ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন আম চাষীদের

প্রকাশিত: ২২:৫২, ৩১ মে ২০২০

ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন আম চাষীদের

ওয়াজেদ হীরা ॥ একে তো করোনার শঙ্কা আবার ঘূর্ণিঝড়ে ভরা মৌসুমে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দেশের আম চাষীরা। আমের ফলন ওঠার আগে বয়ে যাওয়া ঘূর্ণিঝড় আমফান ও কালবৈশাখীর কারণে ঝরে পড়েছে বাগানের অনেক আম। আর এতে ক্ষতির দুশ্চিন্তায় মাথায় হাত চাষীদের। ঘূর্ণিঝড় আমফান ও পরবর্তী কালবৈশাখী ঝড়ে দেশের বিভিন্ন জেলায় আমের প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় গড়ে ৫ শতাংশের মতো আম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে যে আম এখনও রয়ে গেছে সঠিকভাবে বাজারজাত করা গেলে চাষীরা পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে চাষী ও কৃষি সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন। আজ রবিবার থেকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া মোটামুটি সবকিছু খুলে দেয়ায় ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন আম চাষীরা। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য মতে, গত বছরের চেয়ে এবছর জমি এবং উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা দুই-ই বেড়েছে। অধিদফতরের হর্টিকালচার উইংয়ের তথ্য মতে, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ লাখ ৮৮ হাজার ৮৩৬ হেক্টর জমিতে আমের উৎপাদন হয় ২২ লাখ ২৮ হাজার ৯৭২ টন। ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১ লাখ ৮৯ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে আবাদ হয়েছে, যেখানে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ২২ লাখ ২৯ হাজার একশ’ টন। দেশের পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে কয়েকটি জেলায় বড় আকারে আমের চাষ হয়। প্রতিবছর সাধারণত মে মাসের মধ্যভাগ থেকে আম পাড়া শুরু হয়। বিভিন্ন জেলায় ইতোমধ্যে আম পাড়ার সময়ও নির্ধারণ করে দিয়েছিল প্রশাসন। তবে পরিপক্ব না হওয়ায় অনেকেই সময়ের মধ্যে আম নামাতে পারনি। এরই মধ্যে হানা দেয় ঘূণিঝড় আমফান এবং এর পরে একাধিক কালবৈশাখী ঝড়। এতে সাতক্ষীরা, রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলাসহ অন্যান্য অঞ্চলের আমও ঝরে পড়ে। আম চাষীরা জানান, গরম আবহাওয়া না হলে আম পাকতে দেরি হয়। আমের জীবন দীর্ঘ হয়। ঝড়ের কারণে আম গাছের গোড়ায় পানি জমে পরিপক্ব হতে সময় লাগছে। তবে ঝড়ে যে পরিমাণ আম ঝড়েছে তার ক্ষতি টাকার অঙ্কে চারশ’ কোটি টাকারও মতো। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের একাধিক সূত্র নাম প্রকাশ না করে বলেন, দেশে ঘূর্ণিঝড়ে যে আমের ক্ষতি হয়েছে গড়ে ৫ শতাংশ। কোন অঞ্চলে বেশি কোন অঞ্চলে কম ক্ষতি হয়েছে। অধিদফতরের একাধিক কর্মকর্তা জানান যে পরিমাণ আম নষ্ট হয়েছে তা টাকার অঙ্কে চারশ’ কোটি টাকার মতো হতে পারে। যদিও কৃষি মন্ত্রণালয় এবারের আমের পাশাপাশি মধুমাসের সকল ফলের উৎপাদন ও বিপণন ঠিক রাখতে নিবিড়ভাবে তারা কাজ করে যাচ্ছেন। মৌসুমি ফল বাজারজাতকরণে সুষ্ঠু উপায় বের করতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক করে বিভিন্ন নির্দেশনাও দিয়েছেন। এদিকে ঝড়ে যে ক্ষতি হয়ে তাতে উৎপাদনে কোন নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন না কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের হর্টিকালচার উইং। হর্টিকালচার উইংয়ে পরিচালক কবীর হোসেইন জনকণ্ঠকে বলেন, এটা ঠিক কিছু আম নষ্ট হয়েছে ঝরে পড়েছে। তবে এতে খুব চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই ফলনেও খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। আমাদের প্রতিবছর কিছু আম রোগবালাইয়ে নষ্ট হয় এবার সেটি হয়নি কিন্তু সেটি ঝড়ে হয়েছে। তবে ঝরে যাওয়া আম যাতে ব্যবসায়ীরা বিক্রি করে কিছু অর্থ পায় সে ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে কবীর হোসেইন বলেন, স্থানীয়ভাবে জ্যাম জেলি ইত্যাদির ব্যবস্থা করা হয়েছে। যে প্রতিষ্ঠান এসব প্রসেসিং করে চাষীদের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র যাতায়াতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। লবন পানি দিয়ে ধুয়ে স্টিফ পদ্ধতি ব্যবহার করে ১ থেকে দেড় মাস রাখার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। ফলে ঝরে পড়া আম থেকেও চাষীরা কিছু অর্থ পাবে। হর্টিকালচার উইংয়ের তথ্য মতে, আমের রাজধানী চাঁপাইয়ে আমের উৎপাদন হয় বেশি। একাধিক জেলার কৃষি কর্মকর্তারা জানান, চাষীরা যদি ভাল মূল্য পান তাহলে ঝরে যাওয়া আমের ক্ষতি কোন প্রভাব পড়বে না। যেহেতু সহজে বাজারজাতকরণের একটি আশার আলো হচ্ছে লকডাউন শিথিল। অফিস আদালত খুলছে, মানুষের চাহিদাও থাকবে, ভাল মূল্য পাওয়া যাবে এমন প্রত্যাশা অনেকের। হর্টিকালচার উইংয়ের পরিচালক বলেন, অন্যবার রোজার সময় আম বাজারে আসে। এবার রোজা এবং ঈদের পর বাজারে আসছে। মানুষের চাহিদা বেশি থাকবে এতে কৃষকরা ভাল মূল্য পাবে আশা করি। দাম নিয়ে শঙ্কায় রাজশাহীর চাষীরা ॥ ঝড়ে ক্ষতি তিনশ’ কোটি টাকার আম রাজশাহী থেকে স্টাফ রিপোর্টার মামুন-অর-রশিদ জানান, আমের রাজধানী নামে খ্যাত রাজশাহীতে লোকসানের শঙ্কা নিয়েই গাছ থেকে আম পাড়া শুরু করেছেন চাষী ও ব্যবসায়ীরা। গাছ থেকে আম পাড়ার সময় ক’দিন আগেই শুরু হয়েছে। তবে আবহাওয়া অনুকূল না থাকায় আম পাড়েননি চাষীরা। বিভিন্ন কারণে এবার লোকসানের কথা চিন্তা করেই গত শুক্রবার থেকে রাজশাহী ও বিভিন্ন উপজেলার চাষীরা গাছ থেকে আম পাড়া শুরু করেছেন। তবে শুরুতে বাজার দর নিয়ে শঙ্কা আম ব্যবসায়ীরা। এরই মাঝে আশায় বুক বেঁধেছেন তারা। আগামী ক’দিনে প্রত্যাশিত দাম পাওয়ারও আশা করছেন তারা। চাষীরা বলছেন রাজশাহীর আম ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় যাওয়া শুরু হলেই হয়তো দাম ভাল পাবেন তারা। এক সপ্তাহের মধ্যে রাজশাহীর আমের হাটবাজার জমে উঠবে বলেও আশা করছেন আম ব্যবসায়ী ও চাষীরা। এদিকে ভাল খবর দিচ্ছে রেলওয়ে। আগামী ৫ জুন রহনপুর থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহী হয়ে আমের প্রথম চালান নিয়ে ঢাকার পথে রওনা দেবে বনলতা এক্সপ্রেস ট্রেন। পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপক মিহির কান্তি গুহ শনিবার এ তথ্য জানিয়েছেন। এদিকে সম্প্রতি আঘাত হেনেছে সুপার সাইক্লোন আমফান। এরপর কালবৈশাখীর তা-ব। এভাবে একের পর এক ঝরে পড়ছে আম। এতে চিন্তিত বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের আম বাগানের মালিকরা। ঘূর্ণিঝড় আমফান ও কালবৈশাখী ঝড়ে প্রায় ১৫ ভাগ আম নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছেন ফল গবেষণার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। কৃষি বিভাগের দেয়া তথ্যানুযায়ী, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর ও নওগাঁয় যে পরিমাণ আম ঝরে পড়েছে তার আনুমানিক বাজার মূল্য প্রায় তিনশ’ কোটি টাকা। তবে কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এখনও যে পরিমাণ আম বাগানগুলোতে আছে তা সঠিকভাবে পরিচর্যা করে বাজারজাত করলে ভাল দাম পাবে বাগান মালিকরা। রাজশাহী কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলের বাগানগুলোতে এবার আমের মুকুল কিছুটা কম এসেছিল। সে অনুযায়ী আমের উৎপাদনও কম হয়েছে। তার ওপর ঘূর্ণিঝড় আমফানের আঘাতে বহু গাছ উপড়ে পড়ে ডালপালা ভেঙ্গে গেছে। আম বাগানের মালিকরা বলছেন, তারা এমনিতেই করোনাভাইরাসের কারণে আম বাজারজাত নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন। তার ওপর একের পর এক ঝড়ের তা-ব তাদের চিন্তা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। রাজশাহী ফল গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলিম উদ্দিন জানান, ঝড়ে ১৫ শতাংশ আম ঝরে পড়েছে। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক সুধীন্দ্রনাথ রায় বলেন, এখনও বাগানগুলোতে যে পরিমাণ আম আছে তা সঠিকভাবে পরিচর্যা ও বাজারজাত করতে পারলে ভাল দাম পাবেন বাগান মালিকরা। এবার রাজশাহী জেলা প্রশাসন থেকে প্রথম দফায় ১৫ মে রাজশাহীতে দেশীয় জাতের গুটি আম পাড়ার সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল। ২০ মে থেকে গোপালভোগ আম পাড়া শুরুর কথা ছিল। ৬ জুন আম রুপালি ও ফজলি ১৫ জুন, আশ্বিনা ১০ জুলাই থেকে পাড়া শুরু হবে বলে জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু আম পরিপক্ব না হওয়া ও দেশব্যাপী লকডাউনের কারণে চাষীরা গাছ থেকে আম পাড়েননি। দ্বিতীয় দফায় ২৫ মে ল্যাংড়া, খিরশাপাতসহ অন্যান্য জাতের আম গাছ থেকে নামানোর কথা ছিল। সাতক্ষীরায় আমের ক্ষতি ৬৫ কোটি টাকা ॥ স্টাফ রিপোর্টার মিজানুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় আমফানে সাতক্ষীরায় ২ হাজার ৩৭ হেক্টর জমির আম সম্পূর্ণ নষ্ট হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে ৬৫ কোটি ১৮ লাখ ৪০ হাজার টাকার। আবাদ করা ৪ হাজার ১শ’ ১০ হেক্টর জমির মধ্যে প্রায় ১২শ’ হেক্টর জমির আম আমফানের আঘাতের আগেই চাষীরা ভেঙ্গে নেয়। এখনো কিছু আম অবশিষ্ট থাকলেও তার গুণগত মান কমে গেছে বলে জানান আমচাষীরা। আমফানের আঘাতে জেলায় ছোট বড় ৪৭ হাজার আমচাষী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে কৃষি বিভাগ থেকে জানানো হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানায়, চলতি বছর জেলায় আম চাষ হয় ৪ হাজার ১শ’ ১০ হেক্টর জমিতে। প্রতি হেক্টরে ৯ টন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও এবছর আবহাওয়া জনিত কারণে আমের ফলন খুব ভাল হয়নি। এর পরও এ বছর ৩৫ হাজার টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়। আমফানের আঘাতে প্রায় ৫০ ভাগ আম নষ্ট হয়েছে। জেলার তালা, কলারোয়া, আশাশুনির কিছু অংশ, দেবহাটা ও সদর উপজেলা জুড়ে আমের চাষ হয়ে থাকে। চলতি বছর হিমসাগর চাষ হয় ১৫শ’ ৫০ হেক্টর জমিতে। লেংড়া চাষ হয় ৫শ’৬৪ হেক্টর ও আম রুপালি চাষ হয়েছে ৯শ’ হেক্টর জমিতে। সাতক্ষীরা জেলায় উৎপাদিত জনপ্রিয় আম হিমসাগর। তেমন ক্ষতি হয়নি হাঁড়িভাঙ্গা আমের ॥ এ বছর রংপুরের ঐতিহ্যবাহী হাঁড়িভাঙ্গা আমের বাম্পার ফলন হয়েছে। তবে আমফান ও কালবৈশাখী খুব একটা ক্ষতি হয়নি রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা আমের। রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক ড. মোঃ সরওয়ারুল হক বলেন, আমাদের তিন হাজার হেক্টর জমিতে আম হয়েছে এর মধ্যে ১৪-১৫ হেক্টর জমির আম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বরাবরই ঝড়ে এমন ক্ষতি হয়। এটি একেবারেই সামান্য ক্ষতি। গাছে ফলন ভাল। জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে হাঁড়িভাঙ্গা আম পাকা শুরু হবে। আশা করছি চাষীরা ভাল মূল্য পাবে। পরিববহন ও বিপণন ব্যবস্থা ভাল থাকলে কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকার আম বিক্রি করা যাবে বলে কৃষি বিভাগ আশা প্রকাশ করেছে।
×