ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

করোনার কারণে দেশে ফিরতে পারেন ৪ লাখ কর্মী

প্রকাশিত: ২২:২৭, ১৮ মে ২০২০

করোনার কারণে দেশে ফিরতে পারেন ৪ লাখ কর্মী

ফিরোজ মান্না ॥ করোনা পরিস্থিতির কারণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তিনলাখ কর্মী দেশে ফিরতে পারে। এইসব কর্মীদের পুনর্বাসন করতে সরকার ইতোমধ্যে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। শুধুমাত্র মধ্যপ্রাচ্য থেকেই ফিরবে তিন লাখ কর্মী। অন্য দেশগুলো থেকে ফিরবে আরও এক লাখ। সরকারীভাবে এইসব কর্মীদের পুনর্বাসনে দুইশ’ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হলেও মানবসম্পদ রফতানিকারকরা এখন পর্যন্ত এদের সহায়তায় কোন ঘোষণা দেয়নি। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী বলেছেন, এই বরাদ্দ যথেষ্ট নয়। এই খাতে আরও বরাদ্দ বাড়ানো হবে। আরব দেশগুলো বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয় সামাল দিতে বিদেশী কর্মী ছাঁটাই শুরু করেছে। ইতোমধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের ৬টি দেশ থেকে বাংলাদেশের ৪২ হাজার কর্মীকে দেশে ফিরিয়ে নেয়ার জন্য কঠোরভাবে তাগিদ দিচ্ছে। মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর থেকেই বেকার হয়ে ফিরতে পারে কিছু কর্মী। কুয়েত ও কাতার থেকে গত এক সপ্তাহে দেড় হাজারের বেশি কর্মীকে দেশে পাঠানো হয়েছে। মালদ্বীপ থেকে প্রায় ১৫ হাজারের বেশি কর্মীকে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। গত দুই দিনেই বিশেষ ফ্লাইটে এক হাজারের বেশি কর্মী দেশে ফিরেছেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, করোনা পরিস্থিতির কারণে শুধু মধ্যপ্রাচ্য থেকে ৩ লাখের বেশি কর্মী দেশে ফিরে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ইউরোপ আমেরিকা থেকে কোন কর্মী দেশে ফিরছেন না। যারা বেড়াতে, ব্যবসায়িক কাজে ও চিকিৎসার জন্য গিয়েছিলেন তারা দেশে ফিরতে কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছেন। বিদেশ থেকে যারাই ফিরছেন তাদের অনেককেই সশস্ত্রবাহিনী প্রতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে নিচ্ছে। যাদের স্বাস্থ্য সনদ রয়েছে তাদের বাড়িতে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়েছে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে ফিরে আসা কর্মীদের নগদ ৫ হাজার করে টাকা ও খাবার দেয়া হচ্ছে। তবে আরব দেশগুলোর মধ্যে বাহরাইন কর্মীদের সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে দেশেই রেখে দিচ্ছে। আর সংযুক্ত আরব আমিরাতে দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা শ্রমবাজার করোনা পরিস্থিতির মধ্যেই খুলে দিয়েছে। জনকণ্ঠকে এ তথ্য জানিয়েছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব আহমেদ মনিরুছ সালেহীন। এতদিন যারা বিদেশ থেকে অর্থ পাঠাতেন এখন তাদের অনেকেই দেশ থেকে টাকা নিয়ে চলতে হচ্ছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে হয়তো তাদের দেশে ফিরতে হবে। দেশে ফেরার পর তাদের পুনর্বাসনে সরকার ইতোমধ্যে দুইশ’ কোটি টাকার একটি তহবিল ঘোষণা করেছে। মানবসম্পদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অর্থ এত লোকের পুনর্বাসনে খুবই অপ্রতুল। সরকারের পাশাপাশি যেসব প্রতিষ্ঠান তাদের বিদেশ পাঠিয়েছে, এই সময় তাদেরও সহযোগিতার হাত বাড়ানো উচিত। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, করোনা পরিস্থিতির মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকেই বেশি কর্মীকে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। দেশগুলোতে করোনা পরিস্থিতি ও করোনা পরবর্তী সময়ে নির্মাণ কাজ স্থবির হয়ে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ কারণে দেশগুলোর নির্মাণকর্মীরা বেকার হয়ে পড়বেন। তাদের বাধ্য হয়েই দেশে ফিরতে হবে। আমেরিকায় ৩ শ’ জনের ওপর বাংলাদেশী দেশে ফেরার জন্য আবেদন করেছেন। ইউরোপের কয়েকটি দেশ থেকেও আড়াই শ’ বাংলাদেশী দেশে ফেরার জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে ই-মেলে আবেদন জানিয়েছে। তাদের দেশে ফেরত আনতে বিভিন্ন এয়ারলাইন্সের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। আর যে সব জায়গায় বাংলাদেশ বিমানের ফ্লাইট আছে ওই সব দেশ থেকে বিমানের ফ্লাইটে তাদের দেশে আনা হবে। তারা অবশ্য বিভিন্ন কারণে ওইসব দেশগুলোতে অবস্থান করছিলেন। আমেরিকা থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম চৌধুরী টেলিফোনে জনকণ্ঠকে বলেন, আমি চিকিৎসা করতে এসে পরিবার পরিজন নিয়ে করোনার কারণে আটকা পড়েছি। শুধু আমি না আমার মতো আরও অনেক মানুষ আটকা পড়েছেন। তাদের এখানে থাকা মানে বড় অঙ্কের টাকা খরচ হচ্ছে। সরকার বিভিন্ন দেশে আটকা পড়াদের বিশেষ ব্যবস্থায় দেশে ফিরিয়ে নিচ্ছে। আমেরিকা থেকেও এ ধরনের ব্যবস্থা করেতে পারে। জাতীয় প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক কামরুল ইসলাম চৌধুরী মার্চের শুরুর দিকে ওপেন হার্ট বাইপাস সার্জারির পর যুক্তরাষ্ট্রের সিনাই হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে এখন সুস্থ জীবন যাপন করছেন। তিনি এখন দেশে ফেরার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের সচিব মনিরুছ সালেহীন বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশে জেল বা কনসেন্টেশন ক্যাম্পে থাকা বন্দীদের মুক্তি দিয়েছে। একই সঙ্গে বেশ কিছু অবৈধ কর্মীকে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য চাপ সৃষ্টি করছে। আমরা কূটনৈতিকভাবে বিষয়গুলো মোকাবেলা করে যাচ্ছি। দুর্যোগ পরিস্থিতিতে এত বিপুল সংখ্যক কর্মীকে দেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত থেকে ওই সব দেশের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করা হচ্ছে। কোন কোন দেশের মনোভাব কিছুটা পরিবর্তন হচ্ছে। তবে সৌদি আরব এখন অনড় অবস্থানে রয়েছে। তারা বন্দীদের ও অবৈধ কর্মীদের দেশে ফেরত পাঠাবেই। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে-সৌদি কর্তৃপক্ষকে মানবিক দৃষ্টি থেকে বিষয়টি বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। দু’এক দিনের মধ্যে রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে প্রস্তাব দেয়া হবে। বিভিন্ন দেশ থেকে যে সব কর্মী ফেরত আসছেন তাদের জন্য প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় নগদ ৫ হাজার টাকা ও খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে বিমান বন্দরে। তাছাড়া কর্মীদের যে সব দেশ ফেরত পাঠাচ্ছে তার পুরো খরচ ওই সব দেশই বহন করছে। এখানে কর্মীদের কোন টাকা লাগছে না। তিনি আরও বলেন, এত খারাপ খবরের মধ্যে বাহরাইন সরকার বাংলাদেশী অবৈধ কর্মীদের বৈধতা দিয়েছে। তাদের বিভিন্ন চাকরিতে যোগদানের সুযোগ করেছে। তারা কোন কর্মীকে দেশে ফেরত পাঠাবে না। অন্য আরেকটি ভাল খবর দীর্ঘদিন সংযুক্ত আরব আমিরাতে ট্যুরিস্ট ভিসা ছাড়া আর সব ধরনের ভিসাই বন্ধ ছিল। করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও দেশটি বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের জন্য আবার ভিসা চালু করেছে। এক প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, যেসব কর্মী দেশে ফিরছেন তাদের পুরোপুরি স্বাস্থ্যবিধি মেনেই বাড়িতে পাঠানো হচ্ছে। আমাদের মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে ফিরে আসা কর্মীদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন যেতে হচ্ছে। যাদের করোনা নেই এমন সনদপত্র দেখাচ্ছেন তাদের বাড়িতে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হচ্ছে। তারা মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে কর্মীদের পাঠানোর বিষয়েও একটা সমঝোতা হয়েছে। আমাদের দেশে যে পরিমাণ কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থা আছে ঠিক পরিমাণ কর্মীই তারা পাঠাবেন। কারণ বেশি কর্মী পাঠালে আমরা সঠিকভাবে তাদের স্বাস্থ্যবিধি মানাতে পারব না। সব কিছুই হচ্ছে একটা সমন্বয়ের মাধ্যমে। সূত্র জানিয়েছে, অভিবাসী কর্মীদের বেশির ভাগই চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। এখন কাজ নেই। অবৈধ ব্যক্তিরা কোন কাজই পাচ্ছেন না। জীবন হয়েছে মানবেতর, অনেকেই দেশে ফিরতে চান। বিভিন্ন দেশের কর্তৃপক্ষ এটাকেও একটা ইস্যু করে বন্দী কর্মী ও অবৈধ কর্মীকে দেশে ফেরত পাঠাচ্ছে। ফেরত পাঠানোর জন্য কুয়েত সরকার বাংলাদেশের অবৈধ কর্মীদের অস্থায়ী আটক শিবিরে জড়ো করেছে। শিবিরগুলোর বাসিন্দারা বলছেন, তাদের মোট সংখ্যা প্রায় ৭ হাজার। ইতোমধ্যে সংক্রমণের ভয়ে জেল ও আটকশিবির খালি করে অবৈধ কর্মীদের পাঠানো শুরু হয়েছে। গত দুই সপ্তাহে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে ৪ হাজারের বেশি কর্মী দেশে ফিরেছেন। সবাইকে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন বা সঙ্গনিরোধে রাখতে হচ্ছে। আগামী কয়েক সপ্তাহে মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে ৪২ হাজার দেশে ফিরবেন। জনশক্তি প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থান ব্যুরোর (বিএমইটি) হিসাবে, অভিবাসী কর্মীদের প্রায় ৮০ ভাগই চাকরি নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের আট দেশে আছেন। প্রবাসী আয়ের অর্ধেকের বেশি তারাই পাঠান। কর্মী বেশি ফিরতে পারে সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত ও ওমান থেকে। এই পাঁচ দেশ বাংলাদেশের শীর্ষ ১০টি প্রবাসী আয়ের দেশের মধ্যে রয়েছে। বাহরাইন, লেবানন আর জর্দান থেকেও অনেক কর্মীকে ফিরতে পারে। জর্দানে প্রায় ৪৫ হাজার কর্মী তৈরি পোশাক খাতে কাজ করেন। রফতানি আদেশ বাতিল হওয়ায় কারখানায় কাজ বন্ধ, বেতন পাচ্ছেন না অনেকে। তারা মানবেতর জীবন যাপন করছেন। বিএমইটি বলছে, গত দুই বছর অভিবাসন অনেক কমছে। ২০১৭ সালে ১০ লাখ কর্মী বিদেশে চাকরি নিয়ে গেছেন। গত বছর মাত্র ৭ লাখ কর্মী বিদেশে চাকরি পেয়েছেন। করোনা পরিস্থিতি মধ্যে ৭ লাখের বেশি কর্মী দেশে ফিরে এসেছেন। আরও ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন। চলমান সঙ্কট সমাধানে প্রবাসীকল্যাণ ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মিলে কাজ করছে। তারপরও যারা ফিরে আসছেন, তাদের পুনর্বাসনের জন্য প্রশিক্ষণ ও কম সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। সূত্র জানিয়েছে, বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমের সবচেয়ে বড় বাজার সৌদি আরব। দেশটির বাংলাদেশ দূতাবাস বলেছে, সেখানে ২২ লাখ বাংলাদেশী কাজ করছেন। গত বছর মোট অভিবাসী কর্মীর প্রায় ৬০ শতাংশ ওই দেশে গেছেন। কর্মকর্তাদের কারও কারও আশঙ্কা, এই দেশ থেকে সাত লাখের মতো কর্মী ফিরে আসতে পারেন। দূতাবাস সূত্র বলছে, দেশে ফিরতে বাধ্য করার জন্য সৌদি সরকার ইকামা বা কাজের বৈধ অনুমতিপত্রের মেয়াদ না বাড়িয়ে কর্মীকে অবৈধ করে দিতে পারে। ইকামার নবায়ন ফি কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিতে পারে। অন্য দেশগুলোও এমন নানা কৌশল নিতে পারে। দেশটি দুই বছর ধরে অবৈধ কর্মীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালাচ্ছে। করোনাকালে পরিস্থিতি কঠিনতর হচ্ছে। অভিবাসন খাতের একাধিক সূত্র বলছে, তথাকথিত ‘ফ্রি ভিসা’ নিয়ে দেশটিতে গিয়ে অবৈধ হয়েছেন কয়েক লাখ প্রবাসী। তারা এখন অবৈধ হয়ে পড়েছেন।
×