ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

লিবিয়ায় ২৬ হত্যার মূল হোতা ড্রোন হামলায় নিহত

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ৪ জুন ২০২০

লিবিয়ায় ২৬ হত্যার মূল হোতা ড্রোন হামলায় নিহত

শংকর কুমার দে ॥ লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশীকে হত্যাকা-ের ঘটনায় চারটি ট্রাভেল এজেন্সির মালিকসহ মানব পাচারকারী ও দালাল চক্রের ৩৮ জনকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছে সিআইডি। এ ছাড়া মামলার এজাহারে অজ্ঞাতনামা আরও ৩৫ জনের নাম আছে। লিবিয়ায় মানব পাচারের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৫টি মামলা দায়ের হয়েছে এবং এই ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছে ৮ জন। পল্টন থানায় দায়ের করা মামলায় দুই মানব পাচারকারীÑমাহবুবুর রহমান ও সাহিদুর রহমানকে ৪ দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। মানব পাচার ও দালাল চক্রের অন্যতম হোতা হাজী কামালকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে আনার প্রস্তুতি চলছে। লিবিয়ায় আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের গুলিতে নিহত ২৬ জনের মধ্যে দুই জনকে পাঠিয়েছে হাজী কামাল, এমন প্রমাণ পেয়েছে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। লিবিয়ায় নৃশংস ও নির্মমভাবে ২৬ বাংলাদেশীকে হত্যাকা-ের মূল হোতা খালেদ আল-মিশাই গারিয়ান লিবিয়ায় এক ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি ও র‌্যাব সূত্রে এ খবর জানা গেছে। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যাকা-ের ঘটনায় মঙ্গলবার রাতে ঢাকার পল্টন থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে সিআইডি। সিআইডির এসআই রাশেদ ফজল বাদী হয়ে দায়ের করা মামলাটিতে আসামি করা হয়েছে ৩৮ জনকে। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে এবং হত্যার অভিযোগে মামলাটি করা হয়েছে। র‌্যাবের হাতে দুদিন আগে ঢাকায় গ্রেফতার কামাল হোসেন ওরফে হাজী কামাল (৫২)। তাকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে না এনে জামিন নামঞ্জুর হওয়ার পর আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাকে ফের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডে আনার হবে বলে জানা গেছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাকে রিমান্ডে আনার প্রস্তুতি নিয়েছে সিআইডি। পল্টন থানায় দায়ের করা মামলায় দুই মানব পাচারকারীÑমাহবুবুর রহমান ও সাহিদুর রহমানকে চার দিনের রিমান্ডে পাঠিয়েছে আদালত। বুধবার ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয় দুই আসামিকে। পল্টন থানায় করা মামলার আরও তথ্য উদ্ঘাটনের জন্য তাদের ৭ দিনের রিমান্ডে চান মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডি পুলিশের পরিদর্শক মিজানুর রহমান। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম তোফাজ্জল হোসেন ৪ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। তারা মামলার ৩৩ ও ৩৪ নম্বর আসামি। এর আগে মঙ্গলবার লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশীকে হত্যা ও মানব পাচারের ঘটনায় ৩৮ জনকে আসামি করে রাজধানীর পল্টন থানায় মামলা দায়ের করেন পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির উপ-পরিদর্শক রাশেদ ফজল। মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে এবং হত্যার অভিযোগে মামলাটি দায়ের করা হয়। মামলার এজাহারে আসামি হিসেবে ৩৮ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে আরও ৩০/৩৫ জনকে। আসামিদের তালিকায় আছে, ঢাকার শহীদ তাজউদ্দীন সরণির ট্র্যাভেল এজেন্সি নাভীরা লিমিটেড এবং হাতিরঝিলের ফ্লাইওভার ট্যুরস এ্যান্ড ট্র্যাভেলস লিমিটেডের মালিক দুই ভাইÑশেখ মোঃ মাহবুবুর রহমান (৪৯) ও শেখ সাহিদুর রহমান (৪০) এবং পুরানা পল্টনের স্কাই ভিউ ট্যুরস এ্যান্ড ট্রাভেলসের মালিককে এ মামলায় আসামি করা হয়েছে। ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের কামাল হোসেন (৪২) ও শাহাদাত হোসেন নামের দুজনের নামও রয়েছে এজাহারে। আসামিদের তালিকায় নাম এসেছেÑকিশোরগঞ্জের ভৈরবের তানজিলুর ওরফে তানজিলুম ওরফে তানজিদ (৩৫), তানজিদের ভাতিজা নাজমুল (২৪), বাচ্চু ওরফে বাচ্চু মিলিটারি (৫৫), মোঃ জোবর আলী (৫৫), জাফর (৫৫), স্বপন, মিন্টু মিয়া (৩৫), হেলাল মিয়া (৪৫), হাজী শহীদ মিয়া (৬১), মোঃ খবির উদ্দিন, মুন্নি আক্তার রূপসী ও লালন। মামলার আসামিদের মধ্যে মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার জুলহাস সরদার (৪৫) এবং সদর উপজেলার দিনা বেগম (২৫) ইতোমধ্যে স্থানীয় পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়েছেন। এছাড়া দিনার স্বামী নজরুল মোল্লা (৩৫), একই জেলার রাশিদা বেগম (৪২), বুলু বেগম (৩৮), আমির শেখ (৫৫), জাহিদুল শেখ (৩২), জাকির মাতুব্বর (৬০), আমির হোসেন (৫৫), নাসির, সজীব মিয়া, রেজাউল বয়াতী এবং তিন ভাইÑনূর হোসেন শেখ (৪০), ইমাম হোসেন শেখ (৩৫) ও আকবর হোসেন শেখকে (৩২) আসামি করা হয়েছে সিআইডির মামলায়। গোপালগঞ্জের লিয়াকত শেখ ওরফে লেকু শেখ (৪৫), আঃ রব মোড়ল (৪০), কুদ্দুস বয়াতী; শরীয়তপুরের সাদ্দাম (৩৫); কুষ্টিয়ার আলী হোসেনও (৩০) এ মামলার আসামি। এছাড়া অজ্ঞাতনামা ৩০ থেকে ৩৫ জনকে এজাহারে আসামি করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগরীর পল্টন থানার ওসি আবু বকর সিদ্দিক। সিআইডির মামলার এজাহারে বলা হয়, ঢাকার বাংলামোটরের একটি ট্র্যাভেল এজেন্সির মালিকসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ট্র্যাভেল এজেন্সি ও রিক্রুটিং এজেন্সির মালিক, কর্মচারী ও দালালরা ওই পাচারকারী চক্রে জড়িত। তারা ভাল বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বিভিন্ন অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ভিকটিমদের লিবিয়ায় পাচার করে কম টাকায় কঠিন শ্রমে নিয়োজিত করত বলে অভিযোগ করা হয়েছে মামলার এজাহারে। এজাহারে বলা হয়, লিবিয়ায় পাচারের পর বাংলাদেশী ওই দলটিকে এক জায়গায় জড়ো করে আটকে রাখা হয়। তারপর মিজদাহে লিবিয়ান সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সহযোগিতায় অপহরণের নাটক সাজিয়ে বাড়তি টাকা দাবি করা হয়। টাকা আদায়ের জন্য ভিকটিমদের ওপর নির্যাতন চালায় পাচারকারীরা। পরে সেই অডিও এবং ছবি বাংলাদেশে স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে আট থেকে দশ লাখ টাকা দাবি করা হয়। নির্যাতনের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় কোন এক সুদানী ভিকটিম আত্মরক্ষার জন্য একজন স্থানীয় মানব পাচারকারীকে হত্যা করে। পরে আসামিদের সহযোগিতায় স্থানীয় মানব পাচারকারীরা ভিকটিমদের গুলি করলে হতাহতের ঘটনা ঘটে। সিআইডি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকার পল্টন, ভাটারা থানায় দুটি মামলা দায়ের করা ছাড়াও নিহতদের আত্মীয়স্বজন মাদারীপুর সদর ও রাজৈর থানায় তিনটি এবং কিশোরগঞ্জের ভৈরব থানায় একটি মামলা করেন স্থানীয় দালালদের বিরুদ্ধে। গত ২৮ মে লিবিয়ার ত্রিপলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর মিজদাহতে ২৬ বাংলাদেশীকে গুলি করে হত্যা করে একদল মানব পাচারকারী ও তাদের স্বজনরা। ওই ঘটনায় চার আফ্রিকান অভিবাসীও নিহত হন। উন্নত জীবিকার সন্ধানে ইউরোপ যাওয়ার জন্য লিবিয়ার দুর্গম পথ পাড়ি দিচ্ছিলেন ৩৮ বাংলাদেশী। নিহত হওয়ার আগে তারা বেনগাজি থেকে মরুভূমি পাড়ি দিয়ে মানব পাচারকারীরা তাদের ত্রিপোলি নিয়ে যাচ্ছিল। বৃহস্পতিবার ত্রিপলি থেকে ১৮০ কিলোমিটার দক্ষিণের শহর মিজদাহতে ওই দলটি লিবিয়ার মিলিশিয়া বাহিনীর হাতে জিম্মি হয়। তখন পাচারকারীরা আরও টাকা দাবি করে। এ নিয়ে বচসার মধ্যে আফ্রিকার মূল পাচারকারীকে মেরে ফেলা হলে তার পরিবার এবং বাকি পাচারকারীরা এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ৩০ জনকে হত্যা করে, আরও ১১ জন আহত হন। সিআইডির তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, লিবিয়া থেকে তথ্য পাওয়ার পর সোমবার ভোরে ঢাকার শাহজাদপুর থেকে কামাল উদ্দিন ওরফে হাজী কামালকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে হাজী কামাল বলেছেন, নিহতদের মধ্যে অন্তত দুজনকে পাচার করেছিলেন বলে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষের দাবি। এ বিষয়ে ছায়া তদন্ত করতে গিয়ে র‌্যাব কর্মকর্তারা লিবিয়ার একটি সূত্র থেকে জানতে পারেন, হাজী কামাল নামে ঢাকার এক লোক নিয়মিত অবৈধভাবে লিবিয়ায় লোক পাঠায়। কামাল মূলত টাইলসের ঠিকাদারিতে জড়িত। সেই সূত্রে বহু শ্রমিকের সঙ্গে তার যোগাযোগ। ওই শ্রমিকদের ইউরোপে পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে সে টাকা নিয়ে পাচার করে দিত। এভাবে সে অন্তত ৪০০ মানুষকে লিবিয়ায় পাঠিয়েছে। হাজী কামালের গ্রামের বাড়ি কুষ্টিয়ায়। প্রায় ১০ বছর ধরে সে মানব পাচারে জড়িত। লিবিয়ায় ড্রোন হামলায় মানব পাচারের মূল হোতা নিহত ॥ লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশীসহ ৩০ জনকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যার মূল হোতা বলে অভিযুক্ত মিলিশিয়া নেতা খালেদ আল-মিশাই দেশটির বিমান বাহিনীর ড্রোন হামলায় নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার (২ জুন) রাজধানী ত্রিপোলির ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণে গারিয়ান শহরের কাছে ওই হামলায় তার মৃত্যু হয়। লিবিয়ার সংবাদমাধ্যম এ খবর দিয়েছে। সংবাদমাধ্যম বলছে, খালেদ আল-মিশাই ছিলেন লিবিয়ার একাংশের নিয়ন্ত্রক বিদ্রোহী জেনারেল খলিফা হাফতারের অনুসারী। রাজধানী ত্রিপোলিসহ অনেক এলাকা জাতিসংঘ-স্বীকৃত জাতীয় ঐকমত্যের সরকারের (জিএনএ) নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বেনগাজীসহ অনেক তেলসমৃদ্ধ এলাকা খলিফা হাফতারের বাহিনীর দখলে রয়েছে। বাংলাদেশীসহ ওই অভিবাসীদের মিজদা শহরের একটি জায়গায় মুক্তিপণের জন্য জিম্মি রেখেছিল মানব পাচারকারী চক্র। এ নিয়ে এক পর্যায়ে ওই চক্রের সঙ্গে মারামারি হয় অভিবাসী শ্রমিকদের। এতে এক মানব পাচারকারী নিহত হয়। তারই প্রতিশোধ হিসেবে সেই মানব পাচারকারীর লোকজন এ হত্যাকা- ঘটায়।
×