ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রজ্ঞা ও আত্মার ভার্চুয়াল সংলাপ

দেশের ৪ কোটি তামাক ব্যবহারকারী ভয়াবহ করোনা ঝুঁকিতে

প্রকাশিত: ২৩:০০, ৩ জুন ২০২০

দেশের ৪ কোটি তামাক ব্যবহারকারী ভয়াবহ করোনা ঝুঁকিতে

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে তামাকাসক্ত ফুসফুস কোভিড-১৯ সংক্রমণে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই সতর্কতা আমলে নিলে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি তামাক ব্যবহারকারী মারাত্মকভাবে করোনা সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আসন্ন বাজেটে কার্যকরভাবে তামাক পণ্যের দাম বাড়ানো হলে তামাকের ব্যবহার কমবে এবং রাজস্ব আয় বাড়বে। বাড়তি রাজস্ব সরকার কোভিড-১৯ মহামারী সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ব্যয় এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যয় করতে পারবে। মঙ্গলবার তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান) এবং এ্যান্টি টোব্যাকো মিডিয়া এলায়েন্স- আত্মা’র যৌথ উদ্যোগে ‘কেমন তামাক কর চাই, বাজেট ২০২০-২১’ শীর্ষক ওয়েবিনার বা সংলাপে অংশ নিয়ে এমনটাই সুপারিশ করেছেন একাধিক সংসদ সদস্যসহ অর্থনীতিবিদরা। ওয়েবিনারে প্রজ্ঞা’র পক্ষ থেকে তামাক কর বিষয়ক ‘বাজেট প্রস্তাব ২০২০-২১’ তুলে ধরা হয়। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং জাতীয় তামাকবিরোধী মঞ্চের আহ্বায়ক ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেন, করোনা আমাদের জন্য একটি সুযোগ তৈরি করেছে। আমরা এ সুযোগে কল্যাণের পথ বেছে নেব। এক্ষেত্রে আমাদের তামাক ব্যবহার বন্ধ করতে হবে এবং সার্বজনীন স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জনে প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতির কথা তুলে ধরে সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী এমপি বলেন, যদি এবারের বাজেটে তামাকপণ্যে করারোপের ক্ষেত্রে কোন মৌলিক পরিবর্তন না আসে, এই বাড়তি ১১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের সুযোগ আমরা হারাই, এত মৃত্যু, অসুস্থতা অব্যাহতই থেকে যায় তাহলে আমি নৈতিকভাবে এই বাজেটকে সমর্থন করতে পারি না। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস) এর সিনিয়র রিসার্চ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ মনে করেন ধূমপান কমাতে সিগারেটের স্তর সংখ্যা কমানোর বিকল্প নেই। তিনি বলেন, আসন্ন ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে সিগারেটের বিদ্যমান চারটি মূল্যস্তর বিলুপ্ত করে দুটি নির্ধারণ করা দরকার। কারণ একাধিক মূল্যস্তর এবং বিভিন্ন দামে সিগারেট ক্রয়ের সুযোগ থাকায় ভোক্তা স্তর পরিবর্তন করার সুযোগ পায়। ফলে তামাক ব্যবহার হ্রাসে কর ও মূল্য পদক্ষেপ সঠিকভাবে কাজ করে না। এর পাশাপাশি তামাক নিয়ন্ত্রণে সচেতনতা বৃদ্ধির কার্যক্রমের ওপরও গুরুত্বারোপ করেন তিনি। সংসদ সদস্যদের বিড়ির কর না বাড়ানোর পক্ষে চিঠি দেয়াকে দুঃখজনক উল্লেখ করে অধ্যাপক ডাঃ হাবিবে মিল্লাত এমপি বলেন, তামাকের বিপক্ষে আমাদের শক্তিকে আরও জোড়ালো করতে হবে। প্রস্তাবিত কর ও দাম বাড়ানোর পদক্ষেপ সমর্থন করে তিনি বলেন এবারের বাজেট অধিবেশনে কমপক্ষে ১৫০ সাংসদকে এই প্রস্তাব বাস্তবায়নের পক্ষে কথা বলার জন্য উদ্বুদ্ধ করব। বাংলাদেশে মোট তামাক ব্যবহারকারীর অর্ধেকেরও বেশি ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্য ব্যবহার করলেও এসব তামাকপণ্যের দাম সবচেয়ে সস্তা এবং রাজস্ব আয় খুব কম উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. রুমানা হক বলেন, ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যে করারোপের ভিত্তিমূল্য খুব কম, তাই কর বাড়ানোর পাশাপাশি মূল্যও বাড়াতে হবে। এছাড়া তিনি অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থাৎ লাইসেন্সবিহীন উৎপাদনকারীদের কর জালের আওতায় আনার সুপারিশ করেন। তামাকপণ্যে করারোপ বিষয়ে সাংসদদের সারাবছর ধরেই জোরালো ভূমিকা পালন করা উচিত বলে মনে করেন ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী এমপি। তিনি বলেন, সংসদ সদস্যরা অধিবেশন চলাকালে বিভিন্ন ধারায় বছরজুড়েই তামাক বিষয়ে সংসদে প্রশ্ন এবং আলোচনা করতে পারেন। তিনি আরও বলেন, আমাদের তামাককে ব্যয়বহুল করে ফেলতে হবে। এতে তামাকের দাম বাড়বে, রাজস্ব বেশি আসবে এবং তামাকপণ্য ব্যবহারে মানুষ নিরুৎসাহিত হবে। তামাকপণ্যের ওপর বিদ্যমান করকাঠামো সংস্কার ও এর সুফলের ওপর গুরুত্বারোপ করে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এ্যান্ড স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ (বিআইআইএসএস) এর রিসার্চ ডিরেক্টর ড. মাহফুজ কবীর বলেন, তামাকপণ্যে করারোপ সহজ করতে সম্পূরক শুল্কের একটি অংশ সুনির্দিষ্ট কর আকারে আরোপ করতে হবে এবং অন্যান্য কর পদক্ষেপের সঙ্গে সব ধরনের তামাক পণ্যের খুচরা মূল্যের ওপর ৩ শতাংশ হারে সারচার্জ আরোপ করা যেতে পারে। সব মিলিয়ে তামাক-কর বিষয়ক এই প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে সম্পূরক শুল্ক এবং ভ্যাট বাবদ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত রাজস্ব এবং সারচার্জ থেকে আরও প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয় অর্জন করা সম্ভব হবে। এই অর্থ সরকার তামাক ব্যবহারের ক্ষতি হ্রাস, করোনা মহামারী সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ব্যয় এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যয় করতে পারবে। ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য তামাক কর বিষয়ক বাজেট প্রস্তাব দিয়েছে তামাকবিরোধী সংগঠন প্রজ্ঞা (প্রগতির জন্য জ্ঞান)। প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ১। সিগারেটের মূল্যস্তর সংখ্যা ৪টি থেকে ২টিতে (নিম্ন এবং প্রিমিয়াম) নামিয়ে আনা। ক. ৩৭+ টাকা এবং ৬৩+ টাকা এই দুইটি মূল্যস্তরকে একত্রিত করে নিম্নস্তরে নিয়ে আসা; নিম্নস্তরে ১০ শলাকা সিগারটের খুচরা মূল্য ন্যূনতম ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে ৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ১০ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা। খ. ৯৩+ টাকা ও ১২৩+ টাকা এই দুইটি মূল্যস্তরকে একত্রিত করে প্রিমিয়াম স্তরে নিয়ে আসা; প্রিমিয়াম স্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের খুচরা মূল্য ন্যূনতম ১২৫ টাকা নির্ধারণ করে ৫০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক এবং ১৯ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; ২। বিড়ির ফিল্টার এবং নন-ফিল্টার মূল্য বিভাজন তুলে দেয়া, ফিল্টারবিহীন ২৫ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ৪০ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক ও ৬.৮৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; এবং ফিল্টারযুক্ত ২০ শলাকা বিড়ির খুচরা মূল্য ৩২ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক এবং ৫.৪৮ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা। ৩। ধোঁয়াবিহীন তামাকপণ্যের (জর্দা ও গুল) মূল্য বৃদ্ধি করা; প্রতি ১০ গ্রাম জর্দার খুচরা মূল্য ৪০ টাকা এবং প্রতি ১০ গ্রাম গুলের খুচরা মূল্য ২৩ টাকা নির্ধারণ করে ৪৫% সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; এবং প্রতি ১০ গ্রাম জর্দা ও গুলের ওপর যথাক্রমে ৫.৭১ টাকা এবং ৩.৪৫ টাকা সুনির্দিষ্ট সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা; সকল ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ও ১ শতাংশ স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ বলবৎ রাখা। ৪। সকল তামাকপণ্যের খুচরা মূল্যের ওপর ৩ শতাংশ হারে সারচার্জ আরোপ করা। উল্লেখিত তামাক-কর ও মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে সম্পূরক শুল্ক এবং ভ্যাট বাবদ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত অতিরিক্ত রাজস্ব আয় অর্জিত হবে বলে সংলাপে জানানো হয়। এছাড়াও ৩ শতাংশ সারচার্জ থেকে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকা বাড়তি রাজস্ব আয় অর্জন করা সম্ভব হবে। অতিরিক্ত এই অর্থ সরকার তামাক ব্যবহারের ক্ষতি হ্রাস, করোনা মহামারী সংক্রান্ত স্বাস্থ্য ব্যয় এবং প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নে ব্যয় করতে পারবে।
×