ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

থমকে গেছে জনজীবন ॥ ঘরে থাকার যুদ্ধ করোনা মোকাবেলায়

প্রকাশিত: ১০:২৭, ২৭ মার্চ ২০২০

থমকে গেছে জনজীবন ॥ ঘরে থাকার যুদ্ধ করোনা মোকাবেলায়

রাজন ভট্টাচার্য ॥ বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বিভিন্ন দেশের নেয়া কঠোর পদক্ষেপের কারণে পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ কোন না কোনভাবে বিধিনিষেধের বেড়াজালে বন্দী জীবন কাটাচ্ছেন। চীন থেকে উৎপত্তি কোভিড-১৯ আক্রান্তের সংখ্যা সাড়ে চার লাখ ছাড়িয়ে গেছে। মৃতের সংখ্যা ছাড়িয়েছে ২১ হাজার। চারদিকে আতঙ্ক ছড়ানো এ পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, একটি সমন্বিত বৈশ্বিক প্রচেষ্টাই শুধু পারে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের প্রকোপ থামাতে। মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসে আক্রান্ত বাংলাদেশও। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৪৪ রোগী শনাক্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা পাঁচ। এই পরিস্থিতিতে ২৬ মার্চ থেকে আগামী ১০ দিন সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। মরণঘাতী এ রোগ প্রতিরোধে সরকার ও চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে সবাইকে ঘরে থাকার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ঘরে থাকার যুদ্ধ শুরুর মধ্য দিয়ে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে এক অন্যরকম ঢাকা দেখল নগরীর মানুষ। ইতোমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে নৌ-রেল-সড়কসহ আকাশ পথের যোগাযোগ। বন্ধ সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। আর বৃহস্পতিবার থেকে দেশজুড়ে বন্ধ হলো সব ধরনের গণপরিবহন। তাই জনশূন্য রাজধানী। বন্ধ মার্কেট, বিপণিবিতানসহ প্রায় সব রকমের দোকানপাট। গণপরিবহন বলতে কিছুই নেই। অলিগলি থেকে রাজপথ সবখানেই যেন রাজ্যের নীরবতা নেমেছে। হাতেগোনা কিছু রিক্সা দেখা গেছে বিরাণভূমিতে পরিণত হওয়া এই শহরে। যাদের একান্ত প্রয়োজন তারাই শুরু রাস্তায় নেমেছেন। তবে ওষুধের ফার্মেসি, কাঁচাবাজারসহ নিত্যপণ্যের কিছু দোকান খোলা থাকলেও সেখানেও আছে ক্রেতা সঙ্কট। সব মিলিয়ে ভূতুরে নগর। সকাল থেকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন রাজধানী। বিচ্ছিন্ন জেলা থেকে জেলা-উপজেলা পর্যন্ত। করোনা প্রতিরোধে ভারতসহ বিশে^র অন্য দেশ এখন লকডাউন। অনেক দেশে ঘোষণা করা হয়েছে জরুরী অবস্থা। কোথাও চলছে কার্ফু। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বিভিন্ন উপজেলা, মহল্লা থেকে শুরু করে বাড়ি লকডাউন করা হয়েছে। কিন্তু ১০ দিনের ছুটি শুরুর প্রথম দিনেই যেন গোটা দেশ এমনিতেই লকডাউনে চলে গেছে। পরিস্থিতি ও পরিবেশ বলছে, সরকারের আহ্বানে মানুষ সাড়া দিয়ে ঘরে ফেরার ঘোষণাতেই যেন দেশজুড়ে লকডাউন চিত্র। সড়ক মহাসড়কও ফাঁকা। এদিকে নিরাপত্তার স্বার্থে নগরজুড়ে রাস্তায় রাস্তায় বসেছে পুলিশের চেকপোস্ট। চলছে তল্লাশি। দুইজন একসঙ্গে পথে চলতে দেখলেই বাসায় ফেরার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। মাস্ক ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে। আবার প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়ার কারণে অনেককেই বাসায় ফিরিয়ে দিয়েছে পুলিশ। বেড়েছে সেনা টহল। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সাধারণ মানুষকে মোড়ে মোড়ে সচেতন করতে দেখা গেছে। প্রয়োজন ছাড়া যারা বিনা কারণে রাস্তায় নেমেছেন তাদের বাসায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। যারা সহজেই যেতে চাননি তারা কেউ কেউ খেয়েছেন পুলিশের বাড়ি। কান ধরে ওঠবস করিয়ে কেনানো হয়েছে মাস্ক। তাছাড়া অপ্রয়োজনে কাউকে বাসা থেকে বের না হতে পাড়া মহল্লায় চলছে মাইকিং। করোনার জীবাণু ধ্বংসে সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে রাস্তায় রাস্তায় ব্লিচিং পাউডার মিশ্রিত পানি ছিটাতে দেখা গেছে। যা পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত চলবে। ২৬ মার্চ ছিল স্বাধীনতা দিবস। দিবসটি উপলক্ষে সব ধরনের আনুষ্ঠানিকতা বাদ দেয়া হয়েছে। সাধারণ মানুষের বক্তব্য হলো, ১৯৭১ সালের পর এমন সুনসান নগরের চিত্র আর কখনই চোখে পড়েনি। আবার কারও কারও বক্তব্য হলো, জিয়াউর রহমান ও এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের সময় সাধারণ মানুষের মধ্যে এমন ভয় দেখা গিয়েছিল। ১৯৯৬ সালে অসহযোগ আন্দোলনের পর ২০০৭ সালে দেশে জরুরী অবস্থার ঘোষণা হলে রাজধানী ফাঁকা হয়ে যায়। তবে সবকটি কারণ ছিল রাজনৈতিক। এর বাইরে কোন ভাইরাসের কারণে ঢাকার এমন চিত্র আগে কোনদিন কেউ দেখেনি। দেশের সবকটি রাজনৈতিক দলের কার্যালয়ে পর্যন্ত রাজ্যের নিরবতা নেমেছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউ এ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ও কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলতে দেখো গেছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, যে শহর গোটা বিশে^র মধ্যে দূষণের শীর্ষে ছিল সেই শহরে এখন কিছু নেই। ফাঁকা। তাই দূষণের তালিকায় এখন আর সামনের সারিতে ঢাকার নাম নেই। যে শহরে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ চার কিলোমিটার যান চলার সুযোগ পেত এখন চার মিনিটে চার কিলোমিটার সড়ক অতিক্রম করা সম্ভব। যে শহরে ছিল ১৫ লাখের বেশি যানবাহন সেখানে এখন এ প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত সবকিছু দেখা সম্ভব হচ্ছে। কোন কোলাহল নেই। রাজপথ থেকে অলিগলি পর্যন্ত সবখানেই নীরব। তবে এই সুযোগে বেড়েছে কাঁচাবাজারের দাম। লেবুতে যেন রীতিমতো আগুন লেগেছে। বাংলাদেশে নতুন করে পাঁচজনের দেহে করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। নতুন পাঁচজনের মধ্যে একজন বিদেশ থেকে এসেছেন। তিনজন আগের রোগীর সংস্পর্শে ছিলেন। এ নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ৪৪। স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে ১২৬ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে পাঁচজনের মধ্যে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত করা গেছে। এ পর্যন্ত সর্বমোট ৯২০ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হলো। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় গত ২৪ মার্চ সকালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এক ভিডিও বার্তায় আজ ২৬ মার্চ থেকে সব ধরনের গণপরিবহন বন্ধের ঘোষণা দেন। সরকারের এমন ঘোষণার পর সকাল থেকে কোন ধরনের পরিবহন চালাচল করছে না। নগরীর সড়কগুলোও জনমানবশূন্য অবস্থায় রয়েছে। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নগরীর টার্মিনালগুলো থেকে কোন পরিবহন ছেড়ে যায়নি। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কোন পরিবহন ছেড়ে আসছে না। একসঙ্গে দুইজন চলাচলও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সকাল থেকে সারাদেশের সঙ্গে রাজধানী ঢাকা বিচ্ছিন্ন রয়েছে। সকালে গুলিস্তান, সায়েদাদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, ফুলবাড়িয়া, মহাখালী ও গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে কোন বাস ছেড়ে যায়নি। এসব টার্মিনালের শ্রমিকরা অলস সময় কাটাচ্ছেন। কেউ কেউ এরই মধ্যে গ্রামের বাড়িতে চলে গেছেন। যারা ঢাকায় রয়েছেন তারা টার্মিনালগুলোতে রান্না করে খাচ্ছেন। সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস-মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, সকাল থেকে একটি বাসও ছাড়া হয়নি। রাস্তাঘাটে কোন লোকজন নেই। এমন পরিবেশ আর কখনও হয়নি। আমাদের টার্মিনালের শ্রমিকরা অলস সময় কাটাচ্ছে। এখন আমি তাদের রান্না করার ব্যবস্থা করছি। জানতে চাইলে বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সোহাগ পরিবহনের পরিচালক মারুফ তালুকদার সোহেল বলেন, আমরা সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। একটি পরিবহনও চলছে না। যাত্রীও নেই। একই চিত্র দেখা গেছে ফুলবাড়িয়া, মহাখালীসহ রাজধানীর অন্য পরিবহন টার্মিনালগুলোতে। নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের ঢাকা নদীবন্দরের যুগ্ম পরিচালক আলমগীর কবির বলেন, করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় গত মঙ্গলবার (২৪ মার্চ) থেকে দেশের সব রুটে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। তাই সদরঘাট থেকে লঞ্চ চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। টার্মিনালেও জনশূন্যতা বিরাজ করছে। আমরা কোন লঞ্চ চলতে দিচ্ছি না। বর্তমান পরিস্থিতিতে শ্রমিকরাও অনেক সচেতন। গত ২৪ মার্চ থেকে পরবর্তী ঘোষণা না দেয়া পর্যন্ত দেশের সব রুটে অনির্দিষ্টকালের জন্য যাত্রীবাহী রেল চলাচল বন্ধ রয়েছে। এর ফলে সকাল থেকে কমলাপুর স্টেশন থেকে কোন ট্রেন ছাড়া হয়নি। রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, গত মঙ্গলবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য সবধরনের যাত্রীবাহী ট্রেন বন্ধ রয়েছে। এদিকে অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক রুটে বিমান যোগাযোগও প্রায় বন্ধ রয়েছে। তবে চীন ও লন্ডনের সঙ্গে যোগাযোগ স্বাভাবিক আছে। জীবাণুনাশক স্প্রে কার্যক্রমের উদ্বোধন ॥ এদিকে সারাদেশে কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতে জনপ্রতিনিধিরা কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। বৃহস্পতিবার মিরপুর স্টেডিয়ামের সামনে করোনাভাইরাস সংক্রমণ রোধে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোশনের (ডিএনসিসি) জীবাণুনাশক স্প্রে কার্যক্রম পরিদর্শন শেষে এ কথা বলেন তিনি। তাজুল ইসলাম বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ এবং পৌরসভায় যারা বিদেশ থেকে এসেছেন তারা যেন ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকেন সে বিষয়ে স্থানীয় প্রতিনিধিরা কাজ করছেন। এজন্য প্রতিটি এলাকায় একটি করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঢাকা ও চট্টগ্রাম থেকে প্রচুর মানুষ গ্রামে গেছেন। তারা যেন তাদের পরিবার থেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে সে বিষয়টি নিশ্চিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে করোনাভাইরাস রোধে জনগণের পাশে আমরা সবাই আছি উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, করোনা থেকে রক্ষা পাওয়ার সবচেয়ে উত্তম পন্থা হলো আলাদা থাকা। ঘর থেকে বাইরে বের না হওয়া। একজন আরেকজন থেকে দূরত্ব বজায় রাখা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জীবাণুনাশক স্প্রে কার্যক্রম পরিদর্শনে উপস্থিত ছিলেন ডিএনসিসির নবনির্বাচিত মেয়র আতিকুল ইসলাম, প্যানেল মেয়র মোঃ জামাল মোস্তফা প্রমুখ। এরপর রাজধানীর ধানম-ি, রাসেল স্কয়ার, নিউ মার্কেটসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তায় জীবাণুনাশক স্প্রে ছিটানো হয়। সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকেও এ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। দিনভর রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ ॥ ফার্মগেট রাজধানীর ব্যস্ততম সড়কের একটি। যেখানে ক্ষণে ক্ষণে মানুষ বাড়ে। যেন হাজার হাজার মানুষের ঢল লেগেই থাকে। সেখানে দেখা গেছে রাজ্যের নীরবতা। মানুষ নেই। বন্ধ দোকানপাট। যানবাহনের কর্কশ শব্দ থেমে গেছে। ট্রাফিক পুলিশে সিগন্যাল ধরা, গাড়ি আটকানোর কোন তৎপরতা নেই। সারিসারি দোকানপাট বন্ধ। তবে বাংলামোটর ওভারব্রিজের নিচে ও পরিবাগ এলাকায় দেখা গেছে, পুলিশের নিরাপত্তা চৌকিতে পাকরাও অভিযান। যারা মোটরসাইকেল নিয়ে বেপরোয়া গতিতে আসছেন তাদের থামার জন্য দেয়া হচ্ছে সিগন্যাল। প্রথমের বের হওয়ার কারণ জিজ্ঞাস শেষে মাস্ক কেন নেই সে প্রশ্ন। সদুত্তর না থাকলে হয় মামলা নয় গাড়ি ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে। যারা পুলিশের সচেতনতায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন তারা খেয়েছেন লাঠির বাড়ি। সিএনজি ও রিক্সা চালকরা কোন মাস্ক ব্যবহার না করায় কান ধরে ওসবস করানো হয়েছে। গেন্ডারিয়া এলাকাতেও পুলিশী তৎপরতা ছিল দেখার মতো। সেখানে থাকা গেন্ডারিয়া থানা পুলিশের উপ-পরিদর্শক (এসআই) মামুনুর রশিদ বলেন, কাউকে ছাড় নয়। অযথা যারা ঘুরে বেড়ায় তাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স দেখানো হচ্ছে। সকাল সাড়ে ১০টা রাজধানীর যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা এলাকা। ব্যাগ-বস্তা নিয়ে কিছু লোক দাঁড়িয়ে আছেন। গন্তব্য তাদের গ্রাম। কিন্তু কোন গাড়ি নেই। রফিক নামে তাদের একজন জানালেন, তিনি ২০ বছর ধরে এই সড়ক দিয়ে চলাচল করেন। তবে এরকম অবস্থা কোন দিন চোখে পড়েনি। মাঝে মধ্যে দু’একটি পিকআপ চলাচল করছে মালামাল পরিবহন করছেন। সেগুলো থামিয়ে লোকজন যাওয়ার চেষ্টা করছেন তবে পুলিশ বাধা দিচ্ছে। সায়েদাবাদ এলাকায় দায়িত্বে থাকা ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট গোলাম রাব্বানী বলেন, কোন গাড়ি যেন চলাচল করতে না পারে সেজন্য পাহারা দেয়া হচ্ছে। মতিঝিলের আরামবাগ এলাকায় দেখা যায়, কয়েকজন লোককে আটকে পুলিশ জেরা করছেন। তারা কেন বাইরে বের হয়েছেন, কোথায় যাচ্ছেন, মুখে মাস্ক নেই কেন এসব জিজ্ঞেস করছে পুলিশ। এতে অনেকে ‘সরি’ বলে আর বের হবেন না বলে চলে যাচ্ছেন। আবার অনেককে কঠোর ভাষায় সাবধান করে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। কারওয়ান বাজারের সোনারগাঁও মোড়ে দেখা যায়, যাদের মাস্ক পরা নেই তাদের ধরে মাস্কের দোকানে পাঠানো হচ্ছে। কেউ বাজার করে ফেরার পথে পুলিশের জেরার মুখে পড়ছেন। গাড়ি তো নেই বললেই চলে। যেসব গাড়ি চলছে সেগুলো আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নয়তো গণমাধ্যমের। এছাড়া কোন গণপরিবহন চলছে না। রাজধানীর শাহবাগের চিত্রও একই। এই মোড়ে যে কয়েকটি গাড়ি চলাচল করতে দেখা গেছে তার সবই এ্যাম্বুলেন্স। রোগী নিয়ে অনেকে এসেছেন। দুই-চারটা রিক্সাও চলতে দেখা গেছে এই সড়কে। এখানেও পুলিশের তল্লাশি করতে দেখা গেছে। রমনা বিভাগের পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আব্দুল্লাহেল কাফি বলেন, দুজনকে এক সঙ্গে ঘোরাফেরা করতে নিষেধ করা হচ্ছে। অতি প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করা হচ্ছে। পুলিশের প্রত্যেকটা ডিউটিরত গাড়ি থেকে এই মেসেজ দেয়া হচ্ছে। নিত্যপণ্য ছাড়া আর কোন দোকান খোলা রাখা যাবে না এই বার্তাও দেয়া হচ্ছে। আজিমপুর মাতৃসদন হাসপাতালের সামনের সড়ক ফাঁকার মধ্যে সেখানে ওষুধের দোকানেও ক্রেতা দেখা গেছে। তবে পুলিশের জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার (পেট্রোল) মোঃ সানোয়ার হোসনে জানিয়েছেন, এ সময় অপ্রয়োজনে কাউকে ঘোরাফেরা করতে দেখলেই তাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। আজিমপুর চৌরাস্তায় কিছু পুলিশ সদস্যকে সড়কের মাঝে লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এ সময় অপ্রয়োজনে কেউ ঘোরাঘুরি করছেন মনে হলেই তাকে ধাওয়া দিচ্ছেন তারা, আবার কাউকে ধরতে পারলে হালকা পিটুনি দিতেও দেখা যায়। তল্লাশির বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপির গণমাধ্যম শাখার উপ কমিশনার মাসুদুর রহমান বলেন, যেহেতু সরকার নির্দেশনা দিয়েছেন নগরবাসীকে ঘরে থাকার জন্য, তাই সবাইকে ঘরে রাখতেই পুলিশের এ অবস্থান। সব মিলিয়ে পুলিশ কঠোর অবস্থানে রয়েছে। একটাই উদ্দেশ্য সবাই ঘরে অবস্থান করুক। জাতীয় এ স্বার্থে সবাইকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তার জন্যও আহ্বান জানান তিনি। এদিকে সেনাবাহিনীর একটি কোথাও দুটি গাড়ি একসঙ্গে টহল দিতে দেখা গেছে নগরীর বিভিন্ন সড়কে। যেখানেই মানুষের ভিড় দেখছেন তারা সবাইকে বাসায় ফিরতে অনুরোধ করেন। স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য মাস্ক পরার পরামর্শ দেন। প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে কোন অবস্থাতেই বের না হওয়ার কথাও বলেন তারা। ধানম-ি, ফার্মগেট, আসাদগেট, রামপুরা, মালিবাগ, মতিঝিল, মৌচাক, কাকরাইল, শান্তিনগরসহ বিভিন্ন এলাকায় সেনা টহল দেখা গেছে। ‘অবরুদ্ধ’ এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। সবকিছু বন্ধ থাকলেও কিছু রিক্সাচালককে রাস্তায় দেখা গেছে। আচ্ছা ভাবুন তো মৌচাক এলাকার কথা। সেখানে যদি কোন দোকানপাট খোলা না থাকে, সড়কে যানবাহন না থাকে তাহলে তো ভূতুরে পরিবেশ বিরাজ করার কথা। তাই হয়েছে। এত নির্জনতার মধ্যেও সেখানে তিন-চারটি রিক্সা থেমে থাকতে দেখা গেছে। শহীদ মিয়া জানালেন, দিন আনি দিন খাই। আজ থেকে কোন ভাড়া হচ্ছে না। কিভাবে নিজে চলব। কিভাবে বাবা মার জন্য টাকা পাঠাব। একই কথা জানালেন, অপর রিক্সাচালক হোসেন মিয়া। তিনি বলেন, দুপুর পর্যন্ত অন্যসময় ছয় শ’ থেকে ৭০০ টাকা আয় হলেও আজ আয় হয়েছে মাত্র ৬০ টাকা। যাত্রী নেই। তাই ভাড়াও হচ্ছে না। পুলিশের কড়াকড়ির মধ্যে হঠাৎ সেখানে একটি গাড়ি এসে থামল। দুজন রিক্সা চালককে দেয়া হলো পাঁচকেজি করে চাল। খুশি তারা। ঘরবন্দী জীবন, সুনসান নীরবতা ॥ স্টাফ রিপোর্টার বগুড়া,বাগেরহাট ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে জানান, করোনা আতঙ্কে পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে, বাগেরহাট শহরে এখন যেন দীর্ঘশ্বাসও নেই, নেই কান্নার শব্দ, হাপিত্যেশ- কিছুই নেই! আছে বেঁচে থাকার, ভাল থাকার নিদারুণ উৎকণ্ঠা। আর সেই অদম্য ইচ্ছায় প্রায় সবাই ঘরবন্দী জীবন-যাপন করছেন। অতিচঞ্চল শিশুটিও আর মাঠে খেলতে যেতে চাইছে না। ডায়াবেটিক রোগী বা’ স্বাস্থ্যসচেতন মানুষটিও ঘরের মধ্যে হাঁটাহাঁটি সারছেন। হাট-বাজার, রাস্তাÑঘাট সবই প্রায় ফাঁকা। ভর দুপুর কিংবা সন্ধ্যা সবই এক। সুনসান। দৃশ্যত এ যেন অভূতপূর্ব এক জীবন-যাপন। আসলে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বাগেরহাটজুড়ে ঘরে থাকছে নারী-শিশু, যুবা-বৃদ্ধ, ধনী-দরিদ্র সকলেই। করোনাভাইরাস প্রতিরোধে ঘরে থাকার নির্দেশের পর বৃহস্পতিবার বাগেরহাটের প্রায় সর্বত্র একই দৃশ্য চোখে পড়েছে। জেলা শহর থেকে শুরু করে উপজেলা সদর এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামের বিভিন্ন হাট-বাজার সবই প্রায় জনশূন্য। ছোট ছোট চায়ের দোকানও বন্ধ। মানুষ ঘরে। রাস্তায় যানবাহন নেই বললেই চলে। কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর টহল গাড়ি মাঝে মধ্যে চোখে পড়েছে। ওষুধের দোকান আর কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দোকান ছাড়া সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ। প্রতিদিনের জমে ওঠা বিভিন্ন মোড়ের আড্ডা নেই। রাস্তাঘাট ফাঁকা তবে ‘অতিপ্রয়োজনে’ নামা কিছু মানুষকে রাস্তায় দেখা গেছে। তাদেরও মুখে মাস্ক, হাতে হ্যান্ড গ্লাভস। জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার পক্ষ থেকে মাইকিং করে বাসিন্দাদের সচেতন করছে। তারা সবাইকে ঘরে থাকা এবং যারা সম্প্রতি বিদেশ থেকে দেশে এসেছেন তাদের ১৪ দিনের জন্য সঙ্গ নিরোধে ‘হোম কোয়ারেন্টাইনে’ থাকতে অনুরোধ করেছেন। জেলা প্রশাসনের প্রচারণায় বলা হচ্ছে, যার যার ঘরে থাকুন, করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করুন। অন্যথায় আইনী পদক্ষেপ নেয়া হবে। বগুড়া ॥ এখানে এখন আক্ষরিক অর্থেই লকডাউন চলছে। সেনাবহিনী ও পুলিশ শহর-নগরে টহল দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ করোনাভাইরাস নিরাপত্তায় স্বেচ্ছায় নিজ ঘরে অবস্থান করছেন। অতি জরুরী প্রয়োজনে যারা ঘর থেকে বের হচ্ছেন তারা মাস্ক পরে কাজ সেরেই আবার ফিরে যাচ্ছেন। পথে কোন যানবাহন না থাকায় হেঁটেই যাচ্ছেন তারা। একজন থেকে আরেকজনের চলাচলে নিরাপদ দূরত্বে থাকছে। বগুড়া শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথা একেবারে সুনসান। মাঝে মধ্যে সাইকেলে চেপে দু’একজনকে দেখা যাচ্ছে। রিক্সায় যাত্রী থাকলেও পুলিশকে কৈফিয়ত দিচ্ছে। জরুরী কাজের যাত্রী হলে তাকে ছেড়ে দিয়ে কাজ সেরে দ্রুত বাড়ি ফেরার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। সেনাবাহিনীর টহলে করোনা সচেতনতার প্রচার চালানো হচ্ছে। পাড়া-মহল্লায় সীমিত পরিসরে কিছু দোকান খোলা আছে। তাও দুপুরের পর বন্ধ হয়ে যায়। শহরের ফতেহ আলী বাজারে সকালের দিকে হাতে গোনা কয়েকটি মাছ ও তরিতরকারির দোকান খোলা ছিল। দুুপুরের পর বন্ধ হয়ে যায়। দোকানি ওসমান জানালেন, গ্রামে থেকে কেউ কোন পণ্য নিয়ে শহরে আসছে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ॥ করোনাভাইরাস প্রতিরোধে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে টহল দিচ্ছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। বৃহস্পতিবার সকালে সেনাবাহিনী শহরের টি.এ রোড, হাসপাতাল রোডসহ বিভিন্ন এলাকায় টহল দেয়। এছাড়াও জেলা প্রশাসনের বেশ কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত শহরজুড়ে সরকারী নির্দেশনা বাস্তবায়নে কাজ করছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গত ২৪ ঘণ্টায় ১২৫ প্রবাসীকে হোম কোয়ারেন্টাইনে নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে ৮৯০ জনকে হোম কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে বলে স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে। এদিকে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার পক্ষ থেকে ১২ ওয়ার্ড ছাড়াও বিভিন্ন যানবাহনে জীবাণুনাশক ছিটানো হয়েছে। এই কার্যক্রম উদ্বোধন করেন পৌর মেয়র নায়ার কবির। এছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে হতদরিদ্রদের মাঝে সরকারী সহায়তা হিসেবে ২০ কেজি চালসহ নগদ টাকা ডাল, তেল ও বিভিন্ন নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।
×