ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

খালেদা জিয়া আপাতত রাজনীতিতে নেই

প্রকাশিত: ২১:৩৫, ৬ জুন ২০২০

খালেদা জিয়া আপাতত রাজনীতিতে নেই

শরীফুল ইসলাম ॥ শরীরিক অসুস্থতা ও মামলাজনিত কারণে আপাতত রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন না বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। তবে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যাওয়া যায় কিনা এখন তার পক্ষ হয়ে বিভিন্ন মহল থেকে চেষ্টা চালানো হচ্ছে। আর এ চেষ্টায় সফল হওয়ার জন্যই খালেদা জিয়া এখন রাজনৈতিক কর্মকান্ড থেকে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছেন। সূত্র মতে, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়ে গুলশানের বাসায় অবস্থানের পর থেকেই বিএনপিসহ সমমনা বিভিন্ন রাজনেতিক দলের নেতারা তার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। কিন্তু খালেদা জিয়া তার বাসার নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত লোকদের সাফ জানিয়ে দেন আপাতত তার রাজনীতি নিয়ে কোন আগ্রহ নেই। তাই রাজনৈতিক কোন নেতা তার সঙ্গে দেখা করতে চাইলে যেন তাদের নিরুৎসাহিত করা হয়। দীর্ঘ সোয়া ২ বছর পর ২৫ মার্চ বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়ে সরাসরি গুলশানের বাসা ফিরোজায় অবস্থান নেন। ওই দিন রাতে ঘনিষ্ঠ ক’জন আত্মীয়স্বজন, ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও কয়েকজন বিএনপি নেতা ছাড়া আর কেউ খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ পাননি। পরদিন ২৬ মার্চ থেকে তিনি নিজ বাসার দ্বিতীয় তলায় স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টাইন শুরু করেন। প্রায় দেড়মাস তিনি হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকেন। খালেদা জিয়ার হোম কোয়ারেন্টাইন শেষ হলে ১১ মে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং ১২ মে বিএনপি চেয়ারপার্সনের বিশেষ সহকারী শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস গুলশানের বাসায় গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। এর পর ২৫ মে ঈদের দিন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যরা তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। এর একদিন পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। এর পর দেখা করেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু। আর তারা দেখা করার পর থেকেই আলোচনা শুরু হয় খালেদা জিয়া কি রাজনীতিতে সক্রিয় হচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির কোন কোন নেতা তাদের বক্তব্যে বলেন, খালেদা জিয়ার রাজনীতি করতে কোন বাধা নেই। তবে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আপাতত খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়ার এখনই রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার বিষয়টি দলের মহাসচিব হিসেবে আমি জানি না। তিনি বলেন, আমাদের সঙ্গে ঈদের দিন তাঁর দেখা হয়েছে, সেখানে স্ট্যান্ডিং কমিটির মেম্বাররা ছাড়া আর কেউ ছিলেন না। উনি এখন কারাগারের বাইরে আছেন এ কারণে যদি স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাত না দেন তাহলে কমিটির সদস্যরা মনে কষ্ট পাচ্ছিলেন। তবে এখানে আলোচনা হয়েছে তার শারীরিক অবস্থা নিয়ে, কোন রাজনৈতিক আলোচনায় হয়নি। এ ছাড়া রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার বিষয়ে খালেদা জিয়া কারও সঙ্গে কথা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। সূত্র মতে, স্থায়ী কমিটির সদস্যরা দেখা করতে গেলে ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিসহ সার্বিক পরিস্থিতি নিয়েই কথা বলেন। তবে রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ার বিষয়ে তিনি কিছু বলেননি। আর এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বিএনপি মহাসচিব ফখরুল বলেন, খালেদা জিয়া এখনও গুরুতর অসুস্থ। তাঁর শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হলেও মানসিক অবস্থার উন্নতি হয়েছে। আমরা দেখা করে আসার পর তাঁর সঙ্গে দেখা করেছেন দুই-তিনজন। এর মধ্যে রয়েছেন শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস যিনি তাঁর বিশেষ সহকারী ছিলেন। তাঁর বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমা শিমুল বিশ্বাস দেখেন। এ কারণেই তিনি দেখা করেছেন। এছাড়া নাগরিক ঐক্যের মাহমুদুর রহমান মান্না দেখা করেছেন তার ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে। তিনি বগুড়ার খালেদা জিয়ার আসন থেকে নির্বাচন করেছিলেন, তাই তিনি খালেদা জিয়ার সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে দেখা করেছেন, কোন রাজনৈতিক আলোচনা করেননি। আর বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আওয়াল মিন্টুও ব্যক্তিগত কারণে দেখা করেছেন। এর বাইরে আর কোন রাজনৈতিক নেতা খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করেছেন কিনা বা রাজনৈতিক কোন বিষয়ে আলোচনা করেছেন কিনা তা আমি জানি না। সোয়া দুই বছর কারাবন্দী জীবন কাটানোর পর একান্তে গুলশানের বাসায় ৭০ দিন সময় পার করলেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ৭৫ বছর বয়সে এভাবে নিরিবিলি পরিবেশে একান্তে এত সময় কাটানো তাঁর জীবনের একটি বিরল ঘটনা। এ সময় অসুস্থ খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার তেমন উন্নতি না হলেও নিয়মিত প্রিয় স্বজনদের সঙ্গে কথা বলতে পেরে তিনি এখন স্বস্তিতে আছেন বলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেখা করে এসে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে দলের নেতারা জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, অসুস্থ খালেদা জিয়ার জন্য গঠিত চিকিৎসা বোর্ডের পরামর্শে বাসায় তাঁর সঙ্গে থাকা নার্সের মাধ্যমে নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন। এ ছাড়া আপাতত প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাসায়ই করা হয়। তার ডায়াবেটিস এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আছে। শারীরিক অন্য সমস্যাগুলোও স্থিতিশীল রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে রিউমেটিক আর্থ্রারাইটিস ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছেন তিনি। তবে এসব রোগে ভুগলেও মানসিকভাবে স্বস্তিতে থাকায় তিনি আগের চেয়ে ভাল আছেন। কারাগার থেকে বাসায় ফেরার পর প্রতিদনই লন্ডনপ্রবাসী ছেলে তারেক রহমান, ছেলের বউ ডাঃ জোবায়দা রহমান, তারেক রহমানের মেয়ে জায়মা রহমান, প্রয়াত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান, তার দুই মেয়ে জাসিয়া রহমান ও জাহিয়া রহমানের সঙ্গে ফোনসহ বিভিন্ন মাধ্যমে কথা বলছেন। এ সময় পরিবারের সদস্যরা খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিচ্ছেন। সূত্র জানায়, তারেক রহমানের স্ত্রী ডাঃ জোবায়দা রহমান খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্য পরীক্ষার রিপোর্ট নিয়ে লন্ডনের চিকিৎসকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় পরামর্শ নিচ্ছেন। করোনা পরিস্থিতির পর সরকারের অনুমতি পেলে লন্ডনে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার বিষয়েও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হচ্ছে। তবে তার আগে বিমান চলাচল শুরু হলে লন্ড থেকে আরাফাত রহমান কোকেস্ত্রী শর্মিলা রহমান খালেদা জিয়াকে দেখতে দেশে আসবেন। এদিকে খালেদা জিয়া যাতে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যেতে পারেন সে জন্য তার পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা হচ্ছে। স্বজনদের আবেদনের প্রেক্ষিতে করোনা পরিস্থিতিতে বয়স ও মানবিক বিবেচনায় সরকারের নির্বাহী আদেশে ২৫ মার্চ ৬ মাসের জন্য মুক্তি পান বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালিয় হাসপাতালের প্রিজন সেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি সরাসরি গুলশানের বাড়ি ফিরোজায় ওঠেন। খালেদা জিয়ার মুক্তির শর্ত হচ্ছে- তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না এবং বাসায় থেকেই চিকিৎসা নিতে হবে। উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা নিয়ে কারাগারে যান বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। কারাবন্দী হওয়ার পর থেকেই অসুস্থ খালেদা জিয়ার সুচিকিৎসা ও মুক্তির দাবি জানাতে থাকে বিএনপি। এক পর্যায়ে বিশেষায়িত হাসপাতালে চিকিৎসার জন্যও দাবি করে দলটি। গত বছর ১ এপ্রিল পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোডের কারাগার থেকে খালেদা জিয়াকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলের কেবিনে নেয়া হয়। সেখানে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করে চিকিৎসা দেয়া হয়। কিন্তু তারপরও খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থার উন্নতি না হওয়ায় পরিবারের সদস্যদের পক্ষ থেকে তাকে মুক্তির দাবি জানানো হয়। ৮ মার্চ দেশে হানা দেয় করোনাভাইরাস। পরে তা ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে বয়স ও মানবিক বিবেচনায় মুক্তি দিতে সরকারের কাছে আবেদন করে খালেদা জিয়ার স্বজনরা। এর পর খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার, বোন সেলিমা ইসলাম ও তার স্বামী রফিকুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন। এর পর ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেল থেকে মুক্তি দেয়া হয় খালেদা জিয়াকে। এর পর থেকে তিনি গুলশানের বাসায়ই আছেন। এক মিনিটের জন্যও তিনি বাসা থেকে বের হননি।
×