ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

চলে গেলেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর

প্রকাশিত: ২২:১০, ৭ জুলাই ২০২০

চলে গেলেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর

স্টাফ রিপোর্টার, রাজশাহী ॥ জীবনমৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে অবশেষে না ফেরার দেশে চলে গেলেন দেশের জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে তিনি রাজশাহী নগরীর বোনের বাসায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৬৫ বছর। পরিবার সূত্র জানায়, গত দুদিন ধরে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল। রবিবার বিকেলে তার অবস্থার আরও অবনতি হয়। এরপর রাজশাহীর মহিষবাথান এলাকায় বোন ডাঃ শিখা বিশ্বাসের বাড়িতে অবস্থিত হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে অচেতন অবস্থায় ছিলেন। রাজশাহীতে বোন ডাঃ শিখা বিশ্বাসের ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন ছিলেন এন্ড্রু কিশোর। তার সার্বক্ষণিক দেখাশোনা করছিলেন ভগ্নিপতি প্যাট্রিক বিশ্বাস। তিনিই বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সন্ধ্যায় ৬৫ বছর বয়সী এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুর খবরে সর্বত্র শোকের ছায়া নেমে আসে। সংবাদ কর্মীরা ছাড়া এলাকার লোকজন তার বাড়ির সামনে ভিড় করে। দেশের প্লেব্যাক সম্রাট কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর প্র্রায় ১০ মাস ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে সোমবার ৬ জুলাই সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি আটবার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী। শুধু রাজশাহী নয় তার মৃত্যুতে সারাদেশের সঙ্গীতপ্রেমীদের মনে নেমে এসেছে বিষাদের ছায়া। মৃত্যুর খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। রাজশাহীর মহিষবাথানে বোন শিখা বিশ্বাসের বাড়িতে গত ২০ জুলাই থেকে ছিলেন তিনি। এই বাড়িতেই কাটল তার জীবনের শেষ দিনগুলো। এ খবর জানতেন এলাকাবাসী। তাই প্রিয় শিল্পীকে কাছ থেকে এক পলক দেখতে সবাই ভিড় করছেন এন্ড্রু কিশোরের বোন শিখা বিশ্বাসের বাড়ির সামনে। ওস্তাদ আব্দুল আজিজ বাচ্চুর কাছে গান শিখতেন এন্ড্রু কিশোর। পরে ২০১২ সালে ওস্তাদের নামে একটি স্মৃতি সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন এই কিংবদন্তি সঙ্গীত শিল্পী। এই সংগঠনের সভাপতি ছিলেন এন্ড্রু কিশোর। প্রিয় শিল্পীকে দেখতে এসেছেন এই সংগঠনের অন্য সদস্যরাও। এসেছেন শিল্পীর ছোটবেলার বন্ধুরা। ভিড় করছেন সাধারণ মানুষও। তবে করোনা পরিস্থিতি বিবেচনা করে সবাইকে সতর্ক থাকতে অনুরোধ করা হচ্ছে শিল্পীর পরিবারের পক্ষ থেকে। এন্ড্রু কিশোরের বোনজামাই ডাঃ প্যাট্টিক বিপুল বিশ্বাস জানিয়েছেন, বর্তমানে শিল্পীর মরদেহ রাজশাহীর একটি হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে। আজ মঙ্গলবার সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে তাকে তার মায়ের পাশে সমাহিত করা হবে। মৃত্যুর আগে এন্ড্রু কিশোর নিজেই বলে গেছেন তাকে যেন মায়ের পাশেই সমাহিত করা হয়। সেই ইচ্ছায়ই মায়ের পাশেই তাকে সমাহিত করার প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। তবে কখন এটা এখনও ঠিক করা হয়নি। ৯ মাস পর সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন এন্ড্রু কিশোর ১১ জুন রাত আড়াইটার একটি বিশেষ ফ্লাইটে দেশে ফেরেন। তারপর ঢাকার বাসায় বেশকিছু দিন অবস্থান করে শরীরের অবস্থা বিবেচনায় ও কোলাহলমুক্ত থাকতে তিনি রাজশাহী চলে আসেন। গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে ক্যান্সারে (নন-হজকিন লিম্ফোমা) আক্রান্ত হয়ে ৯ মাস সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাধীন ছিলেন এন্ড্রু কিশোর। সোমবার সন্ধ্যা ৬টা ৫৫ মিনিটে বোনের বাসাতেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন এই গুণী শিল্পী। ব্লাড ক্যান্সার নিয়ে গত বছরের অক্টোবর থেকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর। হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পাওয়ার পর ১১ জুন রাতে বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় আসেন তিনি। পরের দিন তিনি ঢাকা থেকে রাজশাহী চলে আসেন। এরপর থেকে তিনি তার বোন ডাঃ শিখার বাড়িতে ছিলেন। ১১ জুন ঢাকায় ফিরে এন্ড্রু কিশোর সাংবাদিকদের বলেছিলেন, আমি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠছি; আগের তুলনায় আমার শারীরিক অবস্থা বেশ ভাল। চিকিৎসকদের পরামর্শে বিশ্রামে ছিলেন তিনি। সপ্তাহ খানেকের বেশি মিরপুরে বাসায় কাটানোর পর তিনি রাজশাহী আসেন। চেকআপের জন্য তিন মাস পর পর তাকে সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে যাওয়ার কথা ছিল। গত বছরের ৯ সেপ্টেস্বর শরীরের নানা জটিলতা নিয়ে সিঙ্গাপুর চিকিৎসা করাতে গিয়েছিলেন তিনি। তবে সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেলেন এই গুনী শিল্পী। এর আগে শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে তার শরীরে ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ার পর থেকেই সিঙ্গাপুর জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। তার সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী লিপিকা এন্ড্রু। ছয়টি ধাপে তাকে মোট ২৪টি কেমোথেরাপি দেয়া হয়েছে। তার শরীরে ক্যান্সার ধরা পড়ার আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে চিকিৎসার জন্য ১০ লাখ টাকার সহায়তা দিয়েছিলেন। পাশাপাশি ‘গো ফান্ড মি’ নামে এক ওয়েবসাইটের মাধ্যমে তহবিল সংগ্রহ করা হয়। সহশিল্পীদের মধ্যেও অনেকে তার পাশে দাঁড়ান। গানের মানুষ এন্ড্রু কিশোরের চিকিৎসায় তহবিল সংগ্রহ করতে সৈয়দ আব্দুল হাদী, সাবিনা ইয়াসমীন, মিতালী মুখার্জিসহ আরও কয়েকজন শিল্পীকে নিয়ে কনসার্টেরও আয়োজন করা হয়। ১৯৭৭ সালে ‘ মেইল ট্রেন’ চলচ্চিত্রের মধ্য দিয়ে প্লেব্যাকে যাত্রা শুরু করেন এন্ড্রু কিশোর। এরপর আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। ‘জীবনের গল্প আছে বাকি অল্প’, ‘হায়রে মানুষ রঙিন ফানুস’, ‘ডাক দিয়াছেন দয়াল আমারে’, ‘আমার সারা দেহ খেও গো মাটি’, ‘আমার বুকের মধ্যে খানে’সহ অসংখ্য জনপ্রিয় বাংলা গান উপহার দিয়েছেন শ্রোতাদের। এদিকে এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে তাৎক্ষণিক শোক জানিয়েছেন রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, সদর আসনের সাংসদ ফজলে হোসেন বাদশা। এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতির শোক ॥ রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ আটবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার বিজয়ী সঙ্গীত শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে গাভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সোমবার এক শোক বার্তায় রাষ্ট্রপতি প্রয়াতের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান। এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে প্রধানমন্ত্রীর শোক ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশিষ্ট সঙ্গীত শিল্পী এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন। সোমবার এক শোক বার্তায় প্রধানমন্ত্রী দেশের সঙ্গীতাঙ্গনে এন্ড্রু কিশোরের অবদানকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ‘এন্ড্রু কিশোর চলচ্চিত্রে অনেক জনপ্রিয় গান গেয়েছেন এবং সে জন্য তিনি দেশের সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে চিরদিন বেঁচে থাকবেন।’ প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘তার (এন্ড্রু কিশোর) মৃত্যু দেশের সঙ্গীতাঙ্গনের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি।’ শেখ হাসিনা প্রয়াতর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানান। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম জানান, এর আগে প্রধানমন্ত্রী নিজেই এন্ড্রু কিশোরের চিকিৎসার দায়িত্বভার গ্রহণ করে শিল্পীকে আর্থিক সহযোগিতাও প্রদান করেন। এছাড়াও এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, জাপা চেয়ারম্যান জিএম কাদের এবং কেন্দ্রীয় খেলাঘরের সভাপতিম-লীর চেয়ারম্যান অধ্যাপিকা পান্না কায়সার গভীর শোক প্রকাশ করেছেন।
×