
ছবি: জনকণ্ঠ
বর্ষাকালে যেখানে নদী, খাল ও পুকুরগুলো প্রাণ ফিরে পায়, সেখানে বরগুনার চিত্র ভিন্ন। এখানকার খাকদোন নদী, আশপাশের খাল ও পুকুরগুলো বর্ষাকালেও ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। ময়লা-আবর্জনা আর দূষণে প্রাকৃতিক জলাধারগুলো এতটাই ভরে গেছে যে, একসময়ের প্রাণবন্ত এই জলরাশি এখন জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। বরগুনার প্রায় সব পুকুরই খাল ও নদীর সাথে সংযুক্ত হওয়ায় দূষণের মাত্রা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
খাকদোন নদী দূষণের প্রতীক
একসময় বরগুনা শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া খাকদোন নদী ছিল প্রাণের প্রতীক। মানুষ ওজু-গোসল করত, জামাকাপড় ধৌত করত, রান্নার কাজে ব্যবহার করত, এমনকি মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। কিন্তু এখনকার বাস্তবতা ভয়াবহ। বর্তমানে এটি পরিণত হয়েছে ময়লার ভাগাড়ে। গৃহস্থালির আবর্জনা, দোকান ও হোটেলের বর্জ্য, প্লাস্টিক, মৃত প্রাণী এমনকি পয়ঃবর্জ্য—সবই ফেলা হচ্ছে এই নদীতে।
বর্ষায় নদীর পানি বাড়লেও ময়লার স্তর ভেসে ওঠে। দুর্গন্ধে নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকাও কঠিন। স্থানীয়দের ভাষায়, "বর্ষায় আগের মতো নদীর পানিতে গোসল তো দূরের কথা, এখন হাত ডুবানোর সাহসও নেই।"
পুকুর আর খালের পরিণতিও এক
শুধু নদী নয়, বরগুনা শহরের আশপাশের ছোট ছোট খাল ও পুকুরগুলোর অবস্থা আরও শোচনীয়। অধিকাংশ পুকুরের চারপাশে আবাসিক ভবন গড়ে ওঠায় সেখানে নিয়মিত ফেলা হয় রান্নার বর্জ্য, প্লাস্টিক, হাসপাতালের বর্জ্য, এমনকি টয়লেটের সংযোগও। ফলে সেই পানিতে মাছ চাষ বা ব্যবহারের প্রশ্নই ওঠে না।
বিশেষ করে বাজার এলাকা, পশ্চিম বরগুনা, কলেজ রোড, কালিবাড়ি, চরকলোনী, গৌরিচন্না ও বরগুনা শহর সংলগ্ন এলাকার খাল ও পুকুরগুলো বর্ষার পানিতে পূর্ণ হলেও তা বিষাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত।
দূষণের কারণে জনস্বাস্থ্যের ক্ষতি
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দূষিত পানি ত্বক রোগ, চোখের সংক্রমণ, পেটের পীড়া, ডায়রিয়া, টাইফয়েডসহ নানা পানিবাহিত রোগের উৎস হয়ে উঠেছে। বরগুনা সদর হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, বর্ষা মৌসুমে এসব রোগের হার কয়েক গুণ বেড়ে যায়।
একজন স্থানীয় চিকিৎসক বলেন, "এমন দূষিত পানির সংস্পর্শে আসা মানে নিজেকে ঝুঁকির মুখে ফেলা। বিশেষ করে শিশু ও বৃদ্ধদের ক্ষেত্রে এটি আরও ভয়াবহ।"
কেন এমন অবস্থা?
এই ভয়াবহ দূষণের পেছনে কিছু মূল কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে:
-
পৌর এলাকার ড্রেন ও স্লুইস গেটগুলোর রক্ষণাবেক্ষণের অভাব।
-
নির্দিষ্ট আবর্জনা নিষ্পত্তির জায়গা না থাকায় বর্জ্য সরাসরি পানির ধারেই ফেলা হয়।
-
নদী-খাল দখল করে অবৈধ নির্মাণ ও মাটি ভরাট।
-
মানুষের অসচেতনতা ও দায়িত্বহীন আচরণ।
-
তদারকির অভাবে আইনের প্রয়োগ নেই।
সমাধানের সম্ভাব্য পথ
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি:
-
নিয়মিত জলাশয় পরিষ্কার ও ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার।
-
প্রতিটি ওয়ার্ডে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন।
-
জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও স্কুল পর্যায়ে পরিবেশ শিক্ষা।
-
নদী ও খাল রক্ষায় কঠোর আইন প্রয়োগ নিশ্চিত করা।
-
স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও স্থানীয় জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করা।
বরগুনার খাকদোন নদী, খাল ও পুকুরগুলো শুধু পানি নয়, জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বর্ষাকালের স্বাভাবিক পানিও যদি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়ে, তবে তা আমাদের পরিবেশগত বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেয়। এখনই সময় সতর্ক হওয়ার, অন্যথায় ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শুধু নদী-খালের নামই শিখবে, ব্যবহার করতে পারবে না।
সাব্বির