ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

আবদুল গাফ্্ফার চৌধুরী

অথঃ সারওয়ার্দী সমাচার

প্রকাশিত: ২১:২৬, ২৪ জুলাই ২০২০

অথঃ সারওয়ার্দী সমাচার

বাংলাদেশের সেনাসদর থেকে প্রচারিত একটি বিজ্ঞপ্তি আমার চোখে পড়েছে। বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশিত হয়েছে ২০ জুলাই তারিখে ঢাকার একটি পত্রিকায়। বিজ্ঞপ্তিতে লে. জেনারেল (অব) সারওয়ার্দী নামক এক সাবেক সেনা কর্তাকে অনৈতিক আচরণের জন্য অবাঞ্ছিত ঘোষণা করার কথা জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে সম্প্রতি বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ায় লে. জেনারেল চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী সেনাবাহিনী সম্পর্কে যে মিথ্যাচার করেছেন, তা সেনা কর্তৃপক্ষের নজরে এসেছে। জেনারেল সারওয়ার্দী সেনাবাহিনী সম্পর্কে কি মিথ্যাচার করেছেন আমার তা জানার আগ্রহ হলো। সেনাবাহিনীর বিজ্ঞপ্তিতে যেসব অভিযোগ আছে, তার বেশিরভাগ নারীঘটিত। তিনি সামরিক বাহিনীতে থাকাকালে একাধিক নারীর সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন, বিদেশ ভ্রমণকালেও অনেক মেয়েকে ভ্রমণসঙ্গী করেছেন। তার প্রথম স্ত্রীকে তিনি তালাক দিয়েছেন এবং সেনা আইন বহির্ভূতভাবে সামরিক পোশাক পরে সেনা কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই এক মিডিয়া ব্যক্তিত্বকে বিবাহ করেন। এই মিডিয়া ব্যক্তিত্ব একজন বিতর্কিত মহিলা। সামগ্রিক বিবেচনায় গত ১০ এপ্রিল (২০১৯) তারিখে তাকে সেনানিবাস ও সেনানিবাসের আওতাভুক্ত সকল এলাকায় অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। সেনা অফিসার হিসেবে কোন সুযোগ-সুবিধা তিনি পাবেন না এবং সেনা অফিসার্স ক্লাব, সিএসডি শপ ইত্যাদিতে তার প্রবেশ নিষিদ্ধ। আমাদের সেনাবাহিনীতে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদটি একটি শীর্ষ পদ। দুই প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ দু’জনেই লেফটেন্যান্ট জেনারেল ছিলেন। সুতরাং সেনাবাহিনীর এমন একজন উচ্চ পদের অবসরপ্রাপ্ত সেনা-নায়ককে শুধু নারী কেলেঙ্কারির জন্য এমন শাস্তি দেয়া হয়েছে, তা প্রথমে আমার বিশ্বাস হয়নি। দেশে এবং বিদেশে সামরিক ও রাজনৈতিক উচ্চপদে অধিষ্ঠিত অনেক ব্যক্তির মধ্যেই নারী-প্রীতির আধিক্য দেখা গেছে। বিদেশের উদাহরণ ঘাটব না। আমাদের দেশেও প্রয়াত প্রেসিডেন্ট এরশাদের নারী প্রীতির স্ক্যান্ডাল লন্ডনের অবজার্ভার পত্রিকাতে পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। তিনি এখন প্রয়াত। তাই এসব স্ক্যান্ডাল আলোচনায় টানব না। আমার বলার কথা, এরশাদ সাহেব দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন। কিন্তু তার অবৈধ নারী সংশ্রবের জন্য সামরিক বাহিনী বা দেশের আদালত থেকেও তার কোন শাস্তি হয়নি। তাই আমার সন্দেহ হয়েছে লে. জেনারেল সারওয়ার্দীও কেবল নারী-প্রীতির জন্য নয়, অন্য কোন গুরুতর কারণের জন্য এই শাস্তি পেয়েছেন। সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে তিনি কি মিথ্যাচার করেছেন? এই কৌতূহল থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়া তার বক্তব্যের অনুসন্ধান করি। সোশ্যাল মিডিয়ায় লে. জেনারেল (অব) সারওয়ার্দীর এক ঘণ্টারও বেশি বক্তব্য শুনে বিস্মিত হয়েছি। তার বক্তব্য রাজনৈতিক ও উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচার। এটি বিএনপির রিজভী সাহেবের বক্তব্য হলে আমি বিস্মিত হতাম না। কিন্তু রিজভী সাহেবও এমন মানহানিমূলক, দেশের প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতি সম্পর্কে ধৃষ্টতা ও অবমাননামূলক বক্তব্য রাখবেন বলে আমার মনে হয় না। তার এই বক্তব্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার পর্যায়েও পড়ে। কারণ, তিনি শুধু সরকারের বিরুদ্ধে নয়, গোটা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেই বিষোদ্গার করেছেন। আমি অত্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে তার বক্তব্য শুনেছি। ভেবেছিলাম, তিনি গোটা সরকার ও সেনাবাহিনীকেও দুর্নীতিপরায়ণ বলেছেন, তখন সেই দুর্নীতির দু’একটা জ্বলন্ত উদাহরণ দেবেন। তিনি তা পারেননি। বার বার ঘুরে ফিরে তার কথিত এক দুর্বৃত্তকে পুলিশ সম্মান জানিয়ে তাকে পাহারা দিয়েছে এ কথাটাই বলেছেন। তার সাক্ষী হিসেবে আরেক দুর্ধর্ষ প্রতারক এবং সম্প্রতি গ্রেফতার হওয়া সাহেদ করিমের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। কথায় বলে, চোরে চোরে মাসতুতো ভাই। তিনি কোন রাজনৈতিক নেতা কিংবা বিরোধী দলের নেতার উক্তিও তার বক্তব্যের পাশে টানতে পারেননি। তার অভিযোগটি কি? অভিযোগ এক নামকরা দুর্বৃত্ত সরকারী সম্মান পেয়েছে। তা তো সাহেদ করিমও পেয়েছিল। কারণ, জনসমক্ষে করোনা চিকিৎসা নিয়ে তার বিরাট ক্রাইম তখনও ধরা পড়েনি। ধরা পড়তেই তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বিএনপি আমলের মতো মন্ত্রী বানানো হয়নি। বিএনপি আমলের উপ-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাবরের সঙ্গে লে. জেনারেল সারওয়ার্দীর পরিচয় কিংবা ঘনিষ্ঠতা ছিল কি? বাবর ছিল অর্ধশিক্ষিত এক দুর্বৃত্ত। পুলিশের খাতায় চোরাকারবারি হিসেবে তার নাম ছিল। তার এই রেকর্ড জানা সত্ত্বেও বিএনপি তাকে এনে মন্ত্রী বানিয়েছিল। কারণ, সে ছিল তারেক রহমানের সব অপকর্মের সঙ্গী। এক খুনের আসামিকে বিএনপির মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করা হয়েছিল। খালেদা জিয়ার এই গবর্মেন্ট সম্পর্কে বলা হয়, ‘এ গবর্মেন্ট অব দ্য ক্রিমিনালস, বাই দ্য ক্রিমিনালস এ্যান্ড ফর দ্য ক্রিমিনালস।’ সারওয়ার্দী বলেছেন, আওয়ামী লীগ বড় বড় ক্রিমিনালদের পোষণ করে, কিন্তু ধরা পড়লেই বলে ওরা বিএনপি-জামায়াতের লোক। সারওয়ার্দী সাহেবকে জিজ্ঞাসা করি, কথাটা কি মিথ্যা? যে সাহেদ করিমের জন্য তিনি ওকালতি করছেন, সেই সাহেদ করিমও বিএনপি আমলে প্রবল প্রতিপত্তিশালী ব্যক্তি ছিলেন। তারেক রহমানের হাওয়া ভবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এ কথাটা কি অসত্য যে, এরশাদ ও খালেদা জিয়ার সরকার দেশটাকে দুর্নীতিতে ডুবিয়ে দিয়ে গেছেন? হাসিনা সরকার তাদের তিন দফা শাসনামলেও সেই দুর্নীতির পাহাড় উচ্ছেদ করতে পারেননি। বরং তাদের অনেকে আওয়ামী লীগে ঢুকে পড়েছিলেন। আওয়ামী লীগের ব্যর্থতা এই যে, তারা তাদের সময় মতো ধরতে পারেননি অথবা ধরতে চাননি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত অনেকেই ধরা পড়েছে এবং শাস্তি পেয়েছে। বিএনপির আমল হলে তারা ধরা পড়লে মন্ত্রী হতো। আওয়ামী লীগের মধ্যে বড় বড় দুর্নীতিবাজ আছে এ কথা সত্য। কিন্তু তাই বলে গোটা সরকার, সকল সরকারী কর্মচারী, সামরিক বাহিনী দুর্নীতিবাজ এ কথা বলা রাষ্ট্রের অবমাননা। এ জন্য লে. জেনারেল সারওয়ার্দীকে শুধু সাধারণ শাস্তি দেয়া নয়, বিচার করে কঠোর শাস্তি দেয়া উচিত। তিনি গোটা দেশটাকে দুর্নীতির জন্য অভিযুক্ত করেছেন, কিন্তু গ্রেফতার হওয়া প্রতারক সাহেদ করিমের বক্তব্য ছাড়া একটি জ্বলন্ত প্রমাণও উল্লেখ করতে পারেননি। কারণ, এই দুর্র্নীতিবাজরা বিএনপি-জামায়াতের লোক। তাদের কেউ কেউ ভোল পাল্টে নব্য আওয়ামী লীগার হয়েছেন। শেখ হাসিনা সতর্ক থাকলে সময়মতো তারাও ধরা পড়বেন। সরকারী আমলাদের মধ্যে দুর্নীতি আছে। এটা কোন আমলে ছিল না? বিএনপি আমলে তা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছিল। এখনও তার ধারাবাহিকতা চলছে। সারওয়ার্দী সাহেব দেশে দুর্নীতির কথা বলেছেন, কিন্তু এই দুর্নীতির শুরু কখন থেকে তা বলেননি। দুর্নীতি আগেও ছিল, এখনও আছে। পার্থক্য এই যে, এখন দুর্নীতির রথীমহারথীদের অনেকে ধরা পড়ছেন। বিএনপি আমলে তাদের এমপিকেও ধরা হয়নি, কেউ ধরা পড়ার ভয়ে দেশ ছেড়ে পালায়নি। করোনাভাইরাস সম্পর্কে বলা হয় এই ভাইরাস পৃথিবীতে এসেছে এবং যক্ষ্মা, ক্যান্সারের মতো এই ভাইরাসও টিকে থাকবে। তবে টিকা ইনজেকশন দিয়ে তাকে দমিয়ে রাখতে হবে, যেমন রাখা হয় ফ্লু যক্ষ্মা নিউমোনিয়াকে। দুর্নীতিও একটি ভাইরাস। দুর্নীতির জন্ম আদিকালে। বর্তমানকালেও আছে। তাকে দমিয়ে রাখতে হবে, একেবারে উচ্ছেদ করা যাবে না। কোন গণতান্ত্রিক দেশে, গণতান্ত্রিক সমাজেই দুর্নীতি একেবারে উচ্ছেদ করা যায়নি। দমিয়ে রাখা হয়েছে। সহনীয় করে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে হাসিনা সরকারের পক্ষে দুর্নীতি উচ্ছেদ দূরের কথা, তার বেড়ে ওঠা দমন করা সম্ভব হয়নি। তার কারণ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টি দেশে দুর্নীতির যে পাহাড় গড়ে তুলে গেছে, গণতান্ত্রিক পন্থায় তা উচ্ছেদ করা সহজ নয়। বিশেষ করে বাংলাদেশে তো নয়ই। বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেশপ্রেমের যথেষ্ট অভাব আছে। বিশেষ করে যে দেশে আওয়ামী লীগের কোন গণতান্ত্রিক প্রতিপক্ষ নেই। যে প্রতিপক্ষ আছে তারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বিরোধী, একটি অঘোষিত সাম্প্রদায়িক দল। কোন দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলেই বিএনপির নেতারা চিৎকার করেন, আমাদের নেতা বা কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং হাসিনা সরকার গণতান্ত্রিক নয়। এর সঙ্গে ধুয়া ধরেন তথাকথিত সুশীল সমাজ। অনেক বুঝে সুজে শেখ হাসিনা তৃতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে কিছুটা কর্তৃত্ববাদী হয়েছেন। ফলে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে নিজের দলের লোকদের যেমন ধরা সম্ভব হয়েছে, তেমনই সাহেদ করিমের মতো জঘন্য দুর্নীতিবাজকে ধরা সম্ভব হয়েছে। সাহেদ ধরা পড়ে চিৎকার করছেন, সরকার সামরিক বাহিনী, পুলিশ সকলেই দুর্নীতিবাজ। অর্থাৎ, গোটা রাষ্ট্রই দুর্নীতিবাজ। তার মূখের কথাই তুলে নিয়েছেন লে. জেনারেল (অব) চৌধুরী হাসান সারওয়ার্দী এবং নিজের চরিত্র কি তারও প্রমাণ দিয়েছেন। সাহেদ করিমের তিনি কি যোগ্য বন্ধু? ‘সব শিয়ালের এক রা’। আগেই বলেছি, কোন দেশে দুর্নীতি থাকতেই পারে, তার বাড়বাড়ন্তও চলতে পারে, যেমন চলছে, এখন বাংলাদেশে। তাই বলে কোন প্রমাণ দাখিল না করে প্রধানমন্ত্রী, প্রধান সেনাপতিসহ গোটা রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে দুর্নীতিবাজ বলা বিশ্বের সম্মুখে নিজের দেশের অবমাননা ও তাকে হেয় করার শামিল। এ জন্য দেশদ্রোহিতার দায়ে সারওয়ার্দীর বিচার হওয়া উচিত। আমাদের সেনা কর্তৃপক্ষ তাকে লঘু শাস্তি দিয়েছে। ব্রিটেন, ফ্রান্সে মন্ত্রিসভার এক বা একাধিক সদস্য দুর্নীতি বা কোন অসামাজিক কাজের জন্য পদচ্যুত হয়েছেন। এ জন্য কেউ গোটা সরকারকে, গোটা দেশকে দুর্নীতিবাজ বলেনি। সারওয়ার্দীর অভিযোগ, দেশের সরকারী অফিসার, সামরিক বাহিনী সবাই আওয়ামী লীগপন্থী হয়ে গেছে। লেখাটি দীর্ঘ না করার জন্য লিখছি, বাংলাদেশে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ড. কামাল হোসেন (আজকের কামাল হোসেন নন) বলেছিলেন, ‘৭১-এর পরাজিত শত্রুরা ক্ষমতা দখল করেছে’। এই পরাজিত শত্রুদেরই দোসর বিএনপি ও জামায়াতের শাসন আমলে কার্যত দেশ চলে গিয়েছিল পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থার কবলে, পাকিস্তানপন্থীতে প্রশাসন ভরে গিয়েছিল। সামরিক বাহিনীর অধিকাংশ সেনা অফিসারও ছিলেন পাকিস্তান আমলের ট্রেনিংপ্রাপ্ত এবং পাকিস্তানপন্থী। ফলে জাতির পিতাকে হত্যা, পর পর আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে তাড়ানো সম্ভব হয়েছে। এই ইতিহাসটি কি সারওয়ার্দী সাহেব জানেন? নাকি জেনেও বিএনপি নেতাদের গলায় গলা মিলিয়েছেন? তার আসল চেহারা ও মতলবটি কি? বর্তমানে হাসিনা সরকারের অক্লান্ত চেষ্টায় দেশের অসামরিক ও সামরিক প্রশাসনও স্বাধীনতার শত্রু ও পাকিস্তানপন্থীদের প্রভাবমুক্ত রয়েছে। দেশের তরুণ প্রজন্মের আর্মি অফিসার ও জওয়ানেরা দেশপ্রেমিক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দীক্ষিত হওয়া আর আওয়ামী লীগপন্থী হওয়া এক কথা নয়। কিন্তু বিএনপি প্রচার চালায়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করার অর্থ আওয়ামী লীগপন্থী হওয়া। এটা মিথ্যা ও উদ্দেশ্যমূলক প্রচার। মহাত্মা গান্ধী বলতেন, কংগ্রেসে যোগ দেয়ার অর্থ গান্ধীপন্থী হওয়া নয়। কংগ্রেস আমার অহিংসার আদর্শের অনেক কিছুই মানে না। বাংলাদেশেও জিয়া ও খালেদা সরকার দেশের যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, তাদের সকলকেই আওয়ামী লীগপন্থী আখ্যা দিয়েছেন এবং তাদের ওপর নানা ধরনের নির্যাতন চালিয়েছেন। এসব ইতিহাস কি সারওয়ার্দী সাহেবের জানা নেই? সারওয়ার্দীর সবচাইতে বড় ধৃষ্টতা, তিনি দেখাতে চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাহীন এবং পেছন থেকে আর্মি প্রধান তাকে নির্দেশ দেন। প্রমাণ হিসেবে তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার এক সময় ভাল সম্পর্ক ছিল। সেজন্য তার ওপর সামরিক বাহিনী হয়রানিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন এবং অনুমতিও পেয়েছিলেন। কিন্তু গণভবনে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকার পরেও তিনি দেখা করতে পারেননি এবং বুঝতে পেরেছিলেন, পেছন থেকে কোন নির্দেশ আসায় প্রধানমন্ত্রী তার সঙ্গে দেখা করতে পারেননি। হাস্যকর প্রোপাগান্ডা। প্রধানমন্ত্রী গণভবনে এত বেশি ব্যস্ত থাকেন যে, তার পক্ষে তার অনেক শ্রদ্ধেয় জনকেও সময় মতো সাক্ষাত দিতে পারেন না। প্রয়াত কবির চৌধুরী একবার তিন ঘণ্টা অপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাত পাননি। এরকম আরও অনেকের হয়েছে। সারওয়ার্দী সাহেবের বেলাতেও হয়েছে। সম্ভবত প্রধান সেনাপতির সঙ্গে তার চাকরিগত কোন বিরোধ আছে। (তিনি কি প্রধান সেনাপতি হওয়ার একজন তদবিরকারক ছিলেন?) তাই তার গণভবনে যাওয়ার ঘটনা এবং প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাত না পাওয়ার ঘটনাটিকে জোড়া মিলিয়ে একটি সন্দেহ সৃষ্টির চেষ্টা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতি সম্পর্কে তার ধৃষ্টতামূলক বক্তব্যের জন্যও তার সামরিক আদালতে বিচার হওয়া উচিত। তার আসল পরিচয় কি? এই পরিচয়টা তিনি নিজের অজান্তে হয়তো নিজেই তার বক্তব্যে দিয়েছেন। বলেছেন, ‘আন্দোলন-মিছিল আমরাও করেছি। ৬৯-৭০ সালে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আন্দোলনে যোগ দিয়েছি। পাঠক, লক্ষ্য করবেন, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে প্রধান নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তার কথার উল্লেখ সারওয়ার্র্দী সাহেবের বক্তব্যের কোথাও নেই। বুঝতে অসুবিধা হয় না, তিনি তখন চীনপন্থী (আজকের চীন নয়) রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তখনকার চীনপন্থীরাই ভাসানী গ্রুপে যোগ দিয়েছিলেন। ভাসানীর মৃত্যুর পর তাদের অধিকাংশ জিয়াপন্থী হন। সারওয়ার্র্দীও সম্ভবত স্বাভাবিকভাবেই জিয়াপন্থী হয়েছিলেন। তার এই আসল পরিচয়টা সামরিক বাহিনীতে থাকার সময় হয়তো চেপে রেখেছিলেন। এখন ব্যাঙাচির ব্যাঙ হওয়ার মতো তার ব্যাঙ হওয়ার পরিচয় তার নিজের মুখ থেকেই বেরিয়ে এসেছে হয়তো তার অজান্তে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দেয়া তার বক্তব্য এবং বিএনপির প্রোপাগান্ডার মধ্যে তাই পার্থক্য খুব কম। আমার সহৃদয় পাঠকেরা একটু অপেক্ষা করুন, দেখবেন লে. জেনারেল সারওয়ার্দীও শেষ পর্যন্ত বিএনপির রাজনীতিতেই গিয়ে জড়িত হবেন। আওয়ামী লীগে দুর্নীতি আছে। বড় বড় দুর্নীতিবাজও আছে। সে জন্যই আওয়ামী লীগের এত দুর্নাম। কিন্তু আওয়ামী লীগে এই দুর্নীতিবাজদের ধরার ব্যবস্থা আছে। ধীরে হলেও অনেক ছোট বড় দুর্নীতিবাজ ধরা পড়ছে। কিন্তু বিএনপির আগাপাছতলাই দুর্নীতিতে ভরা এবং তাদের নেত্রী, উপনেতাসহ অনেকেই দুর্নীতির রাঘববোয়াল এবং আদালতের বিচারে দ-িত। এছাড়া আওয়ামী লীগই দেশে একমাত্র পার্টি, যারা এখন মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পতাকা বহন করছেন, জাতির পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়নের চেষ্টা কিছুটা হলেও করছেন। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কোন বিকল্প নেই। বিকল্প স্বাধীনতার শত্রু ও আধা তালেবানদের শাসন। আমার বলতে দ্বিধা নেই, শেখ হাসিনা এখনও শাসন ক্ষমতায় আছেন বলেই দেশটা আফগানিস্তানের মতো তালেবান খপ্পরে পড়েনি। ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়নি। আমার সন্দেহ নেই, সারওয়ার্দী এবং তাদের মতো লোকেরা ফিফথ্্ কলামিস্ট বা পঞ্চম বাহিনীর লোক। এদের দমন করা হলে গণতন্ত্র বা বাকস্বাধীনতা খর্ব করা হবে না। বরং গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার ভবিষ্যত বিপদ থেকে রক্ষা পাবে। [লন্ডন, ২৩ জুলাই, বৃহস্পতিবার, ২০২০]
×