ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

বেনাপোল বন্দর দিয়ে রেল কার্গোতে পণ্য আমদানির অনুমতি

প্রকাশিত: ২২:১১, ৭ জুন ২০২০

বেনাপোল বন্দর দিয়ে রেল কার্গোতে পণ্য আমদানির অনুমতি

আবুল হোসেন, বেনাপোল থেকে ॥ বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে রেল কার্গোতে পণ্য আমদানির অনুমতি দিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। দেশের সবচেয়ে বড় স্থলবন্দর বেনােেপাল দিয়ে একটানা প্রায় আড়াই মাস যাবত ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বন্ধ রয়েছে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও বাণিজ্য সচল করা সম্ভব হয়নি। কারণ হিসেবে পেট্রাপোলে রফতানিমুখী ট্রাক থেকে চাঁদাবাজি এবং বাংলাদেশ থেকে প্রচুর করোনা রোগী ভারতে প্রবেশ করবে বলে উল্লেখ করা হয়। ফলে আড়াই মাসে বেনাপোল বন্দর থেকে সরকারের কমপক্ষে ৬শ’ কোটি টাকার রাজস্ব হাতছাড়া হয়ে গেছে। অন্যদিকে আমদানি-রফতানি শুরু না হওয়ায় ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় প্রায় ৫ হাজার পণ্যবাহী ট্রাক আটকা পড়েছে ওপারের বন্দরে। আটকা পড়া এসব ট্রাকে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালামালসহ নানা ধরনের পণ্য রয়েছে। জানা গেছে, বিশ্বব্যাপী নোভেল করোনাভাইরাসের কারণে গত ২৩ মার্চ থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে দু’দেশের মধ্যে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। পরে বাণিজ্য সচলের জন্য দু’দেশের উর্ধতন মহল একাধিকবার নির্দেশনা দিয়েও চালু করতে পারেনি এ বন্দরের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম। কলকাতা থেকে বেনাপোল বন্দর অতি নিকটবর্তী হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এ পথে আমদানিতে বেশি আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে। বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস মহামারী আকার ধারণ করার পর উভয় দেশের সরকার বেনাপোলসহ দেশের ২৩টি স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি-রফতানি বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। পরে দেশের শিল্প কারখানার কাঁচামাল এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের জোগান ঠিক রাখার জন্য গত ৩০ মার্চ জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এক বিবৃতিতে দেশের সকল স্থলবন্দর সীমিত আকারে খোলার নির্দেশ দেয়। এর প্রেক্ষিতে দু’দেশের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিরা একাধিকবার বৈঠকের পর ২৯ এপ্রিল স্বাস্থ্যবিধি মেনে নোম্যান্সল্যান্ডে পণ্য খালাসের সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্বাস্থ্যবিধি মেনে নোম্যান্সল্যান্ডে ৩০ ট্রাক অত্যাবশ্যকীয় পণ্য খালাসও হয়। এভাবে পণ্য খালাসের তৃতীয় দিনে পেট্রাপোল বন্দরের ট্রাক শ্রমিক ও স্থানীয় গ্রামবাসী অভিযোগ তোলে এভাবে পণ্য খালাস হলে করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকবে এলাকায়। পরে সড়কে বিক্ষোভ করে পণ্য প্রবেশ বন্ধ করে দেয় তারা। এ বিষয়ে স্থানীয় ছয়ঘড়িয়া পঞ্চায়েতের প্রধান প্রসেনজিত ঘোষ রফতানি বন্ধের পক্ষে মত দেন। আবারও বন্ধ হয়ে যায় আমদানি-রফতানি। ব্যবসায়ীদের একাধিক সূত্র জানায়, এ পথে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারতের পেট্রাপোলের একটি ক্ষমতাসীন সিন্ডিকেট রফতানিমুখী ট্রাক জিম্মি করে ব্যাপকহারে চাঁদাবাজি করে। ফলে আমদানিকারকদের পরিবহন খরচ বেড়ে যায় বলে অভিযোগ করেন আমদানি-রফতানি সংশ্লিষ্টরা। ভারতের পেট্রাপোলের অদূরে নিজেদের তৈরি কালিতলা নামক পার্কিংয়ে জোর পূর্বক রফতানিমুখী ট্রাক আটকে রাখে এ চক্রটি। এরপর দৈনিক হিসেবে প্রতি ট্রাক থেকে চাঁদা আদায় করে তারা। পরে এখান থেকে তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী ট্রাকগুলোকে পাঠানো হয় সেন্ট্রাল পার্কিংয়ে। বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের উদাসিনতার জন্য এই সিন্ডিকেটটি দিনে দিনে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে। গত ৩০ এপ্রিল ও ২ মে বাংলাদেশে রফতানি করা ১৫ গাড়ি পচনশীল পণ্য খালাসের অর্থের ভাগ তৃণমূল ও পার্কিং নিন্ডিকেটের সবাই পায়নি বলে এই অচলাবস্থা সৃষ্টি করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। অচলাবস্থা দীর্ঘস্থায়ী করতে বাংলাদেশের বেনাপোল অংশে শত শত করোনা রোগী আছে বলে গুজব ছড়িয়ে সেখানকার লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়েছে চক্রটি। ওপাশের পার্কিং সিন্ডিকেটের সৃষ্ট এ অচলাবস্থার কারণে প্রায় ৫ হাজার পণ্যবাহী ট্রাক বাংলাদেশে ঢোকার অপেক্ষায় বিভিন্ন পার্কিংয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আটকা পড়া এসব ট্রাকে ওষুধ ও শিল্প কারখানার কাঁচামাল, অক্সিজেন, প্রিন্টিং-প্যাকেজিংয়ের কাঁচামাল, ধান, পাট, ভুট্টাবীজ, শিশুখাদ্য, আদা, পেঁয়াজ, রসুন, মসলা, ফলমূল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য রয়েছে। দীর্ঘদিন আটকে থাকার কারণে এসব পণ্যের গুণগত মান নষ্ট হচ্ছে। যার ফলে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে আমদানিকারকরা। বেনাপোল কাস্টমস হাউসের একটি দায়িত্বশীল সূত্র থেকে বলা হয়েছে দেশের বৃহত্তম এ স্থলবন্দর বন্ধ থাকার কারণে সরকারের কমপক্ষে ৬শ’ কোটি টাকার রাজস্ব হাতছাড়া হয়ে গেছে। সূত্র বলেছে, প্রতি মাসে এ বন্দর দিয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ৪শ’ ট্রাক পণ্য আমদানি হয়। আমদানিকৃত এসব পণ্য থেকে সরকার প্রতিদিন কমপক্ষে ৯ কোটিরও অধিক টাকা রাজস্ব আহরণ করে থাকে। সে হিসেবে বিগত প্রায় আড়াই মাস এই বন্দর দিয়ে বাণিজ্য বন্ধ থাকার কারণে সরকার প্রায় ৬শ’ কোটি টাকা রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয়েছে। জানা গেছে, দেশের সবচেয়ে বড় এই স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি বাণিজ্য সচল রাখতে গত ১৩ মে রেল কার্গো চালুর জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি আবদেন করা হয়। এ আবেদনের প্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার (৪ জুন) জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) রেল কার্গো হ্যান্ডেলিংয়ের অনুমতি দিয়েছে। এখন থেকে শর্ত সাপেক্ষে সাইডডোর (পাশ দরজা বিশিষ্ট) রেল কার্গোতে করে সব ধরনের পণ্য আমদানি করা যাবে এ পথে। প্রায় ৪ দশক পরে এ বন্দর দিয়ে রেল কার্গোতে করে ভারতীয় পণ্য আমদানির সুযোগ পাবে আমদানিকারকরা। এছাড়াও ট্রাক চাঁদাবাজদের দৌরাত্ম্যে ভাটা পড়বে। ফলে স্বল্প সময়ে এবং অপেক্ষাকৃত কম পরিবহন খরচে ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য আসবে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা। কাস্টমস কর্তৃপক্ষ মনে করছে শুল্ক ফাঁকি এবং অপঘোষণা রোধ হবে রেল কার্গো হ্যান্ডেলিংয়ের মাধ্যমে। গত ৪ মে কোভিড-১৯ সংক্রমণকালীন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য রেলপথে পরিবহনের বিষয়ে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনের উদ্যোগে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, রেলপথ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ রেলওয়ে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও এনবিআরের সঙ্গে একটি ভিডিও সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে ভারতের পক্ষ থেকে রেলপথে সকল ধরনের পণ্য আমদানিতে সহায়তার অনুরোধ করা হয়। বিষয়টি পরীক্ষা করে মতামত প্রদানের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিকে আহ্বায়ক করে টেকনিক্যাল কমিটি গঠন করা হয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতর প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কমিটি কয়েকটি সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিল করে। সুপারিশের মধ্যে অন্যতম হলো বেনাপোল-পেট্রাপোল রুটে সাইড-ডোর বিশিষ্ট কন্টেইনার ট্রেন চালুর অনুমতি প্রদান। সুপারিশের আলোকে ছয়টি শর্তসাপেক্ষে এ অনুমতি প্রদান করা হয়। শর্তের মধ্যে বলা হয়, বেনাপোল কাস্টম হাউসকে রেলপথে আমদানি করা পণ্যের কাস্টমস প্রক্রিয়া সম্পন্নের একটি আদর্শ পদ্ধতি প্রণয়নপূর্বক এনবিআরকে অবহিত করতে হবে। পণ্য আমদানির পূর্বে বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ, বাংলাদেশ রেলওয়ের মাধ্যমে বন্দর অভ্যন্তরে পণ্যের অবতরণ, সংরক্ষণ ও কায়িক পরীক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকল্পে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণসহ প্রয়োজনীয় পূর্তকাজ সম্পন্ন করতে হবে। আরও রয়েছে সকল পণ্য সহকারী কমিশনার বা উপকমিশনারের উপস্থিতিতে শতভাগ কায়িক পরীক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। ঘোষণার যথার্থতা যাচাই ও যথাযথ শুল্ককর আদায় নিশ্চিতকল্পে আইনানুগ সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। আমদানি নীতি আদেশসহ সকল আইন ও বিধি-বিধান পরিপালন করতে হবে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সাইড ডোর কন্টেইনার ট্রেন চলাচলের বিষয়টি পুনর্পর্যালোচনা করতে হবে। এ লক্ষ্যে রেলপথে আমদানি-রফতানির তথ্য নিয়মিতভাবে এনবিআরকে অবহিত করতে হবে। বেনাপোল-পেট্রাপোলের সকল অংশীজন এনবিআরের আদেশের আলোকে নিজ নিজ পণ্য বা কার্গো আমদানি করতে পারবেন। পূর্বে কেবল বাল্ক কার্গো যেমন পাথর, পাথর চিপস, ধান, চাল রেলে আমদানি হতো। এখন থেকে সব রকমের পণ্য পণ্যবাহী ট্রেনে করে আনা যাবে। তবে করোনাকালীন সময়ের জন্য এ অনুমতি দেয়া হয়েছে। সূত্র মতে, রেল কার্গোর মাধ্যমে পণ্য আমদানিতে সুবিধা অনেক। ট্রেন আগমন থেকে ছেড়ে যাওয়ার লিডটাইম ন্যূনতম এক পঞ্চমাংশ। ৪ ট্রাকের সমান পণ্য আনা যায় একটি ওয়াগনে। রেল কার্গোতে মিথ্যা ঘোষণার সুযোগ কম। রেলের ভাড়া ট্রাকের ভাড়ার তুলনায় অর্ধেকেরও কম। আবশ্যিক পার্কিং, ট্রাকের দীর্ঘসময় অপেক্ষা ও চাঁদা নেই। দিনে ১০০ বগির একটি ট্রেনে ৪০০ ট্রাকের সমান পণ্য আনা যায়। সূত্র আরও জানায়, স্বাধীনতার পর কিছুদিন রেল কার্গো বেনাপোলে চলেছে। এরপর বেনাপোলে রেল কার্গো হ্যান্ডেলিং বন্ধ। উদ্দেশ্য পার্কিং সিন্ডিকেটের বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি। দেশের ৩৫ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্যের অর্ধেকও ট্রেনে হলে আমদানি ব্যয় ও সময় কমে যাবে। সম্প্রতি চাল, পেঁয়াজ ও ফ্লাই এ্যাশের চালান রেল ওয়াগনে আসায় ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি খুলে যায়। এখন দেশের ব্যবসায়ীরা বড় ধরনের চালান রেলে আনতে আগ্রহী এবং ভারতের রফতানিকারকরাও গেঁড়াকল থেকে মুক্তি পাবে। তবে ভোক্তা ও ব্যবসায়ীদের স্বার্থে বেনাপোলে রেল কার্গো খালাসের নীতিমালা দ্রুত জারি করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। রেল কার্গো চালুর অনুমতি দেয়ায় বেনপোলের শিল্প শ্রেণীর ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোসহ সর্বস্তরের ব্যবসায়ী ও অংশীজনরা এনবিআরসহ সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানিয়েছে।
×