ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

খোশ আমদেদ মাহে রমজান

প্রকাশিত: ২৩:০১, ১ মে ২০২০

খোশ আমদেদ মাহে রমজান

অধ্যাপক মনিরুল ইসলাম রফিক ॥ আজ রমজানুল মোবারকের ৭ম দিবস। ইবাদত বন্দেগির এ মাসে আমরা একজন মহীয়সী মহিলার জীবনচরিত সামনে রাখতে চাই। মুসলিম আধ্যাত্ম সাধনার ইতিহাসের কিংবদন্তি মহীয়সী নারী হযরত রাবেয়া বসরী (রহ.) খোদা ভক্তি, ইবাদত, ধৈর্য ও ত্যাগের কারণে সাহাবী পরবর্তী যুগে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তাঁর জন্ম বসরা নগরীতে। খৃস্টীয় সপ্তম শতাব্দীতে। বিখ্যাত তাপস ও সাধক পুরুষ হযরত হাসান বসরী (রহ.) অনুপ্রেরণা ছিলেন এ মহীয়সী মহিলার। নিরহংকার এবং দুনিয়াবী স্বার্থের প্রতি নির্লোভ এবং নির্মোহতার দৃষ্টান্তে রাবেয়া বসরী ছিলেন শীর্ষে। তিনি প্রায় সময় মোনাজাতে বলতেনঃ “হে আল্লাহ! এ সংসারে আমার কার্য এবং আমার আকাক্সক্ষা কেবল তোমায় স্মরণ করা এবং পরকালে তোমার পবিত্র দর্শন লাভ। একমাত্র তুমিই আমার আন্তরিক আকাক্সক্ষা ও লক্ষ্য। হে প্রভু! আমার অন্তকরণকে তোমার স্মরণে উপস্থিত রাখো এবং আমার প্রাণহীন নামায তুমি কবুল কর।’ কথিত আছে, তাঁর পিতা এতই দরিদ্র ছিলেন যে, রাত্রে যখন রাবেয়া জন্মগ্রহণ করেন, তখন ঘরে জ্বালানোর জন্য তেল পর্যন্ত ছিল না। এর পূর্বে তাঁর পিতার আরও তিনটি কন্যা হয়েছিল ইনি চতুর্থা বলে এর নাম ‘রাবেয়া’ রাখা হয়। আরবী ভাষায় রাবেয়া অর্থ চতুর্থা। বর্তমানে মুসলিম নারী সমাজে তারই পুণ্যস্মৃতি হিসেবে ঘরে ঘরে রাবেয়া নামের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। বলা বাহুল্য, আজকাল সন্তানদের আধুনিক ও আনকমন নাম রাখতে গিয়ে মা বাবা, নানা নানি ও মুরব্বিরা নানা বিভ্রান্তি ও ঝামেলার সৃষ্টি করছেন। অনেক নামের অর্থ পাওয়া যায় না। আবার অর্থ থাকলেও তা ধর্মীয় দৃষ্টিতে মূল্যহীন। অথচ মুসলিম নারী পুরুষের জন্য কিংবা নবজাত শিশুর জন্য কুরআন হাদিস ও ইসলামের ইতিহাসে অগণিত অসংখ্য আধুনিক অর্থবহ রুচিসম্মত নাম রয়েছে। এসব নাম রাখা যেমন সওয়াবের, তেমনি একজন সন্তানের সত্যিকারের মুসলিম মনীষীদের আদলে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে এক নিত্য নিয়ামক শক্তি। আমাদের নবীজীর কথা মনে পড়ে। তিনি অনেক বয়স্ক সাহাবীর অর্থহীন নাম পরিবর্তন করে তাৎপর্যপূর্ণ নাম রেখেছেন। সে যাই হোক, আমরা আজ সংক্ষেপে আলোচনা করতে যাচ্ছিলাম মুসলিম মহিলা তাপসী রাবেয়ার (রহ.) কথা। রাবেয়া বয়ঃপ্রাপ্ত হলে তাঁর পিতা মাতা ইন্তেকাল করেন। তাদের ইন্তেকালের অল্প পরেই বসরায় ভয়ানক দুর্ভিক্ষ উপস্থিত হয়। রাবেয়ার ভগ্নিগণও তাঁর নিকট হতে পৃথক হয়ে পড়লেন। সে সময় এক জালিম তাকে পেয়ে সামান্য কয়েকটি মুদ্রার পরিবর্তে এক ধনবান ব্যক্তির নিকট বিক্রি করেন। লোকটি রাবেয়াকে সামান্য বাদীরূপে কঠোর পরিশ্রমের কাজে নিযুক্ত করেন। অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে একদিন তিনি নিজ মনিবের বাড়ি হতে উর্ধশ্বাসে পালাতে গিয়ে আছাড় খেয়ে একখানা হাত ভেঙ্গে ফেললেন। তখন অন্য উপায় না দেখে তিনি মাটিতে বসে পড়লেন এবং সিজদায় গিয়ে আল্লাহর কাছে এ প্রার্থনা করতে লাগলেন : হে খোদা! আমি এতিম ও নিরাশ্রয়া বন্দিনী, আমি কেবল তোমারই সন্তুষ্টি কামনা করি। আমার প্রতি করুণা কর। তোমার অফুরন্ত দান আমার প্রতি বর্ষণ কর। তখনই রাবেয়া এ গায়েবি আওয়াজ শুনতে পেলেন : রাবেয়া! চিন্তা করো না। শীঘ্রই কিয়ামতের মাঠে তোমার গৌরব এতদূর বর্ধিত হবে যে, ফেরেশতাগণও তোমাকে মোবারকবাদ দিবেন।’ এই সান্ত¦নার বাণী শুনেই রাবেয়া নিজ মনিবের গৃহে ফিরে যান। তখন হতে সারা দিন মনিবের খিদমতে সারারাত দরুদ শরীফ পাঠে ও নামাজে মশগুল থাকেন। একদিন দুপুর-রাতে মালিক ঘুম হতে জেগে উঠে। সে রাবেয়ার গুণ গুণ শব্দ শুনে নীরবে অন্ধকারের মধ্যে তাঁর ঘরের দিকে গমন করে। তাঁর অন্ধকার গৃহখানি বেহেস্তি নূরে রৌশন দেখে সে অবাক হয়ে গেল। শুনতে পেল রাবেয়া নির্জন কুঠিরে করুন কণ্ঠে প্রার্থনা করছে : হে খোদা! হে রহমান! তুমি জান সর্বক্ষণ তোমার আদেশ পালনে ও ইবাদতে আমি রত থাকি, ইহা আমার আন্তরিক অভিলাষ। তোমার খিদমতই আমার চোখের জ্যোতি বর্ধিত করবে। যদি আমার শক্তি থাকত এক মুহূর্তও তোমার ইবাদত হতে বিরত থাকতাম না। কিন্তু কি করি, আমি যে পরাধীন এক দাসী। এ কারণে যথাসময়ে তোমার বন্দেগিতে হাজির হতে পারিনা, বিলম্বে পৌঁছতে হয়। গৃহস্বামী এ আবেগময়ী প্রার্থনা শুনে বসে বসে চিন্তা করতে লাগল এবং মনে মনে স্থির করল; এরূপ পবিত্র আত্মাকে আর আমার সেবা কার্যে নিযুক্ত রাখা মোটেই উচিত হবে না, বরং তার সেবায় আমার নিযুক্ত হওয়া কর্তব্য। পরদিন রাতে গৃহস্বামী রাবেয়াকে ডেকে দাসত্ব হতে মুক্ত করে বিনীতভাবে বলল; রাবেয়া! যদি তুমি এখানে থাকতে ইচ্ছে কর, আমি দাস হয়ে তোমার সেবায় নিজেকে বিলিয়ে দেব। অন্যথায় তোমার যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেত পারো।” হযরত রাবেয়া গৃহস্বামীর অনুমতি নিয়ে গৃহ হতে বের হলেন এবং আল্লাহ তায়ালার ইবাদতে ও কঠোর সাধনায় মশগুল হলেন। তিনি দিবা-রাত্রের মধ্যে হাজার রাকাত নামায আদায় করতেন এবং কখনও কখনও হাসান বসরীর (রহ.) মজলিশে যোগদান করতেন। পবিত্র মক্কা শরীফেই তাঁর বাকি জীবনের অবসান ঘটে। মহীয়সী রাবেয়া অনেক কষ্ট পেয়েছেন ছোট কাল থেকে। কিন্তু ধর্ম চর্চা হতে বিচ্যুত হননি, ভুলে বসেননি আল্লাহর ইবাদত ও স্মরণ। তাই সম্মানিত হয়েছেন দুনিয়ায়, সম্মানজনক আখিরাত জীবনের পাথেয় সঞ্চয় করেছেন অঞ্জলী ভরে।
×