ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

করোনা মোকাবেলায় পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা প্রয়োজন

প্রকাশিত: ১০:২৬, ১ এপ্রিল ২০২০

করোনা মোকাবেলায় পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা প্রয়োজন

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বিশ^ব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী উদ্যোগের মধ্যে আরও পরিপূর্ণ দিকনির্দেশনা প্রয়োজন। তা না থাকায় যে যার মতো করে নিজেকে নিরাপদ রাখার চেষ্টা করছেন। সেটা কখনও বৈজ্ঞানিক, কখনও অবৈজ্ঞানিক। তাছাড়া বিভিন্ন গণমাধ্যমে বিশেষজ্ঞরা একেক ধরনের পরামর্শ দেয়ার কারণে বিভ্রান্ত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। ফলে অনেক রকম গুজবে কান দিচ্ছেন গ্রামের সহজ সরল মানুষ। এই প্রেক্ষাপটে বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী করোনা রোধে একটি পূর্ণাঙ্গ দিকনির্দেশনা সরকারীভাবে প্রচারের তাগিদ দিয়েছেন অনেকে। নির্দেশনাকে গাইড লাইন হিসেবে ধরে গণমাধ্যমে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের প্রতিরোধমূলক পরামর্শ দেয়ার কথা বলছেন সবাই। তাহলে করোনা প্রতিরোধে দেশবাসীকে এক কাতারে আনা সম্ভব। স্বাস্থ্য বিভাগের পরামর্শ ॥ বিশ্বব্যাপী ভয়াবহ আকার ধারণ করা করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে, ভালভাবে সাবান পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে (অন্তত ২০ সেকেন্ড)। হাত না ধুয়ে চোখ, মুখ ও নাক স্পর্শ না করা। হাঁচি কাশি দেয়ার সময় মুখ ঢেকে রাখা। অসুস্থ পশু বা পাখির সংস্পর্শে না আসা ও মাছ ও মাংস ভালভাবে রান্না করে খাওয়া। এর বাইরে বিদেশ ফেরতদের ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা, প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার, অবাধে ঘোরাফেরা না করে ঘরে থাকা, জনসমাগম এড়িয়ে চলা, গণপরিবহন ব্যবহার না করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা প্রভৃতি। হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করাসহ গঠিত কমিটিগুলোর কার্যক্রম সুনির্দিষ্ট করে একটি সতর্কতামূলক গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মোঃ আসাদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত গণবিজ্ঞপ্তিতে ১০ দফা নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। গণবিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, করোনাভাইরাস সংক্রমণ মোকাবেলায় জাতীয়, বিভাগীয়, সিটি কর্পোরেশন এলাকা, পৌরসভা, জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ পর্যায়ে কমিটি গঠিত হয়েছে। হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতকরণে সংশ্লিষ্ট কমিটি প্রযোজ্য ক্ষেত্রে যেসব কার্যক্রম গ্রহণ করবেন। ১. হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিবর্গ ১৪ দিন ঘরের বাইরে বের হবেন না এবং নিজ বাড়ির নির্ধারিত একটি কক্ষে অবস্থান করবেন। ২. পরিবারের অন্যান্য সদস্য দেশে প্রত্যাগত সদস্যের হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করবেন। ৩. গঠিত কমিটিগুলো সম্প্রতি বিদেশ প্রত্যাগত ব্যক্তিদের বাড়ি চিহ্নিত করবেন এবং তাদের গৃহে সার্বক্ষণিক অবস্থানের বিষয়ে তদারকি করবেন। ৪. গঠিত কমিটিগুলো হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করার জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকার জনপ্রতিনিধি, সরকারী কর্মকর্তা-কর্মচারী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ (যেমন: পৌর মেয়র, পৌর কাউন্সিলর, ইউপি চেয়ারম্যান, ওয়ার্ড মেম্বার, ইউনিয়ন ভূমি সহকারী কর্মকর্তা, স্বাস্থ্য সহকারী, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার, পরিবার কল্যাণ সহকারী, পরিবারকল্যাণ পরিদর্শিকা, গ্রাম পুলিশ, স্থানীয় সাংবাদিক) বিদেশ প্রত্যাগত ব্যক্তি সম্পর্কে অবহিত করে হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে প্রয়োজন অনুযায়ী সম্পৃক্ত করতে হবে। ৫. কোয়ারেন্টাইনকৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব উক্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসতে পারবেন না। ৬. যদি কোয়ারেন্টাইনকৃত ব্যক্তি উপর্যুক্ত নিয়মভঙ্গ করেন তবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ সংশ্লিষ্ট স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার সহায়তা প্রহণ করবেন। ৭. প্রয়োজনে ৩নং ক্রমিকে বর্ণিত ব্যক্তিবর্গ সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, উপজেলা চেয়ারম্যান, সিভিল সার্জন, উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কর্মকর্তাকে অবহিত করবেন। ৮. হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিগণ অসুস্থ হলে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ এবং প্রয়োজনে স্থানীয় সিভিল সার্জন, হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ও উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করবেন। তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ৯. কোয়ারেন্টাইনে থাকা ব্যক্তিগণ যদি নিয়ম ভঙ্গ করেন তাহলে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। উক্ত আইনে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ১০. প্রতিদিন এ বিষয়ে জেলাভিত্তিক একটি প্রতিবেদন তৈরিপূর্বক সংশ্লিষ্ট সিভিল সার্জন নিয়ন্ত্রণ কক্ষ স্বাস্থ্য অধিদফতরের ই-মেইল ও মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের ই-মেইল পাঠানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এর বাইরে করো প্রতিরোধে বিদেশ থেকে আসা ব্যক্তিদের বাড়ি বাড়ি লাল পতাকা টানানো হয়েছে। এছাড়াও বাড়ির সামনে হোম কোয়ারেন্টাইন লেখা লিখে শুরু থেকে ১৪ দিন করে শেষের তারিখও লেখা হয়েছে। যদিও অনেকেই তা মানছেন না। খুলনাসহ বিভিন্ন জেলায় বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তিরা যে ঠিকানা দিয়েছেন সেখানে গিয়ে তাদের দেখা মিলছে না। অনেকে সঠিক ঠিকানা দিলেও বাড়ি গিয়ে দেখা পাননি প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রাম গঞ্জে চাউর আছে করোনার কারণে মাছ ও মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ। খাওয়া যাবে না গরুর দুধও। কারো মতে রোদে গেলে করোনা বাড়ে। কারো মতে কমে যায়। কোন ধরনের সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করলে জীবাণু ধ্বংস হবে এ নিয়ে আছে দ্বিধাদ্বন্দ্ব। বাতাসে কি করোনা সংক্রমণ হয় এ প্রশ্ন অনেকের। দিনে না রাতে সংক্রমণ বেশি। কারো গায়ের পোশাক পরলে কি সংক্রমণ হতে পারে। তাহলে প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাস বা সার্বিক জীবন যাত্রা কেমন হবে। এরকম হাজারো প্রশ্নে আছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। আছে নানা রকম দ্বিধা ও বিভ্রান্তি। আছে গুজবও। কেউ কেউ নিজের মতো করেই প্রতিরোধে ওষুধ খাচ্ছেন। এক শ্রেণীর সুবিধাভোগী মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে করোনা প্রতিরোধের ওষুধ বিক্রির প্রচার করছেন। অনেকে তা সংগ্রহও করছেন বেশি টাকায়। এমন একজন প্রতারক কাশির সিরাপ করোনা প্রতিরোধের ওষুধ বলে বিক্রি করতে গিয়ে ধরাও পড়েছে পুলিশের হাতে। তাকে আর্থিক জরিমানা করা হয়েছে। গ্রাম গঞ্জে চীন থেকে সৃষ্ট এই ভাইরাস নিয়ে আছে নানা ধরনের গুজবে। গুজবের প্রতি আস্থা রেখে অনেকেই কোন ধরনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ছাড়াই চলছেন। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বালাই নেই। তেমনি করোনার সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে একেক কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। একটি উদাহরণ যদি দেয়া যায় তা হলো, নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার চার নং সিংহের বাংলা ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস নাকি নাস্তিকদের জন্য এসেছে এমন অপপ্রচার মানুষের মুখে মুখে। তাদের বক্তব্য যারা নাস্তিক তারাই শুধু এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই ধর্মচর্চাই পারে রোগ থেকে মুক্তি দিতে। যা বিশ^াস করেন গ্রামের সহজ সরল নারীরাও। একথা শুধু নেত্রকোনা জেলায় নয়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে একথা চাউর আছে। আবার এমন কথাও অনেকে বলেন, চীনে সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচারের কারণে অভিশাপে বৈশি^ক এই মহামারী। যদিও এমন গুজবের কোন ভিত্তি নেই। তবুও গুজব বসে নেই। নানা রকম ডালপালা নিয়ে ছড়াচ্ছে গ্রাম গঞ্জের পথে প্রান্তরে। তাছাড়া করোনা প্রতিরোধে মাস্ক ও পার্সোনাল প্রটেকশন ইকুইপমেন্ট (পিপিই) সবার জন্য বাধ্যতামূলক। তাই দেশে মাস্ক ও পিপিই নিয়ে রীতিমতো কাড়াকাড়ি চলছে। গ্রাম-গঞ্জে সবখানেই এখন মাস্কের জন্য হাহাকার। যে যেভাবে পারছেন এসব সংগ্রহ করছেন। কিন্তু স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব মাস্ক ব্যবহারের যোগ্য নয়। তবে সার্জিক্যাল মাস্ক সবচেয়ে কার্যকর। কিন্তু করোনা রোধে বাজারে এখন হরেক রকমের মাস্ক। সবচেয়ে বড় কথা হলো ওষুধের দোকানের ব্যাগ দিয়ে অহরহ মাস্ক তৈরি করা হচ্ছে। বেগ দিয়ে তৈরি মাস্কে রয়েছে নানা রকমের স্বাস্থ্য ঝুঁকি। মাস্কের প্রধান কাজই হলো ধুলাবালি, ফুলের রেণু, ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া ইত্যাদি যেন আমাদের শ্বাসযন্ত্রের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করতে না পারে, তা নিশ্চিত করা। তবে সব ধরনের মাস্কই সমানভাবে সব ভাইরাস, ব্যাক্টেরিয়া, ধুলাবালি প্রভৃতি থেকে রক্ষা করতে পারে না। সবচেয়ে ভালো সুরক্ষা দেয় এন-৯৫ রেস্পিরেটর মাস্ক। সব ধুলাবালি, ফুলের রেণু, ব্যাক্টেরিয়া থেকে এটি শতভাগ এবং ভাইরাস থেকে ৯৫ ভাগ সুরক্ষা দেয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কেবল এন-৯৫৩ এম মাস্ককে বিশেষভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবুও এর ৫ ভাগ ঝুঁকি আছে। আরও কিছু মাস্ক তাদের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। অন্য সাধারণ মাস্কের তেমন বিজ্ঞানভিত্তিক রেফারেন্স নেই। এগুলো পরলেও যা, না পরলেও তা। একটি এন-৯৫ বা সার্জিক্যাল মাস্ক একটানা অনেকক্ষণ ব্যবহার করাও অনুচিত। এ মাস্ক করোনা আক্রান্তর মনিটরিং সেলে প্রতিবার পরিদর্শনের পর পরিবর্তন করতে হবে। সর্বশেষ বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছে, সবার মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক নয়। মাস্ক পরেও অনেকে এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। যদিও সারাদেশে ১০ দিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর মাস্ক না পরা নিয়ে নানা ধরনের কেলেঙ্কারি ঘটেছে। মাস্ক ব্যবহার না করায় পুলিশের লাঠি পেটা, কান ধরে ওঠবস করার ঘটনা দেশজুড়ে ছিল আলোচনায়। পাশাপাশি একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দুইজন বয়স্ক ব্যক্তির মাস্ক না থাকায় কান ধরে ওঠবস করানোর ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। এখন টেলিভিশন খুললেই করোনা নিয়ে নানা পরামর্শের কথা শোনা যায়। মঙ্গলবার একটি টেলিভিশন চ্যানেলে একজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলছিলেন, করোনা থেকে বাঁচতে ঘরের দরজা জানালা বন্ধ রাখতে হবে। তাহলে করোনার সংক্রমণ ঠোকানো সম্ভব। অন্য একটি চ্যানেলে আরেকজন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলছিলেন, দরজা জানালা বন্ধ রাখার কোন প্রয়োজন নেই। কারো মতে তিন ঘণ্টা রোদে দাঁড়ালেই করোনা থেকে মুক্তি মেলে। কারো মতে না। কেউ বলছেন, বাতাসে এই ভাইরাস তিন ঘণ্টা বাঁচে। কারো মতে বাতাস থেকে সংক্রমিত হয় না। আসলে প্রকৃত ঘটনা কি। কারো বক্তব্য লেবু, শরবত, ফলের রস, ডাব স্বাস্থ্যসম্মত। পত্রিকা বা টাকা থেকে ভাইরাস ছড়ায় না। কারো পরামর্শ হলো, বাজার থেকে আনা ফলের খোসা থেকেও ভাইরাস ছড়াতে পারে। টাকা থেকে ছড়ানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। বৈদ্যুতিক সুইচ ও লিফটের বটম থেকে এই ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে। এজন্য অনেকে লিফটে ওঠা বন্ধ করেছেন। তাছাড়া সর্দি, কাঁশি মানেই, সামান্য শ^াসকষ্ট মানেই করোনা বলছেন অনেকে। এজন্য হাসপাতালে হাসপাতালে মানুষের ভিড়। কোথাও চিকিৎসা মিলছে। কোথাও মিলছে না। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর অভিযোগও আছে। সব কিছু মিলিয়ে হাজারো বিভ্রান্তি আর দ্বিধাদ্বন্দ্ব মানুষের মধ্যে। জীবন যাপনের জন্য তাই প্রয়োজন সার্বিক একটি দিক নির্দেশনা। বিদেশফেরত শুনে বাড়িতে ঢুকতে বাধা, গ্রাম থেকে বেরিয়ে যেতে চাপ দেয়া, কোভিড-১৯ এর লক্ষণ নিয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির দাফনে বাধা, সম্ভাব্য রোগীকে চিকিৎসা দেয়ায় হাসপাতাল ভাঙচুর, অস্থায়ী হাসপাতাল তৈরিতে বাধা- বাংলাদেশে নোভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণ ধরা পড়ার পর থেকেই এমন অনেক ঘটনার খবর মিলছে নিয়মিতই। মূলত এই ভাইরাস নিয়ে গুজবনির্ভর ভুল ধারণার কারণেই এসব ঘটনা ঘটছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈজ্ঞানিক, অযৌক্তিক এবং অমূলক এসব কর্মকা-ের মাধ্যমে মানুষ নিজেদেরই ক্ষতি করছে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট-আইইডিসিআরের হিসাবে, মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশে ৫১ জন নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছেন। এ রোগে মারা গেছেন এখন পর্যন্ত ৫ জন। বিশে^ আক্রান্তের সংখ্যা সাত লাখ ৭৮ হাজারের বেশি। মৃত্যুর সংখ্যা ৩৮ হাজার ছাড়িয়েছে। আইইডিসিআর বলছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে বা নিজের বাড়িতে রেখে চিকিৎসা দেয়া নিরাপদ। বিদেশফেরত মানুষকেও নিজের বাড়িতে হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার পরামর্শ শুরু থেকেই দিয়ে আসছে আইইডিসিআর। কোভিড-১৯ আক্রান্ত সন্দেহে মারা গেছে এই অজুহাতে গত ২৮ মার্চ বগুড়ার শিবগঞ্জে এক ব্যক্তির লাশ দাফনে বাধা দেয় স্থানীয়রা। ঢাকার খিলগাঁওয়ের তালতলা কবরস্থানেও কোভিড-১৯ এ মারা যাওয়া দুই ব্যক্তিকে দাফন করতে বাধা দেয় এলাকাবাসী। পরে তাদের মিরপুরের বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করা হয়। ২২ মার্চ রাজধানীর উত্তরায় করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীকে ভর্তি ও চিকিৎসা সেবা দেয়ার প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করে স্থানীয়রা। শনিবার তেজগাঁওয়ে এই ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল তৈরির কাজে বাধা দেয়া হয়। এর বাইরেও করোনাকে কেন্দ্র করে হাজারো ঘটনা ঘটছে। যা লেখে শেষ করা যাবে না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য মোঃ কামরুল ইসলামের মতে, বাংলাদেশের মানুষের অনেক গুণ আছে, আবার কিছু কঠিন খারাপ দোষও আছে। গুজবে বিশ্বাস করা এর মধ্যে একটা। তিনি বলেন, কোন ব্যক্তি নোভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলেও যতক্ষণ পর্যন্ত কেউ তার সংস্পর্শে না আসছে ততক্ষণ সংক্রমিত হওয়ার ভয় নেই। সবার জন্য মাস্ক নয় ॥ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বলছে, গণহারে মাস্ক পরার কারণে বিশ্বজুড়ে এই সুরক্ষা-সরঞ্জামের ব্যাপক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত কিংবা আক্রান্তদের সেবায় নিয়োজিত নন; এমন ব্যক্তিদের মাস্ক পরতে মানা করেছে তারা। সোমবার জেনেভায় সংস্থাটির সদর দফতরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে কর্মকর্তারা বলেন; যাদের সত্যিই মাস্ক দরকার, গণব্যবহারের কারণে সৃষ্ট সঙ্কটে তারা ঝুঁকির মুখে পড়ছেন। করোনাভাইরাস আতঙ্কে সারা বিশ্বজুড়ে মাস্ক পরার হিড়িক পড়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম সিএনএনের প্রতিবেদন বলছে, এই মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে মাস্কের সঙ্কট নিয়ে উদ্বিগ্ন ডব্লিউএইচও। সংবাদ সম্মেলনে সংস্থার জরুরী স্বাস্থ্য কর্মসূচীর নির্বাহী পরিচালক মাইক রায়ান বলেন, ‘গণহারে মাস্ক পরার কারণে বিশ্বজুড়ে এই সরঞ্জামের ব্যাপক সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যেসব স্বাস্থ্যকর্মী সামনে থেকে করোনায় আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় নিয়োজিত, বর্তমানে তারাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। কেননা তারা প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে ভাইরাসটির সংস্পর্শে আসছেন। তাদের মাস্ক না থাকার বিষয়টি ভয়াবহ।’ আক্রান্ত না হলে মাস্ক পরার প্রয়োজন নেই উল্লেখ করে রায়ান আরও বলেন, ‘গণহারে মাস্ক পরার কারণে কোন সুবিধা হয়েছে বলে নির্দিষ্টভাবে জানা যায়নি, উল্টে মাস্ক সঠিকভাবে না পরার কারণে হিতে-বিপরীত হওয়ার প্রমাণ মিলেছে।’ টেস্টে বেরিয়ে আসবে প্রকৃত চিত্র ॥ গত ২৫ মার্চে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৬৫ হাজার। অথচ ৫ দিনের ব্যবধানে ৩০ মার্চে এসে সেই সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়ে যায়। দেশটিতে হঠাৎ করেই করোনা আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পেছনে কারণ হচ্ছে, দেশটির প্রায় সব অঙ্গরাজ্যে ব্যাপক ভিত্তিতে টেস্টের সংখ্যা বাড়ানো। অথচ বাংলাদেশে শুরু থেকেই এর উল্টো চিত্র। প্রথমে শুধু বিদেশ ফেরত কিংবা তাদের সংস্পর্শে এসেছেন এরকম ব্যক্তিদের মধ্যে করোনার উপসর্গ থাকলে টেস্ট করা হয়েছে। এখন এর আওতা বাড়িয়ে ষাটোর্ধ বয়সী এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগ যাদের রয়েছে কিংবা যারা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত এবং এর কারণ নির্ণয় করা যায়নি তাদেরও টেস্টের আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। এছাড়া চিকিৎসা, গণপরিবহন খাতের মতো পেশার সঙ্গে জড়িতদেরও করোনার উপসর্গ থাকলে টেস্টের আওতায় আনা হচ্ছে। যারা এর বাইরে তাদের কোয়ারেন্টাইনে থেকে উপসর্গ ভিত্তিক চিকিৎসার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে আইইডিসিআরের পক্ষ থেকে। কিন্তু টেস্ট করানো হচ্ছে না। এর মধ্যেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে এরকম অনেকেই জানাচ্ছেন, উপসর্গ থাকার পরও তাদের টেস্ট করানো হচ্ছে না। আবার অনেকেই টেস্টের জন্য হটলাইনেও যোগাযোগ করতে পারছেন না। প্রতিদিন হটলাইনে হাজার হাজার কল এলেও পরীক্ষা হচ্ছে অল্প সংখ্যক। মঙ্গলবার পর্যন্ত এই সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৬০২। ফলে প্রশ্ন উঠছে, ব্যাপক ভিত্তিতে টেস্ট করতে আইইডিসিআরের সক্ষমতার অভাব আছে? নাকি এতো টেস্টের প্রয়োজন মনে করা হচ্ছে না? আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা অবশ্য বলছেন, উপসর্গ থাকলেই টেস্ট করাতে হবে বিষয়টি এমন নয়। এখানে সক্ষমতার প্রশ্ন নেই। যাদের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করা প্রয়োজন তাদের প্রত্যেকেরই পরীক্ষা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে কয়েকবারই জানানো হয়েছে যে, শীঘ্র ঢাকার বাইরে বিভাগীয় শহরগুলোতে ল্যাব চালু হবে। কিন্তু চট্টগ্রাম ছাড়া অন্য কোন বিভাগে সেটা চালু হয়নি। রাজশাহী, রংপুর, খুলনা, সিলেট এবং ময়মনসিংহে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় এর কোনটিতেই এখনও পর্যন্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়নি। যদিও বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে করোনা প্রতিরোধে সবচেয়ে বড় উপায় হলো টেস্ট টেস্ট আর টেস্ট। যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রীও বলেছেন, পরীক্ষা সরঞ্জামের কোন অভাব নেই। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কারণ নেই বলেও সবাইকে আশ^স্ত করেছেন তিনি।
×