তব্য জমা দেবে। এটার সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে। আগামী ২৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বিজ্ঞ আইনজীবীদের ৯ হাজার শব্দের মধ্যে মতামত দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন তিনি। এছাড়া জড়িত পক্ষ যদি মনে করে ২৯ সেপ্টেম্বর বাড়তি তথ্য সম্বলিত একটি মতামত জমা দিতে পারবে। তবে ৬ হাজার শব্দসীমার মধ্যে জমা দিতে হবে, যার সময়সীমা নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে আগামী ২৯ সেপ্টেম্বর। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের এ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার রাশেদ চৌধুরীর রাজনৈতিক আশ্রয়ের পুনর্বিবেচনার বিষয়ে যে আদেশ দিয়েছেন তাতে চারটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এতে সব পক্ষকে মতামত দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন তিনি। প্রথমে তিনি সবার কাছে জানতে চেয়েছেন, দীর্ঘ সময় পরে এই মামলাটি পুনর্বিবেচনা করার কারণে বিবাদীর পক্ষে এটি ডিফেন্স করতে অসুবিধা হবে কিনা অথবা অন্য কোনও কারণে এটি পুনর্বিবেচনা করতে অসুবিধা আছে কিনা ? পরবর্তী যে তিনটি বিষয় সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন সেটি হচ্ছে রাশেদ চৌধুরীর পক্ষে যে রায় দেয়া হয়েছিল সেটির যথার্থতা সম্পর্কে। যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী এ্যাটর্নি জেনারেলের ক্ষমতা আছে রাজনৈতিক আশ্রয় পাওয়ার পরেও যুক্তিযুক্ত কারণ সাপেক্ষে সেটিকে বাতিল করতে পারেন। কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানকারী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দেয়ার উদ্যোগ নেয়ার বিষয়টি প্রথম সামনে আনে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক পত্রিকা পলিটিকো। পত্রিকাটির প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে দেয়ার যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগের কথাটি। গত শুক্রবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই উদ্যোগ নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের এ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার। প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ১৫ বছর আগে নিষ্পত্তি হওয়া এই মামলা এখন আবার চালু করে রাশেদ চৌধুরীকে বাংলাদেশের হাতে তুলে দিতে চায় ট্রাম্প প্রশাসন। গত জুন মাসে আলোচিত এই মামলাটি পুনরায় চালু করার সিদ্ধান্ত নেন যুক্তরাষ্ট্রের এ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার। গত ১৭ জুন এ্যাটর্নি জেনারেল বার রাশেদ চৌধুরীর মামলাটি তার কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেন ‘বোর্ড অব ইমিগ্রেশন আপীল’কে। রাশেদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের অনুমতি বাতিল করতে চাইবেন এ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বারই। উইলিয়াম বারই সফল হলে শুরু হবে খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়া। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার যখন ক্ষমতায় আসে তখন বঙ্গবন্ধুর খুনী রাশেদ চৌধুরী ব্রাজিলে রাষ্ট্রদূত। বিপদ আঁচ করতে পেরে ব্রাজিল থেকে পালিয়ে সে যুক্তরাষ্ট্রে যায়। সেখানে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করে। ২০০৪ সালের ৩১ মার্চ সান ফ্রানসিস্কো ইমিগ্রেশন জাজ তার প্রার্থনা মঞ্জুর করার পরে ডিপার্টমেন্ট অব হোমল্যান্ড সিকিউরিটির বিরুদ্ধে আপীল করে। দুই বছর আইনী লড়াইয়ের পরে ২০০৬ সালের ২৯ মার্চ আপীলে রাশেদ চৌধুরীর পক্ষে রায় দেয়া হয়। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আবার ক্ষমতায় আসার পরে রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেন-দরবার শুরু হয়। স্টেট ডিপার্টমেন্টসহ আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে একাধিক বৈঠক হওয়ার পরে দীর্ঘ ১৫ বছর পরে বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের এ্যাটর্নি জেনারেল উইলিয়াম বার, নিয়ম অনুযায়ী তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আইনমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চিঠি ॥ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন দায়িত্বশীর কর্মকর্তা বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত পেতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রায় দশ মাস আগে গত সেপ্টেম্বরে চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনে যুক্তরাষ্ট্র সফরের শেষ দিনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা নিজেই জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনীকে ফেরত চেয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে চিঠি দিয়েছেন বলেও সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মধ্যাহ্নভোজে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কিছু সময় কথোপকথন হয় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের। ওইদিন একই টেবিলে মধ্যাহ্নভোজ সারেন দুই নেতা। এ সময় প্রধানমন্ত্রী একটি ফাইল হস্তান্তর করেন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে। সফরের শেষদিন নিউইয়র্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বিষয়টি খোলাসা করেন প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জাতির পিতার খুনীরা যুক্তরাষ্ট্রেই রয়েছে। তাদের ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমি মূলত এ বিষয়েই তাকে চিঠি দিয়েছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, ২০১৫ সাল থেকে রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত চেয়ে সরকার যুক্তরাষ্ট্রের কাছে নিয়মিত অনুরোধ জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময়েই মার্কিন মুলুকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর পলাতক খুনীকে ফেরত দেয়ার অনুরোধ জানান বিদেশ মন্ত্রী এ কে আবদুল মোমেন। ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিলার পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেনের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের সময়ে তার কাছে মার্কিন বিদেশ মন্ত্রী মাইক পম্পের একটি চিঠিও তুলে দেন। ওই চিঠিতে করোনার সঙ্কটকালেও মার্কিন নাগরিকদের দেশে ফেরানোর ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের বিদেশমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুর খুনী আবদুল মাজেদের ফাঁসির পরেই বঙ্গবন্ধুর বাকি পলাতক খুনীদের দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য নতুন করে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবেই বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনী রাশেদ চৌধুরীকে ফেরত চেয়ে মার্কিন সরকারের কাছে ফের অনুরোধ জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তবে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রাশেদ চৌধুরীকে ফিরিয়ে দিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যে চিঠি দিয়েছেন, সেই চিঠির ধারাবাহিকতায়, কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় আশাবাদী হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ।
×